
রশীদ এনাম : টুং টাং টাং ছুটির ঘন্টার ধ্বনিটা এখনো কানে বাজে। যতটুকু মনে পড়ে কোন এক শীতের সকালে শুভ্র বর্ণের কুয়াশার চাদরে ঢাকা হলুদ বর্ণের দালান। ইশকুলের মূল ফটকে কৃষ্ণচুড়া বৃক্ষ। বৃক্ষের নীচে আমলকি, কুল, চালতা, বাদাম ও তেঁতুল আচারের পসরা নিয়ে বসে আছে বিক্রেতারা। পাশে রিকশা ভ্যান গাড়ি করে আইসক্রিম ওয়ালা আইসক্রিম বিক্রি করছে। এই তো সেদিন প্রাথমিক পাঠ শেষ করে, বাবার হাত ধরে রাহাত আলী ইশকুলে ভর্তি হয়েছিলাম। হলুদ রঙের দালানের গায়ে খোদাই করা ঝাপসা লেখা স্থাপিত -১৯১৪ সাল। ছাত্রদের কোলাহল আহ্ কি আনন্দ আকাশে বাতাসে। স্বপ্ন ডানায় চরে ইশকুলবেলা ফেলে এসেছি সেই কবে।
১৯৯৬ সালের কথা, এসএসসি পাশ করার পর, বন্ধুরা মিলে ইশকুলের স্যারদেরকে সালাম করতে গিয়েছিলাম। প্রধান শিক্ষক মুছা স্যার আমাদের কে মাথায় হাত বুলিয়ে অনেক দোয়া করলেন। স্যারের সাথে ওটাই ছিল আমার শেষ দেখা। একদিন জানলাম, ইশকুলের প্রধান শিক্ষক মুছা স্যার আর নেই। একে একে না ফেরার দেশে চীরতরে চলে গেলেন, জসীম স্যার, মৌলানা মোজাফর হুজুর, মোবারক আলী স্যার, মনির আহমেদ মজুমদার স্যার, ইকবাল স্যার, কাশেম স্যার, চৌধুরী হারুন স্যার, মাইনুউদ্দিন স্যার ও হাসান স্যার, সগির স্যার, নুরুল ইসলাম স্যার সহ আরও অনেকে। বিনম্র শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি তাঁদের। মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করি, তিনি যেন তাদের সবাইকে জান্নাতবাসী করেন। স্মৃতির ঝাঁপিতে লেখা আছে ইশকুলের ইতিকথা ! আমাদের বিদ্যাপিঠ আমাদের অহংকার। মাঠে সারি সারি বৃক্ষ, চাঁপা, বাতাবি লেবু গাছ লাগিয়েছে। ইশকুলের পেছনে নেই আম গাছ, শিউলি ফুলের গাছ ছিল সেটি এখন আর নেই। পুকুরটাও নেই। কয়েকটা নতুন দালান স্থাপন করা হয়েছে। নুতুন ইশকুলের তোরণ নির্মাণ হয়েছে। মাঠে শহীদ মিনার স্থাপন হয়েছে। ইশকুলের পেছনের মাঠে প্রকৃতি বিছিয়ে দেয়া সবুজ গালিচা বিছানো মাঠ টা ঠিক আগের মতোই আছে। মাঠের উত্তর পাশে নতুন ভবন নির্মাণ হয়েছে। পূর্ব পাশে মেহগনি, সেগুন গাছের সারি। মাঠের উত্তর পাশে চীরতরে ঘুমিয়ে আছেন এই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা মওলানা আবদুস সোবহান সাহেব। মওলানা আবদুস সোবহান ছিলেন একজন সুফি সাধক ও ধার্মিক লোক। আগেকার দিনে সমগ্র পটিয়া উপজেলায় একমাত্র ইশকুল ছিল, পটিয়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়। পটিয়া ইশকুলের পরিবেশটা ছিল, অনেকটা সাম্প্রদায়িক। আমি ক্ষমাপ্রার্থী প্রিয় পাঠক প্লিজ কেউ অন্যভাবে নিবেন না। গরিব, কৃষক, নিষ্পেষিত পরিবারের সন্তানেরা পটিয়া ইশকুলে ভর্তি হতে পারত না। বিশেষ করে মুসলমান বা গরিব কৃষক পরিবারের সন্তানেরা এ ইশকুলে ভর্তির বিষয়টা ছিল অনেকটা কঠিন।
