বাধা বিপত্তি ডিঙিয়ে রাজশাহীতে বিএনপি’র নেতাকর্মীরা

বাস চলাচল বন্ধ। ধর্মঘটের আওতায় সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও থ্রি-হুইলারও। কার্যত সারা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন রাজশাহী। দুর্ভোগে সাধারণ মানুষ। পথে পথে বাধা বিপত্তি। বিভিন্ন পয়েন্টে চেকপোস্ট। পুলিশের কড়া নজরদারি। এর মধ্যেও রাজশাহী শহরে জড়ো হয়েছেন হাজার হাজার বিএনপি নেতাকর্মী। আজ রাজশাহীতে বিএনপি’র বিভাগীয় গণসমাবেশ। নগরীর ঐতিহাসিক মাদ্রাসা মাঠে দলীয় নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে নির্দেশনামূলক বক্তব্য রাখবেন কেন্দ্রীয় নেতারা।

তবে সমাবেশ সফল করতে ২/৩ দিন আগেই রাজশাহী পৌঁছেছেন বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার নেতাকর্মীরা। সমাবেশস্থলে ঢুকতে না পেরে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় ও পার্শ্ববর্তী ঈদগাহ মাঠে তাঁবু বানিয়ে সেখানে অবস্থান করেছেন তারা। কেউ কেউ গত কয়েকদিন সেই মাঠেই রাত্রিযাপন করেছেন। এদিকে গতকাল রাতেই ঈদগাহ মাঠ কানায় কানায় ভরে গেছে। বিভিন্ন জেলা থেকে আসা মানুষের ঢল নেমেছে নগরীর অলিগলিতে। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে বিভিন্ন জেলা থেকে আসা সাধারণ মানুষের চাপ। এসব মানুষের একটি বড় অংশ শ্রমজীবী। নানা দাবি দাওয়া নিয়ে বিএনপি’র বিভাগীয় সমাবেশে অংশ নিয়েছেন তারা।
সমাবেশে অংশ নিতে নানা বাধা বিপত্তি অতিক্রম করেছেন এসব মানুষ। কেউ পায়ে হেঁটে, কেউ মোটরসাইকেল, মালবাহী ট্রাকে করে পথ ভেঙে ভেঙে রাজশাহী শহরে পৌঁছেছেন। অনেকেই ছোট ছোট নৌকায় করে পদ্মা পাড়ি দিয়ে এসেছেন। এদিকে সমাবেশকে ঘিরে পোস্টার ফেস্টুনে ছেয়ে গেছে রাজশাহী নগরী। মিছিল আর বিভিন্ন স্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠেছে রাজশাহীর সমাবেশস্থল ও তার আশপাশের এলাকা। শহরের প্রবেশ মুখ নগরীর আমচত্বর, স্টেশন, রেলগেট, কাটাখালী, তালাইমারী হয়ে মিছিল নিয়ে সমাবেশস্থলে হাজির হয়েছেন নেতাকর্মীরা। রাজশাহী বিএনপি’র সমাবেশ সামনে রেখে ১লা ডিসেম্বর থেকে শুরু হয়েছে পরিবহন ধর্মঘট। এতে সমাবেশে যোগ দিতে আসা নেতাকার্মীরা ভোগান্তিতে পড়েছে। গণপরিবহন বন্ধের পর গতকাল দুপুর থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও থ্রি-হুইলার ধর্মঘট শুরু হয়েছে। এতে বিএনপি’র নেতাকর্মীদের সঙ্গে ভোগান্তির শিকার হয়েছেন সাধারণ মানুষও। চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে। বিএনপি নেতারা বলছেন, গণসমাবেশকে কেন্দ্র করে প্রশাসনের চাপে এ ধর্মঘট ডেকেছেন সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও থ্রি-হুইলার মালিকরা।

