টান পড়েছে খাদ্য তালিকায়

    হু হু করে বাড়ছে খাদ্যপণ্যের দাম। সেই সঙ্গে বেড়েছে নানা ব্যয়। আয় বা বেতন বাড়ছে না। কিন্তু ব্যয় বাড়ছে দিনকে দিন। এই অবস্থায় সীমিত আয়ের মানুষের জীবন জেরবার অবস্থায়। জীবন যাপনের ব্যয় মেটাতে প্রতিদিনই কাটছাঁট করতে হচ্ছে তালিকা। টান পড়েছে খাদ্য তালিকায়ও। আগে যে পরিবার মাসে দুইদিন গোশত কিনতে পারতো এখন মাসে একদিনের বেশি কিনতে পারছে না। যে পরিবারটির মাসে একদিন গোশত কেনার সামর্থ্য ছিল সেই পরিবারটি এখন আর সেই সাহস করতে পারছে না। পুষ্টির চাহিদা মেটাতে যে পরিমাণ দুধ, ডিম বা ফল কেনার সামর্থ্য ছিল তা কমে আসায় ছোট হচ্ছে খাবারের তালিকা

    ফলে পুষ্টির চাহিদা পূরণে অনেকেরই ঘাটতি রয়ে যাচ্ছে। মধ্যম এবং সীমিত আয়ের নানা পরিবারের দৈনন্দিন ব্যয় ও খাদ্য চাহিদা পর্যালোচনা করে এমন তথ্যই পাওয়া যাচ্ছে। তারা বলছেন, পরিস্থিতির কারণে খাবারের তালিকা ছোট হচ্ছে। শাকসবজি থেকে শুরু করে সব খাদ্যপণ্যের দাম দিনের পর দিন বেড়েই চলছে। এতে একই খাবার কিনতে পারলেও তা পরিমাণে কমিয়ে দিতে হচ্ছে।
    আগে ভাত খাইতাম, এহন পান্তা খাই: এক চোখে ছানি পড়ে গেছে জালাল সর্দারের। বয়স ৬০। এক চোখ দিয়েই মুচির কাজ করেন তিনি। চার ছেলেমেয়ে নিয়ে তার সংসার। সকলের বিয়ে হয়েছে। বড় ছেলে খোঁজ রাখে না। ছোট ছেলেটা একটা দোকানে কাজ করে। তার স্ত্রী কাজ করেন দুটি ছাত্রাবাসে। এ থেকে আয় হয় ছয় হাজার টাকা। জালালের আয় সাত থেকে আট হাজার টাকা। তাদের ঘর ভাড়া দিতে হয় মাসে সাড়ে তিন হাজার টাকা। ছেলের ঘর ভাড়াও একই। জুন থেকে এই ভাড়া হয়ে যাবে তিন হাজার আটশ’ টাকা।

    জালাল বলেন, এক বছর হইলো চোখে সানি পড়া শুরু হইছে। গত বছরের শেষের দিকে ফ্রি ডাক্তার দেখাইলাম সেখানে অপারেশন করার পরামর্শ দেয়া হয়। কিন্তু ওখানে ফ্রি অপারেশন করা যাইতো, ভাবলাম এখন করলে কাজ বন্ধ হইয়া যাইবো। তাই করি নাই। এখন তো এক চোখে দেখিই না। ঈদের সময় যাকাতের সাড়ে সাত হাজার টাকা পেলাম। দিয়া কইলো অপারেশন কইরা নিয়েন। কিন্তু ভাবলাম এই টাকা নিয়ে নাতি-নাতনিগোরে কিছু কিন্না দেই। কিন্না দিতে গিয়া সব টাকা শেষ।

