যাবতীয় প্রশংসা কেবলই আল্লাহ তাআলার যিনি সমগ্র জগতের মালিক ও রব। আর সালাত ও সালাম নাযিল হোক আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর,যিনি সমস্ত নবীগণের সরদার ও সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী। আরও নাযিল হোক তার পরিবার-পরিজন ও সমগ্র সাথী-সঙ্গীদের ওপর ।
বিশ্বের বিস্ময় নবী ও রাসুলগণের সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) যাঁর তারিফ জগৎময়। বালাগাল উলা বিকামালিহি কাশাফাদ দুজা বিজামালিহি ; হাসুনাত জামিউ খিসালিহি, সল্লু আলাইহি ওয়া আলিহি। পূর্ণতায় যিনি ঊর্ধ্বে সবার যাঁর নুরের ঝলকে কেটেছে আঁধার ; সবকিছুই সুন্দর তাঁর। প্রতিটি মুমিন হূদয়ে নবিপ্রেম আছে আছে প্রিয় নবীকে দেখার ও তাঁর সঙ্গ পাওয়ার অধীর বাসনা। এই সুপ্ত কামনা একজন সাধারণ মুমিনও হূদয়ে লালন করে। মদিনায় রওজা জিয়ারতে হজযাত্রীদের এই আকুলতা আরো তীব্র হয়ে ওঠে। জান্নাতে তাঁর সান্নিধ্য গ্রহণের প্রবল ইচ্ছা জাগে।
পৃথিবীতে নবীর সঙ্গী হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন একমাত্র সাহাবায়ে কিরাম। দুনিয়ার জীবনে আর কোনো মুমিনের এ সৌভাগ্য ললাটে আসবে না। তবে নবীজি (সা.) এমন কিছু আমল বর্ণনা করেছেন যা পালন করলে মুমিন ব্যক্তি জান্নাতে তাঁর সান্নিধ্য লাভ করবে। যার কয়েকটি হলো :
নবীজি (সা.)-এর সুন্নাত দোজাহানের মুক্তির পথ : সুন্নাত হলো নবী কারিম (সা.) যে অবস্থায় যে কাজ যতটুকু গুরুত্বসহকারে করেছেন বা ছেড়েছেন সে অবস্থায় সে কাজ ততটুকু গুরুত্বসহকারে করা বা ছাড়া। অনুরাগে নবীজির প্রতিটি কাজ অনুকরণ করা। রাসুলুল্লাহ (সা.) যা যা করেছেন, সবই সুন্নাত। তাঁর জীবনের প্রধান অবলম্বন ছিল সত্য পবিত্রতা ও প্রেম। সত্যবাদিতার জন্য তিনি আশৈশব আল-আমিন অর্থাৎ সত্যবাদী, বিশ্বাসী ও বিশ্বস্ত উপাধি পেয়েছিলেন। আজীবন কোনো শত্রুও তাঁকে কখনো মিথ্যার অভিযোগে অভিযুক্ত করেনি। নবীজি (সা.)–এর ভালোবাসা মুমিনের ইমান ; সুন্নাতের অনুসরণই ভালোবাসার প্রমাণ। কোরআন কারিমে আল্লাহ তাআলা বলেন (হে রাসুল!) আপনি বলুন যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসতে চাও তবে আমার অনুসরণ করো; ফলে আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন, তোমাদের পাপরাশি ক্ষমা করে দেবেন। আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়ালু। (সুরা-৩,আলে ইমরান, আয়াত : ৩১)।
বেশি বেশি সিজদা করা : রাবিআহ ইবনে কাব (রা.) বলেন আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে রাতযাপন করতাম। একদা আমি তাঁর অজু ও ইস্তিঞ্জা করার জন্য পানি আনলাম। তখন তিনি আমাকে বললেন তোমার কিছু চাওয়ার থাকলে চাইতে পারো। তখন আমি জিজ্ঞাসা করলাম হে আল্লাহর রাসুল! আমি আপনার সঙ্গে জান্নাতে থাকতে চাই। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন ওটা ছাড়া আর কিছু চাও কি ? আমি বললাম এটাই চাই। রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন তাহলে বেশি বেশি সিজদার দ্বারা তুমি এই ব্যাপারে আমাকে সাহায্য কোরো। (মুসলিম, হাদিস : ৪৮৯)
এতিমের অভিভাবকত্ব গ্রহণ করা : সাহাল বিন সাদ (রা.) বলেন রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন আমি ও এতিম প্রতিপালনকারী জান্নাতে এভাবে থাকব ( তিনি তর্জনী ও মধ্যমা অঙ্গুলি দিয়ে ইঙ্গিত করেন এবং এই দুটির মধ্যে তিনি সামান্য ফাঁক রাখেন)। (বুখারি, হাদিস : ৫৩০৪)
কন্যা-সন্তান লালন করা : আনাস ইবনে মালেক (রা.) বর্ণনা করেন একদিন রাসুল (সা.) বলেন যে ব্যক্তি দুটি কন্যাসন্তানের ভরণপোষণ করবে আমি এবং সে এভাবে জান্নাতে থাকব। (মধ্যমা ও শাহাদাত আঙুল যেমন পাশাপাশি থাকে)। (তিরমিজি, হাদিস : ১৯১৪)
বোনদের প্রতিপালন করা : আনাস ইবনে মালেক (রা.) বর্ণনা করেন একবার রাসুল (সা.) মধ্যমা ও শাহাদাত অঙ্গুলির দিকে ইশারা করে বলেন যে ব্যক্তি দুই কন্যা বা দুই বোনের ভরণপোষণ করবে কিংবা তিন কন্যা বা তিন বোনের ভরণপোষণ করবে যতক্ষণ না তাদের বিয়ে হবে কিংবা সে মৃত্যুবরণ করবে আমি এবং সে জান্নাতে এভাবে (পাশাপাশি) থাকব। (ইবনে হিব্বান, হাদিস : ৪৪৭)
