তেল-চিনির দাম বাড়লো, চাল-আটার বাজারে অস্থিরতা

নিত্যপণ্যের বাজার স্থিতিশীল রাখতে সরকারের পক্ষ থেকে চাল, চিনি, আটা এবং ভোজ্য তেলের মতো প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম কমানোর জন্য বিভিন্ন প্রচেষ্টা সত্ত্বেও বাজারে এসব পণ্যের দাম বেড়েছে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে রাজধানীতে চাল, আটা, মসুর ডাল, সয়াবিন তেল ও চিনির দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি ৩ থেকে ১০ টাকা। ওদিকে সয়াবিন তেল ও চিনির সংকটও চলছে। এমন পরিস্থিতিতে একসঙ্গে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য দুটির দাম বাড়ালো ব্যবসায়ীরা। বোতলজাত প্রতি লিটার সয়াবিন তেলের দাম ১২ টাকা বেড়ে হয়েছে ১৯০ টাকা। আর প্যাকেটজাত প্রতি কেজি চিনির দাম ১৩ টাকা বেড়ে হয়েছে ১০৮ টাকা। নতুন এই দাম গতকাল থেকেই কার্যকর হয়েছে। একইসঙ্গে সরকারিভাবে খোলাবাজারে বিক্রি (ওএমএস) করা আটার দামও বাড়ানো হয়েছে। খোলা আটার দাম প্রতি কেজিতে ৬ টাকা ও প্যাকেট আটার দাম কেজিতে সাড়ে ৪ টাকা বাড়ানো হয়েছে। আগামী রোববার থেকে বাড়তি দামে বিক্রি করা হবে।

ওদিকে দেশের বিভিন্ন জেলায় আমন ধান কাটা শুরু হয়েছে।
বাজারেও এসেছে সেই ধানের চাল। পাশাপাশি দেশে চালের মজুতও ভালো। আমদানিও হচ্ছে। এরপরও বাজারে দাম কমার কোনো প্রভাব নেই। বরং রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলার বাজারগুলোতে মাঝারি ও মোটা চালের দাম গত সপ্তাহের তুলনায় কেজিতে ২ থেকে ৩ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, আগামী বছরের বিশ্বমন্দাকে পুঁজি করে একটি অসাধু চক্র এখন থেকেই চালসহ নিত্যপণ্যের দাম বাড়াতে শুরু করেছে। যাতে ওই সময় মুনাফার জন্য দাম বাড়াতে না হয়। এজন্য সংশ্লিষ্ট তদারকি সংস্থাকে এখন থেকেই নজরদারি বাড়াতে পরামর্শ দিয়েছেন তারা। ধান-চালের ব্যবসায়ীরা বলছেন, জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ ও সারের দাম বেশি থাকায় ধানের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। ফলে ধানের দামও গত বছরের তুলনায় এ বছর প্রতি মণে প্রায় ২০০ টাকা বেশি। যে কারণে আমন ধান ওঠার মৌসুম হলেও চালের দাম না কমে বরং বেড়েছে। বাজারে আমদানি করা চালের কারণেও দাম কমছে না। অন্যদিকে, সরকার চাচ্ছে ধানের ভালো দামের মাধ্যমে কৃষক লাভবান হোক।

এদিকে প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ১২ টাকা বেড়ে হয়েছে ১৯০ টাকা। আর প্যাকেটজাত চিনির দাম প্রতি কেজিতে ১৩ টাকা বেড়ে হয়েছে ১০৮ টাকা। নতুন এই দাম গতকাল থেকে কার্যকর হয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ভোজ্য তেল পরিশোধন কারখানার মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স এসোসিয়েশন বুধবার সয়াবিন তেলের দাম বৃদ্ধির এই সিদ্ধান্ত মন্ত্রণালয়কে আনুষ্ঠানিকভাবে জানায়। একইভাবে চিনির দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত জানিয়েছে চিনি পরিশোধনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স এসোসিয়েশন। এর আগে দাম কমার মাত্র এক মাসের মাথায় বোতলজাত ও খোলা সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ১৫ টাকা করে বাড়ানোর প্রস্তাব করেছিলেন বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স এসোসিয়েশন। গত ২রা নভেম্বর তারা প্রস্তাবটি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠান। এর ১৫ দিনের মাথায় বৃহস্পতিবার দাম বাড়ানোর ঘোষণা এলো।

নতুন দাম অনুযায়ী, এখন থেকে ১ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আগে এই তেলের দাম ছিল ১৭৮ টাকা। এ ছাড়া ৫ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম বেড়ে হয়েছে ৯২৫ টাকায়। এত দিন দাম ছিল ৮৮০ টাকা, তার মানে নতুন করে দাম বেড়েছে ৪৫ টাকা। অন্যদিকে খোলা সয়াবিনের দাম লিটারে ১৪ টাকা বাড়ানো হয়েছে। এতে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেলের নতুন দাম ১৭২ টাকা। এত দিন প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি হয়েছে ১৫৮ টাকায়। প্রতি লিটার খোলা পাম তেল বিক্রি হচ্ছে ১২১ টাকায়। এদিকে প্রতি কেজি প্যাকেটজাত চিনি ১০৮ টাকায় বিক্রির সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর আগে চিনির দাম ছিল ৯৫ টাকা। বেশ কিছুদিন আগেই বাজারে চিনির দাম শতক ছাড়িয়েছে। বাজারে চিনির সংকটও দেখা দেয়। নতুন এই দর অনুযায়ী ৫০ কেজি চিনির বস্তার দাম হবে ৫ হাজার ১০০ টাকা। এ ক্ষেত্রে প্রতি কেজি চিনির দাম পড়বে ১০২ টাকা।

