ব্যবসায়ীদের দূর্দিন চলছে নাব্যতা সংকট, নিরাপদ আশ্রয়ের অভাবে কাপ্তাই লেকে মাছ কমছে

মোঃ নজরুল ইসলাম লাভলু, কাপ্তাই (রাঙামাটি):
কাপ্তাইয়ের কর্ণফুলী নদীতে ষাটের দশকে বাঁধ দেওয়ার ফলে রাঙামাটি জেলার বিস্তৃত এলাকা জুড়ে সৃষ্টি হয় ৩৬৫ বর্গমাইলের মনষ্য সৃষ্ট কৃত্রিম কাপ্তাই লেক। শুরুতে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করাই ছিল বাঁধ নির্মাণের মূল উদ্দেশ্য। পরবর্তীতে এই লেক হয়ে উঠে বহু মানুষের জীবন জীবিকার প্রধান উৎস। প্রথম থেকেই কাপ্তাই লেকে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ উৎপাদন শুরু হয়। এতে লেকে মাছ উৎপাদনের বিশাল সম্ভাবনা দেখা দেয়। ফলে কাপ্তাই লেক ঘিরে তৈরী করা হয় মৎস্য আহরণ ও বিপনন কেন্দ্র। তখন কাপ্তাই লেকে বিভিন্ন প্রজাতির বড় বড় মাছের দেখা পাওয়া গেলেও বর্তমানে সেই জৌলুশ আর নেই। সময়ের বিবর্তনে সেই ঐতিহ্য হারাতে বসেছে এই মৎস্য আহরণ ও প্রজনন কেন্দ্র।

সম্প্রতি মাছের আহরণ ও বিপননের অন্যতম কাপ্তাই মৎস্য আহরণ ও বিপনন উপকেন্দ্রে কয়েকজন মৎস্য ব্যবসায়ীর সাথে আলাপকালে তারা জানায়, কাপ্তাই লেকের উপর নির্ভরশীল হয়ে অনেক বছর ধরে তারা মাছের ব্যবসা করে আসছে। অধিকাংশ মৎস্য ব্যবসায়ী ও কর্মচারীরা জানায়, বর্তমানে তাদের দুর্দিন চলছে। এমনিতে শীতের মৌসুমে কাপ্তাই লেকে মাছের পরিমাণ কমে আসে। কিন্তু অন্যান্য বছরের তুলনায় এখন দিনদিন কমে যাচ্ছে কাপ্তাই লেকে মাছের পরিমাণ। এতে হতাশ হয়ে দিনযাপন করছে ব্যবসায়ীরা। তারা জানায়, একসময় এই ব্যবসায় অনেকে নিয়োজিত থাকলেও বর্তমানে মাছের ব্যবসা ছেড়ে
অনেকে অন্য পেশায় জড়িয়ে যাচ্ছে।
এদিকে, বর্তমানে যে অল্প পরিমাণ মাছ পাওয়া যাচ্ছে লেকে তার মধ্যে ছোট মাছের সংখ্যায় বেশি। বিশেষ করে কাচকি, চাপিলা, মলা-ঢেলা জাতের মাছই বেশি পাওয়া যাচ্ছে। বড় আকারের তেমন কোন মাছ একেবারেই ধরা পড়ছেনা বলে তারা জানায়। এবিষয়ে কাপ্তাই মৎস্য ব্যবসায়ী সাহাব উদ্দিন জানান, বর্তমানে ব্যবসা একেবারেই মন্দা যাচ্ছে, এ পরিস্থিতিতে ব্যবসা চালিয়ে যেতে অনেক কষ্ট হচ্ছে। কাপ্তাই লেকে মাছের পরিমাণ কমে যাওয়ার ফলে মাছ ধরা পড়ছে কম। এতে আয় রোজগার কমে গেছে, শ্রমিক- কর্মচারীদের বেতন দিতে কষ্ট হচ্ছে। এক কথায় এ পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের দুর্দিন চলছে।
কাপ্তাই লেকে মাছের পরিমাণ কমে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে একাধিক মৎস্য ব্যবসায়ী ও কর্মচারীরা বলেন, বছরের শীত মৌসুমে লেকে মাছের পরিমান কমে আসে, তবে এতটা কখনো কমেনা। তারা সকলেই মাছ কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে কাপ্তাই লেকের নাব্যতা সংকটকে দায়ী করছেন। বৃহৎ আকারের বিস্তৃত কাপ্তাই লেকের বিভিন্ন পয়েন্টে গভীরতা কমে গেছে। যেখানে মাছের প্রজনন বৃদ্ধি পাওয়ার জায়গা সেখানেই পলি ভরাট ও নাব্য সংকটে মাছের প্রজনন বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। এমনকি ভরা মৌসুমেও মাছের প্রজনন কেন্দ্রে পানির পরিমাণ কম থাকে। পাশাপাশি বিভিন্ন বজ্য আবর্জনার বিষাক্ত পদার্থে লেকের পানি দূষিত হচ্ছে। এসকল কারণে মাছের বংশ বিস্তার বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। এবিষয়ে কাপ্তাই কাপ্তাই মৎস্য উপকেন্দ্রের
দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাসুদ আলমের সাথে সোমবার(২২ জানুয়ারী) যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, লেক সৃষ্টি পর পানির নিচে বিভিন্ন গাছের মোথা(স্থানীয় ভাষায় বলে গুইট্টা) ছিল। যা প্রাকৃতিক ভাবে মাছের নিরাপদ আশ্রয়স্থল এবং ডিম পাড়ার নিরাপদ জায়গা। কিন্তু অধিক মাছ পাওয়ার আশায় এসব গাছের মোথা গুলো মানুষ তুলে ফেলে। এতে মাছ আশ্রয়হীন ও নিরাপদ জায়গার অভাবে ডিম পাড়তে পারেনা। এছাড়া গত ২-৩ বছর ধরে মাছের প্রজননকালীন সময় জুন- জুলাই মাসে লেকে পানির পরিমাণ একেবারে কমে যায়। এতেও মাছের বংশ বিস্তার বাধাগ্রস্থ হয়ে থাকে। এছাড়া অতিরিক্ত মৎস্য আহরণও মাছের বিলুপ্তি এবং বড় প্রজাতির মাছ না পাওয়ার অন্যতম কারণ বলে তিনি মন্তব্য করেন। বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশনের (বিএফডিসি) কর্মচারী মোঃ সাকাওয়াত হোসেন জানান, কাপ্তাই লেকে মাছ ধরা শুরুর পর থেকে প্রথমদিকে অধিক পরিমাণে মাছ পাওয়া যেত। তবে দিনদিন কাপ্তাই লেকে মাছের পরিমাণ কমছে। তিনি জানান, গত ১ মাস আগেও কাপ্তাই লেকে বেশ মাছ পাওয়া গেছে, বর্তমানে অনেকটা কমেছে। আশা করা হচ্ছে শীত মৌসুম চলে গেলে কাপ্তাই লেকে আবারও মাছ আহরণের পরিমাণ বাড়বে।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) তথ্যানুযায়ী জানা যায়, ১৯৯১ সালে কাপ্তাই লেকে দুই প্রজাতির চিংড়ি, দুই প্রজাতির কচ্ছপ ছাড়াও ৭১ প্রজাতির মাছের আবাসস্থল ছিল। এরমধ্যে ৬৬ প্রজাতি ছিল দেশি এবং ৫ প্রজাতি ছিল বিদেশি মাছ। এরপর ২০০৬ সালে সর্বশেষ মাছের শুমারি করা হয়, সেই তথ্যানুযায়ী বর্তমানে লেকে ৬২ প্রজাতির মাছ রয়েছে। এরমধ্যে ৫২ প্রজাতির দেশি এবং ১০ প্রজাতির বিদেশি মাছ। বাকি গুলো ধীরে ধীরে কাপ্তাই লেক থেকে হারিয়ে যাচ্ছে।