গরিব কৃষক ও মুসলিম ছাত্রদের কথাভেবে, একদা মৌলানা আবদুস সোবহান সাহেব মাদ্রাসা স্থাপন করার পরিকল্পনা করলেন। থানার সামনে মসজিদের সঙ্গে বর্তমানে ভরাটকৃত যে পুকুরটি ছিল। একসময় পুকুরটি হাদু দিঘি নামে পরিচিত ছিল। পুকুরের দক্ষিণ পাশে ব্যাক্তিগত উদ্যেগে খেজুর পাতা ও বাঁেশর তৈরী বেড়া দিয়ে আবদুস সোবহান সাহেব একটি সোবহানিয়া মাদ্রাসা/মক্তব নির্মাণ করেন। সে সময় প্রতিহিংসাবসত কে বা কাহারা মক্তবটি রাতের বেলায় আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিল। তিনি ধৈর্য্য ও নিষ্টার সাথে পরবর্তীতে বিভিন্ন জনের সাহায্যে নিয়ে মক্তবটি পুনরায় দাঁড় করান। বহু দুর দুরান্ত থেকে ছাত্ররা এসে ভর্তি হতে লাগল এ মক্তবে। দিন দিন ছাত্র সংখ্যা বেড়েই চলল। মওলানা আবদুস সোবহান সাহেব এক সময় সিদ্ধান্ত নেন, যে করে হোক এটাকে ইশকুলে রুপান্তর করতে হবে। এক সময় মক্তবটিই বিদ্যালয়ে পরিণত হয়। মওলানা আবদুস সোবহান সাহেব নিজের সম্পদ বিক্রি করে ও জীবনের সকল সঞ্চয় বিশেষ করে, মওলানা আবদুস সোবহান ওয়াজ ও দোয়া মাহফিল করে যে অর্থ উপার্জন করতেন তাঁর সবটুকুই তিনি ব্যয় করেন ইশকুল নির্মাণে। আবদুস সোবহান সাহেব একসময় আধুনিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে এ মক্তবকে মাইনর ইশকুলে পরিণত করেন। এমনকি নিজের ঘরের টিনের চাল খুলে এনে ইশকুলে লাগিয়েছিলেন। কত মহান, কত উদার, কত ত্যাগী হলে মানুষ এ কাজটা করতে পারে! মাধ্যামিক ইশকুল নির্মাণে যখন হাত দেন, ঠিক সে সময় শুরু হয় দ্বন্দ্ব, পটিয়া ইশকুলের পাশেই আরেকটি মাধ্যামিক ইশকুল প্রতিষ্ঠা অর্জন করছে দেখে, কে বা কাহারা শত্রুতা করে ইশকুল ঘরে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। কত বড় ট্রেজেডি সে সময় নাকি তিন তিনবার বিদ্যালয়টি আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিল।
তখন মওলানা আবদুস সোবহান সাহেব দারুনভাবে ভেঙ্গে পড়েন। তখনকার সময় পটিয়া থানার পুলিশ ইন্সপেক্টর ছিলেন রাহাত আলী দাড়োগা। তিনি বিষয়টি দেখে আবদুস সোবহানের প্রতি সদয় হন এবং ইশকুল নির্মাণের জন্য সহযোগিতা ও ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দেন। বহু ত্যাগ-তিতীক্ষা, বহু বাঁধা-বিপত্তি এবং চড়াই উতড়াই পার হয়ে এক সময় নতুনভাবে স্থাপিত ইশকুলটি। তখনকার দিনে স্থানীয় লোকেরা মওলানা আবদুস সোবহানের নামে ইশকুলের নামকরন করতে চাইলে, আবদুস সোবহান সাহেব বাঁধা দেন তিনি বলেন, “ইশকুল প্রতিষ্ঠার পেছনে, রাহাত আলী সাহেব আমাকে বিপদের দিনে সাহায্যে করেছেন। তাঁর সহযোগিতা না পেলে আমি এ ইশকুলটি টিকিয়ে রাখতে পারতাম না। আমার সন্তান আছে কিন্তু রাহাত আলী সাহেবের কোন সন্তান নেই। অতএব ইশকুলটি রাহাত আলী সাহেবের নামেই হোক। তখন এ ইশকুলের নামকরন দুজনের নামে করা হয় এ.এস(আবদুস সোবহান) রাহাত আলী উচ্চ বিদ্যালয়।