সরজমিন কৃষি মার্কেট: সরজমিন রাজধানীর কৃষি মার্কেট ঘুরে দেখা গেছে, বাজারে আটার সংকটে ভুগছেন ব্যবসায়ীরা। আটা ও ময়দার বাজার নিয়ে চিন্তিত ব্যবসায়ীরা। সব দোকানে মিলছে না আটা। সিটি গ্রুপের কোনো আটা বাজারে না পাওয়া গেলেও বসুন্ধরা গ্রুপের ২ কেজি আটার প্যাকেট রয়েছে। হেলাল এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মাসুদ হাসান বলেন, আমার কাছে বসুন্ধরা গ্রুপের আটা রয়েছে। দুই কেজির প্যাকেট ১৪২ টাকায় বিক্রি করছি। সিটি গ্রুপের আটা অনেকদিন ধরেই বাজারে নেই। তবে এই আটার দর একটু কম ছিল। ১৩২ টাকায় বিক্রি করতাম। কৃষি মার্কেটে প্রতি ৫০ কেজি ময়দার বস্তা বিক্রি হচ্ছে ২৮০০ টাকায়। এর আগে ময়দার বস্তা ছিল ২৭০০ টাকা। দাম বেড়ে হয়েছিল ৩৬০০ থেকে ৩৭০০ টাকা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, আমরা এর আগে ৩৬০০ থেকে ৩৭০০ টাকা দিয়ে ময়দার বস্তা কিনে রেখেছিলাম এখন তার কি হবে? কেউ তো বেশি দামে কিনতে চায় না।

তাই লোকসান দিয়েই বিক্রি করতে হচ্ছে। চালের বাজারে মিনিকেট, নাজিরশাইল ও আটাশ চালের দাম প্রতি কেজিতে ৩ টাকা করে বেড়েছে। কৃষি মার্কেটের ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম বলেন, গত সপ্তাহেও ৭১ টাকা কেজি মিনিকেট চাল বিক্রি করেছি। এখন তা বেড়ে হয়েছে ৭৫ টাকা। ৮০ টাকা কেজির নাজিরশাইল চাল বেড়ে হয়েছে ৮৫ টাকা। ৫৭ টাকা কেজির আটাশ চাল বেড়ে হয়েছে ৬০ টাকা। কাওরান বাজারের আল্লাহর দান রাইস এজেন্সির মালিক সিদ্দিকুর রহমান বলেন, মিল পর্যায়ে ৩-৪ টাকা কেজিতে চালের দাম বাড়ানো হয়েছে। তবে তা অযৌক্তিক। কারণ আমন ধান কৃষকের গোলা থেকে বাজারেও আসতে শুরু করেছে। এমন পরিস্থিতিতে চালের দাম বাড়ার কথা নয়। মিলাররা সব সময় অজুহাত খোঁজে। তারা কোনো সময় ধানের দাম বেশি বলে চালের দাম বাড়ায়। এবার তারা বলছে, উৎপাদন খরচ বেড়েছে তাই চালের দাম বাড়াতে হয়েছে। তবে তারা আগামী বছরের বিশ্বমন্দাকে পুঁজি করছে। এখন থেকেই দাম বাড়াতে শুরু করেছে। যাতে ওই সময় দাম বাড়াতে না হয়।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তথ্যমতে, দেশে সরকারিভাবে খাদ্যশস্যের মজুত আছে ১৬ লাখ ৯ হাজার ৩৭২ টন। এর মধ্যে চালের সরকারি মজুত আছে ১৩ লাখ ৭৫ হাজার ৩৫৩ টন। ধান আছে ৮ হাজার ৯৩৬ টন। আর গমের মজুত ২ লাখ ২৮ হাজার ২১১ টন। ক্যাব’র সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, দেশে এ মুহূর্তে চালের মজুত ভালো। তার মধ্যে আমন মৌসুম। এখন চালের দাম বাড়ার কথা নয়। আর চাল দেশের মানুষের প্রধান খাবার। এ ছাড়া বাজারে সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম বাড়তি। এমন পরিস্থিতিতে চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষের কষ্ট আরও বাড়বে। সরকারকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখতে বাজারে সরবরাহ চেইন উন্নত করতে হবে। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, আমনের ভরা মৌসুমে কেন দাম বাড়লো তা খতিয়ে দেখা হবে।

মিল থেকে শুরু করে পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে তথ্য নিয়ে কারা কারসাজির সঙ্গে জড়িত তা বের করে শাস্তির আওতায় আনা হবে। এবার বাড়লো সরকারিভাবে খোলাবাজারে বিক্রি (ওএমএস) করা আটার দামও। খোলা আটার দাম প্রতি কেজিতে ৬ টাকা ও প্যাকেট আটার দাম কেজিতে সাড়ে ৪ টাকা বাড়ানো হয়েছে। আগামী রোববার থেকে প্রতি কেজি খোলা আটা ভোক্তা পর্যায়ে ২৪ টাকায় বিক্রি হবে। এখন প্রতি কেজি খোলা আটার দাম ১৮ টাকা। অন্যদিকে দুই কেজি প্যাকেটের আটা বিক্রি হবে ৫৫ টাকায়, এখন যার দাম ৪৬ টাকা। ফলে প্যাকেটের আটা প্রতি কেজিতে বাড়ছে সাড়ে ৪ টাকা। সরকারি বাণিজ্য সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ-টিসিবি’র বৃহস্পতিবারের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা মহানগরীতে খোলা ও প্যাকেট আটা-ময়দা কেজি প্রতি বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৮০ টাকায়।