    তিনি আরও বলেন, আগে সপ্তাহে একদিন বা দুইদিন ব্রয়লার মুরগি না হইলে মাছ কিনতাম। এখন ঈদের পর থেকে আর সবজি ছাড়া কিছু খাইতে পারি নাই। আমার বউয়ের টাকা দিয়্যা ঘর ভাড়া আর অন্য খরচ করতাম। আমার টাকা দিয়া চলে প্রতিদিনের খরচ। প্রতিদিন আমার বসার জন্য ভাড়া দেয়া লাগে ৫০ টাকা। আবার মাস শেষে দেয়া লাগে ৫০০ টাকা। দিনে আমার হাতে থাকে গড়ে ৩০০ টাকার মতো। এহন আমার দিনে চাল কেনা লাগে দুই কেজি। এই চাল কিনতে খরচ হইয়া যায় ১০০ টাকার উপরে। আমার আর বউয়ের জন্য ওষুধ কেনা লাগে দিনে ৪০ টাকার। আর খরচ মিলাইয়া হাতে টাকা থাকে ১০০ টাকা। এই টাকা দিয়া সবজি, তেল, ডাল কেনার পর আর টাকা থাকে না। আগে মুরগি, মাছ না হইলেও একটু সবজি দিয়া প্যাট ভইরা খাইতাম। এহন সকালে পিয়াজ দিয়া পান্তা খাই।

    ‘এখন একদিন দুধ, আরেক দিন ডিম দেই’: রাবেয়া সুলতানার ছেলে রিয়ন আহমেদ। বয়স সবে চার বছর। তার বাবা আসিফ আহমেদ কাজ করেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। মাসে বেতন পান ১৫ হাজার টাকা। এ ছাড়াও কৃষি জমি মিলিয়ে তার আয় সব মিলিয়ে ২০ হাজার টাকা। রাবেয়া বলেন, রিয়ন জন্মানোর পর থেকে ওর জন্য সকালে খিচুড়ি রান্না করতাম। শীতকালে সবজি দিতাম চার থেকে ছয় প্রকারের। আজ যে খিচুড়ি রান্না করেছি তাতে দিয়েছি আলু আর মিষ্টি কুমড়া। বাজারে যে দাম অধিক সবজি নিতে পারি না। আমরা সাবলেট থাকি। সবমিলিয়ে ভাড়া দিতে হয় আট হাজার টাকা। বাকি ১২ হাজার টাকার সংসার চালাতে হয়।

    তিনি আরও বলেন, আগে রিয়নের বাবা অফিসে যাবার আগে রিকশায় যেতো। খরচ প্রতিদিন ৪০ টাকা। এখন বাসে যাবার কারণে সকাল সাড়ে সাতটায় বের হতে হয়। আগে বের হতো সাড়ে আটটায়। রিয়নকে প্রতিদিন একটা ডিম ও এক গ্লাস দুধ দিতাম। কিন্তু সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় আর পারি না। তাই একদিন দুধ আরেক দিন ডিম দেই। অনেক দিন দুধ দিতে পারি না। সেদিন ডিম দেই। আমাদেরও খাবারে অনেক পরিবর্তন এসেছে। স্বামী আমাকে বাজার করার জন্য ৫০০ টাকা দিয়েছিলেন সেদিন। তেলই কিনেছি ২০০ টাকা দিয়ে। বাজার করবো কি দিয়ে?

    ‘গরুর মাংস আর কিনতে পারি না’: আগে প্রতি শুক্রবার হাফ কেজি গরুর মাংস কিনতাম। সংসারে আমরা চারজন। কিন্তু শেষ কয়েক মাস ধরে আর কিনতে পারছি না। লালমাটিয়া ব্লক বি’তে কোল্ড কফি ও জুসের দোকান করেন ইমতিয়াজ শুভ। তিনি বলেন, প্রতিদিন তার আয় এক হাজার টাকা। ধরেন মাস ছয়েক আগেও প্রতি শুক্রবার হাফ কেজি করে মাংস কিনতাম। এরপর কমতে কমতে দুই সপ্তাহে একবার কিন্তু এখন একেবারেই কিনি না। আমার দুই ছেলে লেখাপড়া করে। তাদের পেছনে মাসে প্রায় ১০ হাজার টাকা খরচ হয়। এরপর বাড়ি ভাড়া ১২ হাজার টাকা। বাজারের সবকিছুর যে দাম এখন আর পারি না। ঈদের আগে কম করে হলেও এক মাস পর এক কেজি গরুর মাংস কিনছিলাম। এখন তো সব কিছুর দাম- মুরগিও কিনতে পারি না।