সরকার ধর্মঘট দিয়ে বাস বন্ধ করেছে। এতে ছোট ছোট যানবাহনে করে সমাবেশে আসতে শুরু করে নেতাকর্মীরা। রাজশাহীর সমাবেশে জনস্রোত নামতে শুরু করেছে। এতে সরকারের টনক নড়ে উঠেছে। বাস বন্ধের পর সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও থ্রি-হুইলারও বন্ধ করে দিয়েছে। রাজশাহী মহানগর বিএনপি’র আহ্বায়ক এরশাদ আলী ঈশা অভিযোগ করেন, তাদের নেতাকর্মীদের সমাবেশে আসতে পথে পথে বাধা দেয়া হচ্ছে। কিন্তু নেতাকর্মীদের আসা বন্ধ করা যাচ্ছে না। এরই অংশ হিসেবে একটার পর যানবাহন ধর্মঘট ডাকা হচ্ছে। তবে মানুষের স্রোত ঠেকানো যাবে না। মানুষ পায়ে হেঁটেও আসছে। গতকাল দুপুরে ঈদগাহ মাঠে সরজমিন দেয়া যায়, সমাবেশে আসা হাজার হাজার নেতাকর্মীর জন্য সকাল থেকে রান্না করা হচ্ছে। মাছ, গরুর মাংস, খাসির মাংস, সবজিসহ নানা রকমের খাবার রান্না করা হয়। এজন্য অস্থায়ীভাবে ক্যাম্প তৈরি করা হয়েছে। গত বৃহস্পতিবারই ইদগাহ মাঠটি ভরে গেছে তাঁবুতে। পদ্মা নদীর পাড়ে অবস্থিত বিশালকার এ মাঠটি জুড়ে গড়ে তোলা হয়েছে অন্তত দুই শতাধিক তাঁবু। মাঠে জায়গা না পেয়ে আশেপাশের সড়কগুলোতে ভিড় করছেন নেতাকমীরা।

ঈদগাহ মাঠ ঘিরে সেখানে গড়ে উঠেছে অস্থায়ী দোকানপাট। রাস্তার পাশের দোকান থেকে চা-সিগারেট, পানসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র কিনে খাচ্ছেন তারা। আবার কেউ কেউ তাঁবুর ভিতরে বসেই কার্ড খেলে সময় পার করছেন। অনেকেই পৃথক পৃথকভাবে জড়ো হয়ে মিছিল করছেন। কোথাও ভাত, তরকারি, কোথাও বিরিয়ানি, আবার কোথাও খিঁচুড়ি রান্না হচ্ছে। বিএনপি নেতাকর্মীরাই নিজেদের মতো করে উৎসবমুখোর পরিবেশে রান্নায় ব্যস্ত সময় পার করছেন। এর আগে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে যুবদল নেতা সুলতান সালাহউদ্দিন টুকুকে ঘিরে পাবনার নেতাকর্মীরা মিছিল বের করে। এর কিছুক্ষণ পরেই কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের নেতারা মোটরসাইকেল বহর নিয়ে মিছিল করতে করতে ঈদগাহ মাঠে এসে পৌঁছান। বিএনপি’র গণসমাবেশ সমন্বয় কমিটির আপ্যায়ন উপ-কমিটির যুগ্ম-আহ্বায়ক ও মহানগর বিএনপি’র যুগ্ম আহ্বায়ক শাফিকুল ইসলাম শাফিক বলেন, নেতাকর্মীদের বিশ্রামের জন্য দুইশ’র বেশি তাঁবু টানানো হয়েছে। এ ছাড়াও তাদের খাওয়ানোর জন্য প্রায় ৪০টি চুলা করা হয়। সেগুলোতে রান্না হচ্ছে। গতকাল রাতে সমাবেশস্থল ঘুরে দেখা যায়, মঞ্চ তৈরির কাজ শেষ হয়েছে। মাঠের মধ্যে অবস্থান করছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। বিএনপি’র কোনো নেতাকর্মীদের মাঠে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। এর আগে বিএনপি’র দেশের ৮টি বিভাগীয় শহরে গণসমাবেশ হলেও এমন পরিস্থিতি হয়নি। তবে সমাবেশস্থলের বাহিরে নেতাকর্মীদের মিছিল করতে দেখা গেছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কয়েকজন সদস্য বলেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতেই কঠোর অবস্থানে রয়েছেন তারা। নির্ধারিত সময়ের আগে কাউকে ঢুকতে দেয়া হবে না। এই সমাবেশ ঘিরে ৩ স্তরের নিরাপত্তা বাহিনী মাঠে অবস্থান নিয়েছে। রাজশাহীতে বিএনপি’র সমাবেশের জন্য ১লা ডিসেম্বর থেকে রাজশাহী নগরের ঐতিহাসিক মাদ্রাসা মাঠ ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে পুলিশ। পরিবহন ধর্মঘট ও নানান ধরনের প্রতিবন্ধকতা এড়াতে নির্ধারিত সময়ের আগেই আসা বিভাগের বিভিন্ন জেলার নেতাকর্মীদের বিশ্রাম ও রাত যাপনের জন্য সোমবার থেকে সমাবেশস্থলে সামিয়ানা তৈরির কাজ করলেও মঙ্গলবার তা ভেঙে দিয়েছে পুলিশ। চাপাই নবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ থেকে আসা আব্দুল লতিফ বলেন, বৃহস্পতিবার রাজশাহীতে এসেছি। সমাবেশস্থলে পুলিশ ঢুকতে দেয়নি। মাঠে তাঁবুতে আশ্রয় নিয়েছি। সরকার বাস বন্ধ করে দিয়েছে। তবুও মানুষ সমাবেশের জন্য আসছে। কষ্ট করে আসছে। এই সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত আমরা আন্দোলন করে যাবো। জয়পুরহাটের আমদই এলাকার আবুল বলেন, চাল ডাল সবকিছুর দাম বেশি। সরকার ঠিকমতো দেশ চালাতে পারছে না। কোটি কোটি টাকা পাচার করে দেশের বাইরে নিচ্ছে। অথচ দেশের মানুষ আজ কষ্টে আছে। দেশে নতুন সরকার চাই। নেতাকর্মীরা অভিযোগ করেন, সমাবেশকে কেন্দ্র করে পথে পথে তল্লাশি চালাচ্ছে পুলিশ। রাজশাহীর বিভিন্ন প্রবেশদ্বার থেকে শুরু করে রাজশাহী রেল স্টেশনেও পুলিশ তল্লাশি করেছে।