১৯১৪ সালে সোবহানিয়া মক্তবটি প্রথমে এএস রাহাত আলী ফ্রি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং পরে মোহছেনা প্রাইমারী ইশকুল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে এ বিদ্যালয়ের সম্প্রসারন কাজে অনেকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন, তাদের মধ্যে যাদের নাম উল্লে¬খ করার মতো, ছদু তালুকদারের পরিবারের সদস্যরা জমি দান করেন। ইশকুল প্রতিষ্ঠার জন্য সহযোগিতা করেন, আবদুর রহমান, মোখলেছুর রহমান, নজরুল ইসলাম, মাওলানা নুরুচ্ছফা, আহমুদুর রহমান, হামিদুল হক, আখতার ফিরোজ, আলহাজ¦ সাইফুল আলম মাসুদ, প্রমুখ।
বিদ্যালয় সম্পর্কে কথা বলেছিলাম, আমার অত্যন্ত পরমশ্রদ্ধেয় প্রিয় শিক্ষক সহকারী প্রধান শিক্ষক আবদুল মোতালেব স্যারের সাথে। তিনি ইশকুলের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন,“১৯৭৪ সালে সহকারি শিক্ষক হিসাবে এ ইশকুলে যোগদান করি। এ ইশকুলের সাথে আমি ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। প্রতিটি ভালো কাজের সাথে আগ্রহ উদ্দীপনা নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করেছি। নিজস্ব আবেগের সবকিছু যেন এ স্কুলের জন্য উৎসর্গ করে এসেছি । অবসর গ্রহণ করার পরও রাহাত আলী উচ্চ বিদ্যালয়ে সাধারন শিক্ষক হিসাবে শিক্ষকতা করে যাচ্ছি খুব ভালো লাগে এই বিদ্যাপিঠকে” মোতালেব স্যার বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত। ইশকুলের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক বাবু অরু বিকাশ দাশ জানান, “১৯৭৬ সালে ইশকুলে যোগদান করি। পটিয়া উপজেলায় সবচেয়ে বড় ইশকুল। তাছাড়া প্রতি বছর ভালো রেজাল্ট করেও ইতোমধ্যে সুনাম অর্জন করেছে। বিদ্যালয়টি ২০১৪ সালে শতবর্ষ পুর্তি হলেও বিভিন্ন রাজনৈতিক অস্থিরতার কারনে অনুষ্ঠান করা সম্ভব হয়নি। গত ২০১৬ সালে ১৮মার্চ মহানস্বাধিনতা দিবসের মাসে শতবর্ষ উদযাপন অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়েছে। প্রয়াত প্রধান শিক্ষক বীর মুক্তিযোদ্ধা ছগির আহমেদ স্যার বলেছিলেন, “আমার সময়ে ইশকুলের শতবর্ষ অনুষ্ঠান হতে যাচ্ছে, এজন্য আমি নিজেকে খুব সৌভাগ্যবান মনে করছি। আমি গর্বিত কেননা শতবর্ষ অনুষ্ঠানের স্বাক্ষী হতে পেরে আমি আনন্দিত ও অভিভুত। এই দিনে বিনম্র শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি তাঁদের যারা এই ইশকুল প্রতিষ্ঠার জন্য মেধা দিয়েছেন শ্রম দিয়েছেন আর্থিকভাবে সহযোগিতা করেছেন, তাঁরা আজ অনেকে কবরবাসী, আমি তাঁদের আত্নার মাগফেরাত কামনা করছি”। তিনি শতবর্ষ অনুষ্ঠানে বলেছিলেন,“ইশকুলের প্রাক্তন ছাত্ররা যারা আজ দেশেবিদেশে আলো ছড়াচ্ছেন,আমি তাঁদের কাছে সবিনয় নিবেদন করব, তাঁরা যেন সকলে এই ইশকুলটিকে সরকারি করনের লক্ষ্যে এগিয়ে আসেন। স্যার বেঁচে নেই স্যারের কথাগুলো এখন শুধু স্মৃতি !