    ‘শেষ দুই মাস ডিপিএস জমা দেই নাই’: আগে মোহাম্মদপুর নূরজাহান রোডে থাকতেন আলম শাহরিয়ার দম্পতি। তার স্ত্রীও চাকরি করেন। এই গণমাধ্যমকর্মী বলেন, আমরা দু’জনই চাকরি করি। আমাদের দু’জনের আয় সব মিলিয়ে ৫০ হাজার টাকা। আগে নূরজাহান রোডে ২২ হাজার টাকা বাড়ি ভাড়া দিয়ে থাকতাম। এখন বাধ্য হয়ে শেখের টেকে ১৬ হাজার টাকার একটা ছোট বাসায় উঠেছি। এক ছেলে ও এক মেয়ে তাদের পেছনে মাসে খরচ হয় ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। এরপর সংসার চালানো দায় হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে রিকশা ভাড়া। আমার পরিবারের সদস্যদের প্রতিদিন এখন রিকশা ভাড়া লাগে ২০০ থেকে ২২০ টাকা। যা দুই থেকে তিন মাস আগেও লাগতো ১৪০ থেকে ১৫০ টাকা।
    তিনি বলেন, আগে মাসে পাঁচ লিটার তেলে মাস চলতো। ইদানীং দুই থেকে তিন লিটার তেলে চলছে। আবার খাবারের মেন্যুতেও ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। আগে মাসে কম করে হলেও ২০ কেজি ফল আনতাম। এখন তা নেমে গেছে ১০ থেকে ১২ কেজিতে। তিনি আরও বলেন, দুইটা ডিপিএস চালাই আমরা। পাঁচ ও দুই হাজার টাকা। শেষ দুই মাসে এতটাই সাংসারিক ব্যয় বেড়েছে যে, পাঁচ হাজার টাকার ডিপিএস’টা জমা দিতে পারিনি।

    এই চার পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের পরিবারের ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় ছোট হয়েছে খাদ্য তালিকা। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট এবং স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের যৌথ গবেষণায় বলা হয়, দেশের ৪১ শতাংশ পরিবারের স্বাস্থ্যকর খাবার কেনার সামর্থ্য নেই। দারিদ্র্যসীমার নিচে বা দারিদ্র্যসীমার ঠিক উপরে থাকা পরিবারগুলো স্বাস্থ্যকর খাবার কিনতে পারছে না। তারা বলছে, বাংলাদেশ ধান ও মাছ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে। তারপরও দেশের মানুষ তিন মাত্রার অপুষ্টির ঝুঁকিতে আছে। দেশের পাঁচ বছরের কম বয়সী ২৮ শতাংশ শিশুর উচ্চতা বয়সের তুলনায় কম ও ৮ শতাংশ শিশু তীব্র অপুষ্টির শিকার। ৪০ শতাংশ নারী রক্তস্বল্পতায় ভুগছে অর্থাৎ তারা অণুপুষ্টিকণার ঘাটতির শিকার। অন্যদিকে প্রাপ্তবয়স্ক ১৬ শতাংশ পুরুষ ও ১৮ শতাংশ নারীর ওজন বেশি। ওজন বেশি এমন নারী-পুরুষের মধ্যে স্থুলতা বাড়ছে। এসব অপুষ্টির একটি কারণ পুষ্টিজ্ঞানের ঘাটতি।

    ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক নাজমা শাহীন বলেন, আগে যে টাকায় খাবার কিনতে পারতাম। এখন আমরা তা পারছি না। এখন খাবারের পরিমাণ কমে যাওয়ায় চাহিদা অনুযায়ী পুষ্টি উপাদান মিলছে না। ফলে তার স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। আর এটা দীর্ঘদিন চলতে থাকলে তাতে নিম্ন আয়ের মানুষরা খুব দ্রুত দীর্ঘ সময়ের জন্য অসুস্থ হয়ে পড়বে। দ্রব্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমাদের পুষ্টির যে উন্নতি হয়েছে সেটি ধরে রাখা আমাদের চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে।