বরিশালে প্রসবজনিত ফিস্টুলা সার্জারি শুরু করল হোপ ফাউন্ডেশন

বরিশালের শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজে বহুপ্রতীক্ষিত প্রসবজনিত ফিস্টুলা সার্জারি শুরু হয়েছে। অলাভজনক স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান হোপ ফাউন্ডেশনের সিনিয়র সার্জন ও ফিগো (FIGO) স্বীকৃত অ্যাডভানস লেভেলের ফিস্টুলা সার্জন ডা. নৃন্ময় বিশ্বাসের নেতৃত্বে হোপ ফিস্টুলা টিম
সম্প্রতি শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজে সাফল্যের সাথে ফিস্টুলা সার্জারি করেছেন। এই কাজে সার্বিক সহযোগিতা করছেন মেডিকেল কলেজের গাইনি বিভাগের প্রধান ডা. খুরশিদ জাহান। এখন থেকে হোপ ফাউন্ডেশন নিয়মিত বরিশালে ফিস্টুলা সার্জারি করবে। হোপ ফাউন্ডেশন শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজের সাথে যৌথভাবে একটি কর্মশালারও আয়োজন করে।
শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজের গাইনি বিভাগের প্রধান ডা. খুরশিদ জাহানের সভাপতিত্বে কর্মশালায় উপস্থিত ছিলেন বিএমএ’র বরিশাল শাখার সভাপতি ডা. মো. ইশতিয়াক হোসেন, শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. জামাল সালেহ উদ্দিন, শরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. এইচ এম সাইফুল ইসলাম, ডা. মো. মনিরুজ্জামান শাহিন, অধ্যাপক ডা. শিখা সাহা, ডা. হাওয়া আক্তার জাহান, অধ্যাপক ডা. মৃন্ময় বিশ্বাস, ডা, মো. আকবর হোসেন প্রমুখ। এতে শেরেবাংলা মেডিকেলের মোট ৪৮ জন ডাক্তার অংশগ্রহণ করেন।
যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. ইফতিখার মাহমুদ বাংলাদেশের গ্রামীণ জনগোষ্ঠী বিশেষ করে নারী ও শিশুদের মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের লক্ষ্যে ১৯৯৯ সালে হোপ ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংস্থার প্রধান উদ্দ্যেশ্য হলো অবহেলিত মা এবং শিশুদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা। মা ও শিশুদের মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের লক্ষ্যে কক্সবাজারে হোপ হাসপাতাল এবং উপকূলীয় অঞ্চলে ছোট ছোট হোপ স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপন করে। প্রতিষ্ঠানটি দীর্ঘ ২৩ বছর চট্টগ্রাম বিভাগে বিশেষ করে কক্সসবাজার জেলায় নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
হোপ ফাউন্ডেশন ২০১০ সালে ফিস্টুলা কার্যক্রমের সূচনা করে। বর্তমানে হোপ ফাউন্ডেশনের প্রসবজনিত ফিস্টুলা কার্যক্রম দেশের বিশাল অংশে মায়েদের প্রসবজনিত ফিস্টুলা চিকিৎসা সম্পুর্ণ বিনামূল্যে প্রদান করে যাচ্ছে।

ডা. ইফতিখার মাহমুদ বলেন, হোপ ফাউন্ডেশন চট্টগ্রাম বিভাগে ফিস্টুলা নিয়ে কাজ করছে এক দশকের বেশি এবং এখন পর্যন্ত প্রায় আটশত ফিস্টুলা সার্জারি করেছি। কিন্তু বর্তমানে বরিশাল বিভাগে ফিস্টুলা নিয়ে কাজ না হওয়ার কারণে এই অঞ্চলের বৃহৎ জনগোষ্ঠী ফিস্টুলা চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত ছিলেন। সম্প্রতি আমরা বরিশাল বিভাগে হোপ ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম সম্প্রসারণ করেছি। আমাদের লক্ষ্য হলো বারিশাল বিভাগেও অবহেলিত মা এবং তাদের শিশুদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার পাশাপাশি ফিস্টুলামুক্ত করা। বরিশাল বিভাগের ৬টি জেলায় কার্যক্রম সম্প্রসারিত করে হোপ ফাউন্ডেশন কাজ করে যাবে বলে জানান ডা. ইফতিখার মাহমুদ।
প্রসবজনিত ফিস্টুলা একটি ক্ষত যেটা প্রজনন অঙ্গ এবং মূত্রাশয় এবং/অথবা মলদ্বারের মধ্যে একটা গর্তেও সৃষ্টি করে, এর ফলে অনবরত প্রস্রাব/পায়খানা নির্গত হয়। এটা সাধারণত হয় গ্রাম অঞ্চলের দরিদ্র গর্ভবতী মায়েদের। বাঁধাগ্রস্ত বাচ্চা প্রসবের ফলে অনেক সময় প্রজনন অঙ্গের বিভিন্ন স্থানে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ফলে প্রসব পথের বিভিন্ন অংশ পচেঁ ফিস্টুলার সৃষ্টি হয়। ফিস্টুলা একটি অত্যন্ত শারীরিকভাবে বেদনাদায়ক, মানসিকভাবে ক্ষতিকর ব্যাধি। অনবরত মূত্র এবং মল ঝরার কারণে ফিস্টুলা আক্রান্ত মায়েরা শারীরিকভাবে স্বামীর সাথে সম্পর্ক রাখতে অক্ষম এবং তাদের শরীরে সারাক্ষণ প্রচ- দুর্গন্ধ থাকে। প্রায় সব ক্ষেত্রে তাদের স্বামী তাদের পরিত্যাগ করে, এমনকি উনারা বাবা/মা বা অন্যান্য নিকট আত্মীয়দের কাছেও আশ্রয় পান না। সমাজের প্রত্যেক স্তরেই তারা নিগৃহীত হন।
বাংলাদেশ সরকার ইউএনএফপিএ (টঘঋচঅ) বাংলাদেশ এর টেকনিক্যাল সহায়তায় টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার সাথে সামঞ্জস্য রেখে ২০৩০ সালের মধ্যে দেশকে ফিস্টুলা মুক্ত করার একটি বড় উদ্যোগ নিয়েছেন। এরই ধারাবাহিকতায় হোপ ফাউন্ডেশন চট্টগ্রাম বিভাগের ১১টি জেলার ফিস্টুলা মুক্ত করার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছে এবং বর্তমানে একটি ১০০ বেডের নতুন মেটারনিটি ও ফিস্টুলা হাসপাতাল নির্মাণের কাজ করছে যেখানে ফিস্টুলা সার্জারির পাশাপাশি দেশি-বিদেশী চিকিৎসকদেরকে ফিস্টুলা অপারেশনের বিশেষায়িত ট্রেনিং প্রদান করা হবে।
ফিস্টুলা অপারেশন করে ভুক্তভোগী মায়েদের সুস্থ করার পাশাপাশি অবশ্যই প্রতিরোধের দিকেও নজর দিতে হবে। এই লক্ষ্যে মানসম্মত মাতৃত্ব স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে সার্বজনীনভাবে। সকল মায়েরা, তারা যেখানেই থাকেন না কেন, একজন দক্ষ মিডওয়াইফ দিয়ে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে যাতে করে সব মেয়েরা গর্ভকালীন সেবা, নিরাপদ প্রসব এবং প্রসবোত্তর সেবা পান। বাংলাদেশে পর্যাপ্ত পরিমাণ মিডওয়াইফ প্রশিক্ষিত করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ওনাদের কাজের ব্যবস্থা করলেই একমাত্র সার্বজনীন মাতৃস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা সম্ভব। হোপ ফাউন্ডেশন মিডওয়াইফারি ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার মধ্যমে এ কাজটিও সফলতার সাথেও করে যাচ্ছে।
ডা. ইফতিখার মাহমুদ আরও বলেন, আমরা অত্যন্ত গর্বের সাথে বলতে পারি, বাংলাদেশ সরকার মাতৃস্বাস্থ্যে অসাধারণ অগ্রগতি সাধন করেছে এবং এই কৃতিত্বের জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করেছে। এখন সরকারি, বেসরকারি সংস্থাসহ সবার সহযোগিতা এবং সম্মিলিত প্রচেষ্ঠায় দেশের সমস্ত ফিস্টুলা রোগীকে চিকিৎসার আওতায় এনে ২০৩০ সালের মধ্যে দেশকে ফিস্টুলা মুক্ত করা সময়ের দাবি। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ২০ হাজার রোগী ফিস্টুলায় আক্রান্ত হয়ে আছেন। ২০৩০ সালের মধ্যে সবাইকে চিকিৎসার আওতায় আনায় জন্য আমাদের সবাইকে একযোগে কাজ করে যেতে হবে। এ ব্যাপারে হোপ ফাউন্ডেশন সবার প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়াতে সর্বদা প্রস্তুত।