পবিত্র জিলহজ মাসের ফজিলত ও আমল

লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক। লাব্বাইক লা শারিকা লাকা লাব্বাইক। ইন্নাল হামদা ওয়াননিমাতা লাকা ওয়ালমুলক লা শারিকা লাক। মহান আল্লাহর বিধানানুসারে যে চারটি মাস পবিত্র ও সম্মানিত তার একটি হলো জিলহজ মাস। এ মাসের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ সময় হলো জিলহজ মাসের প্রথম দশক। পবিত্র কোরআন ও হাদিসে এই দশকের বিশেষ ফজিলত,গুরুত্ব ও তাৎপর্যের কথা বর্ণিত হয়েছে। স্বয়ং মহান আল্লাহ এই দশকের সম্মান ও পবিত্রতা প্রকাশ করে এই দশকের রাতগুলোর নামে শপথ করেছেন। ইরশাদ হয়েছে শপথ ভোরবেলার শপথ দশ রাত্রির। (সূরা : ফজর আয়াত : ১-২)।
জিলহজ মাস মানে হজের মাস। হজের তিনটি মাস শাওয়াল, জিলকদ ও জিলহজ। এর মধ্যে প্রধান মাস হলো জিলহজ মাস। এই মাসের ৪ থেকে ১৩ তারিখ–এই ছয় দিনেই হজের মূল কার্যক্রম সম্পাদন করা হয়। কোরআন কারিমে আল্লাহ তাআলা বলেন, হজ সম্পাদন সুবিদিত মাস-সমূহে। অতঃপর যে কেউ এই মাসগুলোতে হজ করা স্থির করে, তার জন্য হজের সময়ে স্ত্রী-সম্ভোগ, অন্যায় আচরণ ও কলহবিবাদ বিধেয় নহে। তোমরা উত্তম কাজে যা কিছু করো,আল্লাহ তা জানেন এবং তোমরা পাথেয়র ব্যবস্থা করবে,আত্মসংযমই শ্রেষ্ঠ পাথেয়। হে বোধসম্পন্ন ব্যক্তিগণ তোমরা আমাকে ভয় করো (সুরা-২ বাকারা, আয়াত : ১৯৭)।
বছরের বারো মাসের চারটি মাস বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন। এই চার মাসের অন্যতম হলো জিলহজ মাস। আল্লাহ তাআলা কোরআন মাজিদে বলেন প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর কাছে মাসের সংখ্যা বারোটি যা আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী সেই দিন থেকে চালু আছে যেদিন আল্লাহ তাআলা আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছিলেন। এর মধ্যে চারটি মাস মর্যাদাপূর্ণ। এটিই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান (সুরা-৯ তাওবাহ, আয়াত : ৩৬)। এই চার মাস হলো জিলকদ, জিলহজ, মহররম ও রজব। এসব মাসে যুদ্ধবিগ্রহ, কলহবিবাদ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন আমার প্রতি আজহার দিন (১০ জিলহজ) ঈদ পালন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যা আল্লাহ এই উম্মতের জন্য নির্ধারণ করেছেন। তখন এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করলেন হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! আপনি বলুন (যদি আমার কোরবানির পশু কেনার সামর্থ্য না থাকে) কিন্তু আমার কাছে এমন উট বা বকরি থাকে যার দুধ পান করা বা মাল বহন করার জন্য তা প্রতিপালন করি। আমি কি তা কোরবানি করতে পারি ? তিনি বললেন, না। বরং তুমি তোমার মাথার চুল, নখ, গোঁফ কেটে ফেলো এবং নাভির নিচের চুল পরিষ্কার করো। এ-ই আল্লাহর নিকট তোমার কোরবানি ( আবু দাউদ, নাসাই, ত্বহাবি, খন্ড-২, পৃষ্ঠা : ৩০৫)।
জিলহজ মাসের চাঁদ ওঠার পর থেকে ৯ তারিখ পর্যন্ত দিনে রোজা পালন করা রাতে বেশি বেশি ইবাদত করা উচিত। যথা : নফল নামাজ, কোরআন তিলাওয়াত, তাসবিহ-তাহলিল, দোয়া-দরুদ, তওবা-ইস্তিগফার ইত্যাদি। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন জিলহজের ১০ দিনের ইবাদত আল্লাহর নিকট অন্য দিনের ইবাদতের তুলনায় বেশি প্রিয় প্রতিটি দিনের রোজা এক বছরের রোজার মতো আর প্রতি রাতের ইবাদত লাইলাতুল কদরের ইবাদতের মতো (তিরমিজি, খন্ড-১, পৃষ্ঠা : ১৫৮)।
জিলহজ মাসে রোজার অনেক মর্যাদা রয়েছে। হাফসা (রা.) বর্ণনা করেছেন চারটি আমল নবী করিম (সা.) কখনো ছাড়তেন না। আশুরার রোজা, জিলহজের প্রথম দশকের রোজা,প্রতি মাসের তিন দিনের রোজা,ফজরের আগে দুই রাকাত সুন্নত নামাজ। (সুনানে নাসায়ি,হাদিস নং : ২৪১৫; মুসনাদে আহমাদ, হাদিস নং : ২৬৩৩৯)
হজ ও ওমরাহ সম্পাদন করা : হজ ও ওমরাহ-এ দুটি হলো এ দশকের সর্বশ্রেষ্ঠ আমল। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, এক ওমরাহ থেকে আরেক ওমরাহ এতদুভয়ের মাঝের গুনাহগুলোর কাফফারা আর মাবরুর হজের প্রতিদান শুধুই জান্নাত। (বুখারি, হাদিস : ১৭৭৩; মুসলিম, হাদিস : ৩৩৫৫)