উত্তম চরিত্রের অধিকারী হওয়া : আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) বলেন একবার রাসুল (সা.) বললেন আমি কি তোমাদের ওই ব্যক্তি সম্পর্কে অবগত করব না যে কিয়ামতের দিন আমার সবচেয়ে প্রিয় এবং সর্বাধিক নিকটবর্তী হবে ? সাহাবায়ে কিরাম চুপ রইলেন। রাসুল (সা.) একই প্রশ্ন করলেন দুই বা তিনবার। তখন তাঁরা বললেন ইয়া রাসুলুল্লাহ ! অবশ্যই বলুন। তিনি বললেন সে হলো ওই ব্যক্তি যার চরিত্র সবচেয়ে সুন্দর। (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ৬৭৩৫)
নবীজির প্রতি ভালোবাসা : আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত এক ব্যক্তি নবী করিম (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করল কিয়ামত কখন হবে ? তিনি বলেন তুমি কিয়ামতের জন্য কী জোগাড় করেছ ? সে বলল কোনো কিছু জোগাড় করতে পারিনি তবে আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে ভালোবাসি। তখন তিনি বলেন তুমি তাঁদের সঙ্গেই থাকবে যাঁদের তুমি ভালোবাসো। আনাস (রা.) বলেন নবী করিম (সা.)-এর কথার দ্বারা আমরা এত আনন্দিত হয়েছি যে অন্য কোনো কথায় এত আনন্দিত হইনি। আনাস (রা.) বলেন আমি নবী করিম (সা.)-কে ভালোবাসি এবং আবু বকর, ওমর (রা.)-কেও। আশা করি তাঁদের প্রতি আমার ভালোবাসার কারণে তাঁদের সঙ্গে জান্নাতে বসবাস করতে পারব যদিও তাঁদের আমলের মতো আমল আমি করতে পারিনি। (মুসলিম, হাদিস : ২৬৩৯)
বেশি বেশি দরুদ পাঠ করা : আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বর্ণনা করেন রাসুল (সা.) বলেছেন শুনে রাখো যে আমার ওপর বেশি পরিমাণে দরুদ পাঠ করবে নিশ্চয় কিয়ামতের দিন সে আমার সর্বাধিক নৈকট্যপ্রাপ্ত হবে। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হাদিস : ৩২৪৪৭)
আল্লাহ ভীতির জীবন অবলম্বন করা : মুয়াজ বিন জাবাল (রা.) বলেন রাসুল (সা.) যখন তাকে ইয়েমেনে পাঠান তখন তিনি তাকে বিদায় দিতে বের হন। মুয়াজ (রা.) সওয়ারিতে চলছেন রাসুল (সা.) পায়ে হাঁটছেন আর অসিয়ত করছেন। অসিয়ত করা শেষ হলে রাসুল (সা.) বললেন হে মুয়াজ ! সম্ভবত এই বছরের পর আমার সঙ্গে তোমার আর দেখা হবে না। হয়তো তুমি আমার মসজিদের পাশ দিয়ে হাঁটবে আমার কবরের পাশ দিয়ে অতিক্রম করবে ! ( কিন্তু আমার দেখা পাবে না ) এই কথা শুনে রাসুল (সা.) এর আসন্ন বিচ্ছেদ-বিরহে মুয়াজ (রা.) অঝোরে কাঁদতে শুরু করলেন। এরপর রাসুল (সা.) মদিনার দিকে ফিরে তাকালেন এবং বললেন আমার পরিবারের এই লোকেরা মনে করে তারা আমার সবচেয়ে কাছের মানুষ। অথচ বিষয়টা এমন না ; আমার সর্বাধিক নৈকট্যপ্রাপ্ত হলো ওই ব্যক্তি যে আল্লাহভীতির জীবন অবলম্বন করে। সে যে কেউই হোক এবং যেখানেই অবস্থান করুক। (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ২২০৫২) আল্লাহ তাআলা আমাদের এই আমলগুলো যথাযথ পালনের মাধ্যমে নবী (সা.)-এর সান্নিধ্য অর্জন করার তাওফিক দান করুন।
পরিশেষে : জীবনে প্রতিটি ক্ষেত্রে নবীজি (সা.)–এর সুন্নাত আদর্শ অনুকরণ ও অনুসরণ করাই ইসলাম। কোরআন কারিমে আল্লাহ তাআলা বলেন রাসুল (সা.)-তোমাদের যা দিয়েছেন তোমরা তা ধারণ করো আর তিনি যা বারণ করেছেন তা হতে বিরত থাকো। (সুরা-৫৯ হাশর, আয়াত : ৭)। আল্লাহতাআলার কাছে এই প্রার্থনা করি হে দয়াময় সৃষ্টিকর্তা ! তুমি আমাদেরকে শ্রেষ্ঠ-নবির উম্মত হবার কল্যাণে আমাদের দোষত্রুটি ক্ষমা করে তোমার রহমতের বারিধারায় আমাদেরকে সিক্ত করুন। সকলকে প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রতি বেশি বেশি দরুদ ও সালাম পাঠানোর তৌফিক দিন। সকলেই পড়ি আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা সাইয়েদিনা মুহাম্মদ ওয়ালা আলেহি ওয়া আসহাবিহি ওয়া সাল্লাম। আল্লাহ আমাদের সকলকে প্রিয়নবী (সা.)-এর সঙ্গে অনন্তকাল জান্নাতে থাকার সৌভাগ্য দান করুন। আমিন ।
লেখক : ফখরুল ইসলাম নোমানী, ইসলামি চিন্তক ও গবেষক ।