তল্লাশি করতে গিয়ে সমাবেশে আসা নেতাকর্মীদের হয়রানি করছে পুলিশ। আবার অনেককেই রাজশাহী শহরে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। রাজশাহীর প্রবেশ মুখ থেকে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। গত বুধবার থেকে পুলিশ এই অবস্থা চালাচ্ছে বলে দাবি বিএনপি নেতাদের। গতকাল দুপুরে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মিজানুর রহমান মিনু জানান, পুলিশি বাধা এবং হয়রানি উপেক্ষা করে এরই মধ্যে লাখো নেতাকর্মী রাজশাহী শহরে প্রবেশ করেছেন। অনেকেই রাজশাহী ঐতিহাসিক মাদ্রাসা মাঠের পাশে ঈদগাহ মাঠে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। বাধা দিয়ে হয়রানি করে বিএনপি নেতাকর্মীদের সমাগম ঠেকানো যাবে না। তিনি বলেন, ঈদগাহ মাঠে নেতাকর্মীদের থাকার জন্য তাঁবু টানানোর ব্যবস্থা করা হলেও পুলিশ প্রথমদিকে তাতেও বাধা দেয়। ফলে অনেক নেতাকর্মীকে রাতে খোলা আকাশের নিচে কাটাতে হয়েছে। এদিকে, রাজশাহী-নাটোর মহাসড়কের পুঠিয়া, বেলপুকুর, কাটাখালী ও তালাইমারী, রাজশাহী-নওগাঁ মহাসড়কের মোহনপুর, নওহাটা ও নওদাপাড়া এবং রাজশাহী-চাঁপাই নবাবগঞ্জ মহাসড়কের গোদাগাড়ী ও কাশিয়াডাঙ্গা মোড়ে পুলিশের বিশেষ চেকপোস্ট বসানো হয়েছে।

মেট্রোপলিটন পুলিশের মুখপাত্র ও অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার রফিকুল আলম বলেন, নগরীর প্রবেশদারগুলোতে নিয়মিত চেকপোস্ট। বিএনপি’র সমাবেশ ঘিরে যেকোনো অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে নজরদারি ও তল্লাশি বাড়ানো হয়েছে। তবে হয়রানি ও অনেককে ফিরিয়ে দেয়ার অভিযোগ সঠিক নয় বলে জানান তিনি। এদিকে প্রায় ৫ হাজার মোটরসাইকেল নিয়ে রাজশাহী সমাবেশস্থলে পৌঁছেছেন বগুড়া জেলার বিএনপি নেতাকমীরা। গতকাল বিকালে মোটরসাইকেলের বহর নিয়ে বিভিন্ন স্লোগান দিয়ে আসেন তারা। এ সময় ৬ জন নেতাকর্মী আহত হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন জেলা থেকে বিচ্ছিন্নভাবে আরও ১০ হাজারের অধিক মোটরসাইকেল নিয়ে রাজশাহী আসেন দলীয় নেতাকর্মীরা।