রাসূলুল্লাহ্’র স্মৃতিবিজড়িত অপূর্ব পুণ্যভূমি তায়েফ …

মির্জা মুহাম্মদ ইমতিয়াজ :: রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর স্মৃতিবিজড়িত ‘ঐতিহাসিক ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি’ এক কথায় অপূর্ব পুণ্যভূমি তায়েফ। মক্কা নগরী থেকে প্রায় ১২০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে শহর পুণ্যভূমি তায়েফ। উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৬ হাজার ফুট উপরের চমৎকার সাজানো-গোছানো শহর। পুরো শহরটিই গড়ে উঠেছে পাহাড়ের চূড়ায়।সবকিছু অসম্ভব সুন্দর ৷ এক কথায় অনন্য, অসাধারণ, অপূর্ব।
নিজের চোখে প্রাকৃতিক অপূর্ব সুন্দর দৃশ্য অনেক সময় বিশ্বাস করতে করতে অবাক লাগে তাই পর্যটকদের কাছে তায়েফ খুবই প্রিয়। অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়, মুগ্ধতায় এর সৌন্দয্য শুধু উপভোগের…
উঁচু উঁচু পাথুরে পাহাড়কে সাথে মিতালী করে আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে জিএমসি জিপ গাড়িটি এগিয়ে চলছে। রাস্তাগুলো পাহাড়ের বুক চিরে তৈরি করা। এক পাশে উঁচু পাহাড় অন্য পাশে গভীর খাদ। পাথরের পাহাড় কেটে তৈরি করা হয়েছে অবাক করা প্রশস্ত সড়ক, সুরঙ্গ, দীর্ঘতম উড়াল সড়ক। বহু কিলোমিটারের মধ্যে কোনো বসতি নেই। শুধুই ধু ধু মরুভূমি। কোলাহলহীন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন শহর, চারপাশে নির্মল সবুজের হাতছানি। মক্কা থেকে প্রায় সোয়া এক ঘণ্টা সময় লাগে তায়েফ পৌছাতে। আবহাওয়া তাপমাত্রা মক্কায় যখন ৪০-৪২ তখন তায়েফে মাত্র ২৫-২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। মক্কা-মদিনার পর তায়েফ পবিত্রতার গুরুত্বের দিক থেকে তৃতীয়।
  
ঐতিহাসিক যুগের সাক্ষী তায়েফের প্রাচীন দুর্গগুলো বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পর্যটকদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। ইসলাম ও মুসলিম সভ্যতার বিস্ময়কর উদাহরণ হয়ে স্থাপত্যশিল্পের প্রাচীন দুর্গগুলো আজও টিকে আছে। দুর্গগুলোর দেয়ালে বিভিন্ন রঙিন নকশা তাদের কারুকর্মেরই প্রতিচ্ছবি। তায়েফের এ দুর্গগুলো আমার মন শীতল করেছে। ইতিহাসপ্রেমী যে কোনো পর্যটকের জন্যই তায়েফের এ ঐতিহাসিক প্রাচীন দুর্গগুলো দর্শন করা উচিত বলে আমি মনে করছি।
শহর থেকে প্রায় ৯৫ কিলোমিটার দূরে হুজুর সা:-এর দুধ মা হালিমার বাড়ি সাদিয়া তায়েফ অঞ্চলে। প্রথমেই হুজুর সা:-কে যে স্থানে সিনা চাক করা হয়েছিল। ওই স্থানে একটি বড়ই গাছ রয়েছে। অনেকেই বলেন, বড়ই গাছটা নাকি সেই থেকেই। পুরো অঞ্চলটাই বিশাল বিশাল পাহাড় ঘেরা। পাহাড়ের পাদদেশেই আবাদি জমি। এরপর চলে যাই মা হালিমা রা:-এর বাড়িতে। তেমন কিছু নেই। শুধু ঘরটা পাথর দিয়ে ঘেরাও করে রাখা হয়েছে। চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বড় বড় পাথর। এসব জায়গাতেই হুজুর সা:-এর শিশুকাল কেটেছে।
রবিশস্য ও নানান ফল-ফলাদির জন্য তায়েফ বিখ্যাত। তায়েফে উৎপন্ন আঙ্গুর, কমলা, আনার ইত্যাদি অতি দামী ফলফলাদি মিষ্টি ও পুষ্টিতে ভরপুর। বিশেষ করে তায়েফের আঙ্গুর বিখ্যাত। এছাড়া তায়েফে উৎপাদিত সবজি সৌদি আরবের চাহিদার প্রায় ৩০ ভাগ পূরণ করে। বিভিন্ন ফুলের মধ্যে গোলাপও বেশ চাষাবাদ হয়। গোলাপজল তৈরিতে তায়েফের গোলাপের বেশ খ্যাতি রয়েছে।