আরাফার দিন রোজা : আরাফার দিন অর্থাৎ ৯ জিলহজ নফল রোজা রাখা বিশেষ সুন্নত আমল। তবে আরাফায় উপস্থিত হাজি সাহেবদের জন্য এই রোজা প্রযোজ্য নয়। হজরত আবু কাতাদা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন আরাফার দিনের রোজার ব্যাপারে আমি আশাবাদী যে আল্লাহ তাআলা তার (রোজাদারের) বিগত এক বত্সরের ও সামনের এক বছরের গুনাহ মাফ করে দেবেন (তিরমিজি, খন্ড-১, পৃষ্ঠা : ১৫৭)।
তাকবির পাঠ : জিলহজ মাসের ৯ তারিখ ফজর থেকে ১৩ তারিখ আসর পর্যন্ত প্রতি ফরজ নামাজের পর একবার তাকবির বলা ওয়াজিব (ইলাউস সুনান,খন্ড-৪,পৃষ্ঠা : ১৪৮)। জিলহজের ১০, ১১ ও ১২ যে কোনো দিন কোনো ব্যক্তির মালিকানায় নিত্যপ্রয়োজনের অতিরিক্ত সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণ অথবা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপা বা এর সমমূল্যের সম্পদ থাকলে তার ওপর কোরবানি করা ওয়াজিব। পুরুষ ও নারী সবার জন্য এ বিধান প্রযোজ্য (ইবনে মাজাহ : ২২৬)। তাকবিরের বাক্য নিম্নরূপ : আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ। আল্লাহ বড় আল্লাহ বড়,আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। আল্লাহ বড় আল্লাহ বড়। সব প্রশংসা আল্লাহর জন্য। (দারু কুতনি, হাদিস নং : ১৭৫৬ ; ইরওয়াউল গালিল, হাদিস নং : ৬৫৪)
সময় হলো মানব জীবনের মূলধন। এই মহামূল্যবান সম্পদ হেলায় নষ্ট করা বুদ্ধিমানের কাজ হতে পারে না। আল্লাহ তাআলা বলেন : শপথ ! সময়ের নিশ্চয় সব মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত ; তবে তারা নয় যারা ইমান আনে সৎকর্ম করে সত্যের উপদেশ দেয় ও ধৈর্যের উৎসাহ প্রদান করে। (সুরা : আসর আয়াত : ১-৩)। হাদিস শরিফে আছে : তোমরা পাঁচটি জিনিসের আগে পাঁচটি জিনিসকে গুরুত্ব দাও ; ব্যস্ততার আগে অবসরকে, অসুস্থতার আগে সুস্থতাকে, দারিদ্র্যের আগে প্রাচুর্যকে, বার্ধক্যের আগে যৌবনকে, মৃত্যুর আগে জীবনকে। (মুসলিম শরিফ ও তিরমিজি শরিফ)। অর্থাৎ অবসরকে কাজে লাগাও (নফল ইবাদতের মাধ্যমে) ব্যস্ততা আসার আগে সুস্থতাকে কাজে লাগাও (আল্লাহর হুকুম পালনের মাধ্যমে) অসুস্থ হওয়ার আগে, প্রাচুর্যকে কাজে লাগাও (দান করার মাধ্যমে) দারিদ্র্য আসার আগে যৌবনকে কাজে লাগাও (বেশি বেশি নেক আমলের মাধ্যমে) বার্ধক্য আসার আগে, জীবনকে কাজে লাগাও (পরোপকারের মাধ্যমে) মৃত্যু আসার আগে। (সুনানে তিরমিজি)।
হিজরি সালের সর্বশেষ মাস জিলহজ। মহান আল্লাহ এই মাসকে সম্মানিত করেছেন। মহান আল্লাহর ঘরে পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে মুসলিমরা এসে জড়ো হন। এই মাসের প্রথম ১০ দিন অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ।
হজরত জায়েদ ইবনে আরকাম (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে সাহাবাগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসুল (সা.) ! এ কোরবানি কী ? উত্তরে তিনি বললেন, তোমাদের পিতা ইব্রাহিম (আ.)-এর সুন্নত। তাঁরা পুনরায় বললেন হে আল্লাহর রাসুল ! তাতে আমাদের জন্য কী সওয়াব রয়েছে ? উত্তরে তিনি বললেন কোরবানির পশুর প্রতিটি পশমের বিনিময়ে একটি সওয়াব রয়েছে। তাঁরা আবারও প্রশ্ন করলেন হে আল্লাহর রাসুল (সা.) ! ভেড়ার লোমের কী হুকুম ? (এটা তো গণনা করা সম্ভব নয় ) তিনি বললেন ভেড়ার প্রতিটি পশমের বিনিময়েও একটি সওয়াব রয়েছে (ইবনে মাজাহ : ২২৬)। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন যে ব্যক্তি সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও কোরবানি করল না সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটেও না আসে (ইবনে মাজাহ : ২২৬)। ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে মহানবী (সা.) বলেন অতএব তোমরা এই দিনগুলোতে বেশি বেশি করে তাহলিল (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ), তাকবির (আল্লাহু আকবার) এবং তাহমিদ (আলহামদুলিল্লাহ) পড়বে (মুসনাদে আহমাদ)। মহান আল্লাহতায়ালা আমাদের সবাইকে জিলহজ মাসের বরকত থেকে কল্যাণ মন্ডিত হওয়ার সৌভাগ্য দান করুন। সবাইকে আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক : ফখরুল ইসলাম নোমানী, ইসলামি চিন্তক ও গবেষক ।