এই ইশকুলের প্রাক্তন ছাত্র যাদের নাম না বললে নয়, একাত্তরের শহীদ গাজী আবদুস ছবুর সহ অনেক মুক্তিযোদ্ধাও রয়েছেন, প্রাক্তন ছাত্র দেশ বরণ্য কবি ওহিদুল আলম, পুঁথি গভেষক ও সংগ্রাহক পন্ডিত আবদুস সাত্তার চৌধুরী, বর্তমানে দুবাই কানাডিয়ান বিশ^বিদ্যালয়ের হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক প্রফেসর ড. নুরুল আলম। চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক ড. কাজী আহমেদ নবী, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মেজবাহ উদ্দিন, নেদারল্যান্ডের রাষ্টদুত শেখ মুহাম্মদ বেলাল, বর্তমান মন্ত্রিপরিষদের সচিব খোরশেদ আলম খাঁন, বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রীমহোদয়ের মুখ্য সচিব ডক্টর আহমদ কায়কাউসের প্রয়াত বাবা আহমদ কায়কোবাদ, দেশবরেণ্য লেখক ও গবেষক মুহাম্মদ শামসুল হক ও অত্র ইশকুলের প্রাক্তন ছাত্র ও শিক্ষক ছিলেন।
এছাড়া দেশে-বিদেশে বিভিন্ন জায়গায় আলো ছড়াচ্ছেন অধ্যাপক, শিক্ষক, মুক্তিযোদ্ধা, লেখক, গবেষক, কবি, কথাসাহিত্যিক, চিত্রশিল্পী, সাংবাদিক, ডাক্তার, প্রকৌশলী, ব্যাংকার, সরকারি কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ এবং শিল্প উদ্যেক্তাসহ আরও অনেক কীর্তিমান ছাত্র।
খুব মনে পড়ছে আজ ইশকুলবেলার শেষদিনের কথা, যখন বাড়ি ফিরছিলাম সুর্য তখন পশ্চিমা আকাশে হেলে পড়ছিল। আবার উদিত হবে পরদিন নতুন আশা ও স্বপ্ন নিয়ে, আগামীর নতুন সম্ভাবনায় আলো ছড়াবে নতুন করে। আলোকিত হবে পুরো বিশ^। গুটি গুটি পায়ে যখন ইশকুলের ফটক পেছনে ফেলে আসলাম, টের পেলাম চোখের কোণে জল টলমল করছে। মন বলছিল, যেও না, আরো কটা দিন থেকে যাও। বিবেক বলে সেবার জন্য বের হয়ে যাও। জানি আর কোন দিন ইশকুলে ক্লাশ করা হবে না। প্রিয় স্যারদের মধুর বকা আর কানে পৌঁছবে না। গাদাগাদি করে বন্ধুদের সাথে ইশকুলের বেঞ্চিতে বসে একসাথে টিফিন ভাগাভাগি করে খাওয়া হবে না। দপ্তরি গোলাপ চাচা, নারায়ন দা,আনোয়ার ভাই, হাশমত ভাইয়ের ছুটির ঘন্টার ধ্বনি কানে পৌছবে না। ইশকুল পলায়ন করা কখনও হবে না। খুব মনে পড়ছে রবী ঠাকুরের দুই বিঘা জমি কবিতার চরণটি “সেই সুমধুর স্তব্দ দুপুর, পাঠশালা পলায়ন,ভাবিলাম হায়, আর কি কোথায় ফিরে পাব সে জীবন”।
দক্ষিণ চট্টগ্রামের পটিয়ার শতবর্ষী আবদুস সোবহান রাহাত আলী উচ্চ বিদ্যালয় আজ কালের সাক্ষি। ইশকুলের প্রাক্তন ছাত্র প্রিয় বড় ভাই, জনপ্রতিনিধি, সহপাঠি, ইশকুলবেলার বন্ধুদের কাছে আমার সবিনয় নিবেদন, আসুন আমাদের প্রিয় বিদ্যাপিঠকে সরকারি করনের জন্য যে যেখান থেকে পারি ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দিয়ে সহযোগিতা করি। অসংখ্যা গুণি ব্যক্তির স্মৃতি বিজড়িত ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপিঠ আবদুস সোবহান রাহাত আলী উচ্চ বিদ্যালয়কে জাতীয়করনের জন্য হাজার বছরের শ্রেষ্ঠবাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখমুজিবুর রহমানের তনয়া মানবতার মা আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীমহোদয়, শিক্ষামন্ত্রী ও শিক্ষাপ্রতিমন্ত্রীর সু-দৃষ্টি কামনা করছি । লেখক : রশীদ এনাম, লেখক ও প্রাবন্ধিক ও প্রাক্তন ছাত্র ৯৬ ব্যাচ।