প্রাচীনকাল থেকে মক্কা ও তায়েফবাসীর মাঝে ব্যবসায়িক সম্পক ছিল। বিশিষ্ট সাহাবি হজরত আব্বাস (রা.)-এর সঙ্গে তায়েফের ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন। পরে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)তায়েফের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়ে যান। তায়েফের প্রধান মসজিদকে ইবনে আব্বাস মসজিদ বলা হয়। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)-এর কবর মসজিদ সংলগ্ন কবরস্থানে। এ কবরস্থানে আরও অনেক সাহাবির কবর রয়েছে। মসজিদ সংলগ্ন একটি লাইব্রেরি আছে। সেটা অবশ্য জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত নয়। তবে সেখানে প্রাচীন অনেক কিতাবের সংগ্রহ আছে।
মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর তায়েফ গমন
চাচা আবু তালিবের মৃত্যুর পর তিনি তায়েফে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর তায়েফ গমন ইসলামের ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে মহানবী (সা.) তায়েফে নির্যাতিত হন।
যত দিন পর্যন্ত আবু তালিব জীবিত ছিলেন, তত দিন কুরাইশরা হজরতকে প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে সাহস পায়নি। কিন্তু তার মৃত্যুর পর শত্রুদের অত্যাচার প্রবল আকার ধারণ করল। হজরত তবু মাতৃভূমি পরিত্যাগ করার কথা এক মুহূর্তের জন্যও চিন্তা করেননি। তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, এ বিশাল উপদ্বীপ একদিন ইসলামের সত্যালোকে উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে। তার অন্তরে দৃঢ়প্রত্যয় ছিল যে, তার শত্রুরাই একদিন তার অন্তরঙ্গ বন্ধু হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কুরাইশদের শত্রুতায় অতিষ্ঠ হয়ে হজরত (সা.) পালিত পুত্র জায়েদকে সঙ্গে নিয়ে তায়েফ গমন করলেন। মক্কা থেকে ৬০-৭০ মাইল উত্তরে তায়েফ একটি উর্বর শস্য শ্যামলা দেশ। তায়েফের বনি সাকিফ গোত্রের সঙ্গে হজরতের সম্পর্ক ছিল। বাল্যকালে এ গোত্রের মধ্যে তিনি লালিত-পালিত হয়েছিলেন। তিনি ১০ দিন যাবৎ তার ধর্মের বাণী তায়েফবাসীর কাছে পৌঁছাতে লাগলেন। কিন্তু কোনো আশাপ্রদ ফল লাভ হলো না। তায়েফবাসী হজরতের ওপর জঘন্য অত্যাচার করে তাকে শহর থেকে তাড়িয়ে দিল। তিনি যখন মক্কায় ফিরছিলেন, তখন তায়েফবাসী তাকে অনুসরণ করে প্রস্তরাঘাতে জর্জরিত করে তুলল। এভাবে তায়েফ থেকে প্রত্যাবর্তন করে হজরত মুহাম্মদ (সা.) যখন তার ভবিষ্যৎ ঘন অন্ধকারে আচ্ছন্ন দেখছিলেন, ঠিক সে সময় আরবের এক কোণ থেকে আশার ক্ষীণ রশ্মি দেখা দিল। হজের সময় এলো। ৬২০ খ্রিস্টাব্দে ইয়াসরিব (মদিনার পূর্ব নাম) থেকে আগত ছয়জন লোক হজরতের প্রতি আকৃষ্ট হলেন। হজরত মুহাম্মদের (সা.) খ্যাতি দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। সুতরাং ওই লোকগুলো তার বাণী শ্রবণ করার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠলেন। হজরত মুহাম্মদ (সা.) তাদের কাছে তার ধর্মমত ব্যাখ্যা করলেন এবং মক্কায় এর প্রচার করতে গিয়ে তিনি যেসব বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হয়েছেন, তা-ও তাদের কাছে প্রকাশ করলেন। তিনি এটা জানতে চাইলেন যে, তারা তাকে মদিনায় নিরাপদ আশ্রয় দিতে পারবেন কিনা। প্রত্যুত্তরে তারা জানালেন যে, তারা তার মতবাদ গ্রহণ করতে ইচ্ছুক; কিন্তু যেহেতু তারা নিজেরাই পরস্পর কলহে লিপ্ত, সে জন্য মুহাম্মদ (সা.)-কে নিরাপদ আশ্রয় দেওয়া তাদের পক্ষে বর্তমানে সম্ভবপর নয়। তারা হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছে দীক্ষা গ্রহণ করে মদিনায় ফিরে যান। দেশে গিয়ে তারা প্রচার করতে লাগলেন যে, মানুষকে অসৎ পথ থেকে সৎ পথে চালিত করার জন্য আরবদের মধ্যে একজন নবীর আবির্ভাব হয়েছে। প্রতি বছর কাবায় ইয়াসরিব থেকে দলে দলে লোক আসত। এ রূপে অনেকেই হজরতের সংস্পর্শে এসে ইসলাম গ্রহণ করতে লাগল।