সাতই মার্চের ভাষণ শুনেই মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করে নিউক্লিয়াস: চসিক মেয়র

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাতই মার্চের ভাষণ দিলেই নিউক্লিয়াসের সদস্যরা সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের কার্যক্রম শুরু করে বলে মন্তব্য করেছেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. রেজাউল করিম চৌধুরী।

মঙ্গলবার নগরীর থিয়েটার ইনষ্টিটিউট হলে ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ উপলক্ষে আলোচনা সভা ও ডকুমেন্টারী প্রদর্শনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে মেয়র বলেন,  যদিও মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ সালে সংগঠিত হয়, তবে ১৯৬২ সাল থেকেই বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায় তৎকালীণ ছাত্রলীগ কর্মীরা নিউক্লিয়াস নামের একটি সংগঠনের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য গোপনে সশস্ত্র সংগ্রামের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে থাকেন। নিউক্লিয়াসের একজন সদস্য হিসেবে চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের নেতা থাকাকালে আমি রাজনৈতিক সহকর্মীদের নিয়ে চট্টগ্রামে গোপনে সংগঠিত হতে থাকি। সেসময় নিউক্লিয়াসের ¯েøাগান ছিল ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, জয় বাংলা, ‘তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা, মেঘনা, যমুনা’। এসময় আমাদের কার্যক্রম চলতো একদম গোপনে।

“সাতই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা শুনেই বুঝতে পারি যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী। আমরা গোপনে সশস্ত্র অভিযানের জন্য মাঠে নেমে পরি। আর সাধারণ জনগণ মূলত ২৫ মার্চের কালোরাত্রির পর যুদ্ধে অংশ নেয়। যারা রাজনৈতিক সচেতন তারা সাতই মার্চের ভাষণেই স্বাধীনতা আন্দোলনের ইংগিত পান, যা চূড়ান্ত রূপ পায় ২৬ মার্চ। সাতই মার্চের ভাষণ শুনলেই যে কেউ বুঝতে পারবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক নি:সন্দেহে বঙ্গবন্ধু।” এসময় তিনি নিউক্লিয়াসের মুছে যাওয়া ইতিহাসকে তরুণ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার আহŸান জানান।

সভাপতির বক্তব্যে চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম বলেন, সাতই মার্চের ভাষণ মুক্তির মহাকাব্য। বাঙালির স্বাধীন রাষ্ট্রগঠনের আকাঙ্খার অভিব্যক্তি সাতই মার্চের ভাষণ। বঙ্গবন্ধু যে স্বাধীন দেশ আমাদের উপহার দিয়েছেন তা রক্ষা ও উন্নয়নের করতে দল-মত নির্বিশেষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।

বর্ণিল আয়োজনে ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ জাতীয় দিবস উদযাপন শুরু হয় বাটালি হিলস্থ  নগর ভবন প্রাঙ্গণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে পুস্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে।

পুস্পস্তবক অর্পণ ও সভায় অংশনেন প্যানেল মেয়র মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন, আফরোজা কালাম, কাউন্সিলর আবদুস সালাম মাসুম, সলিমুল্লাহ বাচ্চু, আবুল হাসনাত বেলাল, মোঃ শেখ জাফরুল হায়দার চৌধুরী, আব্দুল মান্নান, চসিক সচিব খালেদ মাহমুদ, প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম, প্রধান শিক্ষা কর্মকর্তা লুৎফুন নাহার, মেয়রের একান্ত সচিব ও প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা মুহাম্মদ আবুল হাশেমসহ চসিকের বিভাগীয় ও শাখা প্রধান সহ  সিবিএ সভাপতি ফরিদ আহমদ, সাধারণ সম্পাদক মো. মুজিবুর রহমান, সিনিয়র সহ সভাপতি জাহিদুল আলম চৌধুরী, সহ-সভাপতি মোহাং ইয়াছিন চৌধুরী, যুগ্মসাধারণ সম্পাদক বিপ্লব কুমার চৌধুরী, সাংগঠনিক সম্পাদক মো. আবুল মাসুদ উপস্থিত ছিলেন।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানের (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বিশাল জনসমাবেশে বঙ্গবন্ধু  শেখ মুজিবুর রহমানের যুগান্তকারী ভাষণের স্মারক হিসেবে দিনটি অবিস্মরণীয় হয়ে আছে। এবারের সাতই মার্চের আয়োজনে আরো থাকছে  গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার মোড় ও আইল্যান্ডে বঙ্গবন্ধুর ছবি-ইতিহাস সংবলিত ৪টি ড্রপ ডাউন ব্যানার প্রদর্শন, আন্দরকিল্লা পুরানো নগর ভবন পার্কিং লট ও জামালখানে এল.ই.ডি’র  মাধ্যমে ৭ই মার্চের ভাষণ প্রচার, নগর ভবন ও গুরুত্বপূর্ণ স্থান সমূহে আলোকসজ্জা, ফোয়ারা এবং তোরণ নির্মাণ। এছাড়া মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহে ৭ই মার্চ এর ভাষণের উপর প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে।

উল্লেখ্য, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী নিজস্ব রাজনীতির ধারার তিনজন ছাত্রনেতা ১৯৬২ সালে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে গোপন সংগঠন ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ গঠন করেন। তিন সদস্যের এই ক্ষুদ্র সত্তা পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশের ‘নিউক্লিয়াস’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। নিউক্লিয়াসের তিনজন সদস্য ছিলেন সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমেদ। নিউক্লিয়াসের কাজ ছিল, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের লক্ষ্যে যাবতীয় নীতি-কৌশল প্রণয়ন করা এবং স্বাধিকার আন্দোলনকে সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধের দিকে নিয়ে যাওয়া। স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের সর্বময় কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা ছিল এই তিন ছাত্রনেতার কাছে। দেশের ছাত্র আন্দোলনের প্রতিটি কর্মসূচি বিশেষত শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ঘোষিত ছয় দফা, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের এগারো দফার আন্দোলনসহ প্রতিটি আন্দোলনকে গণরূপদানের মাধ্যমে স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গড়ে তোলা। একইসাথে জাতিকে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত করা ছিল নিউক্লিয়াসের অন্যতম কাজ। মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তৈরি, ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পতাকা উত্তোলন, ৩ মার্চ স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ, জাতীয় সঙ্গীত নির্বাচন, জয়বাংলা বাহিনী গঠন এবং তার কুচকাওয়াজ ও শেখ মুজিবুর রহমানকে সামরিক অভিবাদন জানানো, সবই ছিল স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার অংশ। বিপ্লবী পরিষদের সকল কর্মকান্ডের প্রতি শেখ মুজিবুর রহমানের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সমর্থন ছিল। শরীফ শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে বাষট্টি সালে গড়ে ওঠা ছাত্র আন্দোলন, শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ঘোষিত বাঙালির মুক্তির সনদ ছেষট্টির ছয় দফার আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের সাধারণ নির্বাচন, ৭ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষন, শেখ মুজিবুর রহমানকে আনুষ্ঠানিকভাবে বঙ্গবন্ধু উপাধি প্রদান, নিউক্লিয়াস’র সিদ্ধান্ত অনুযায়ী স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তৈরি, আনুষ্ঠানিকভাবে পতাকা উত্তোলন, স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ সর্বোপরি বাঙালির স্বাধীনতা যুদ্ধসহ এ সকল কর্মকান্ডই ছিলো ‘নিউক্লিয়াস’ বা ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার অংশ। আর এ সকল কর্মসূচির পরিকল্পনা প্রণীত হতো নিউক্লিয়াসের মাধ্যমে।