বাঁধের রাস্তায় ভরসা

কোনেটে যাবার জাগা নাই। ‘বানোতে হামার বাড়ি ডুবি গেইছে। রাস্তা হামার বাপ-মাও। তায় জাগা দিছে। ভেড়া-গরু নিয়া রাস্তার মধ্যে আছি। হামার খাবার খুব কষ্ট হইছে।’ বানের পানিতে নাকাল দিনমজুর জাহানারা এভাবে তার কষ্টের কথা তুলে ধরলেন। জাহানারার সাথে দেখা কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার সারডোবের বাঁধের রাস্তায়। এখানে দুটি টিনের ছাপড়া তুলে গবাদী পশু নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন জাহানারা বেগম। স্বামী, সন্তান সবার ঠিকানা এখন রাস্তা।

জাহানারা জানান, সম্পদের মধ্যে ৫টি ছোট বড় ভেড়া ও একটি গরু আছে। তাও নিজের নয়। আধি চুক্তিতে লালন পালন করছেন। নিজে না খাইয়ে তাই গবাদী পশুকে খাওয়াতে হচ্ছে।

জাহানার মতো অনেকেই ঠাঁই নিয়েছেন সারডোব আর হলোখানা গ্রামের বাঁধের রাস্তায়। এদের একজন জহুর আলী। রবিবার বিকল্প বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে মুহূর্তে ঘর বাড়ি ভেসে যায় তার মতো আরো ১০টি পরিবারের।

জহুর আলী জানান, বাড়ির অনেক মালামাল ভেসে গেছে। কিছু রক্ষা করে বাঁধের রাস্তায় এসে পরিবারসহ ঠাঁই নিয়েছেন। জহুর আলী বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ড আশা দিয়া হামার সর্বনাশ করলো। এখন ছওয়া পোওয়া নিয়া খুব দুর্গতিত পড়চি ভাই।’

জহুর আলীর ভাই আব্দুস সালামের ঘর বাড়ি ও ব্রয়লার মুরগীর খামার ভেসে গেছে। তিনিও ঠাঁই নিয়েছেন ভাঙা বাঁধের অক্ষত অংশটিতে। এই অবস্থা সাইফুল ইসলামের। তিনি বাধ্য নৌকাযোগে টিনের চাল খুলে এনে রাস্তার উপর ঘর তুলছেন। জিঙ্গেস করলে বলেন, ‘যাবারতো কোনো জাগা নাই। এ্যালা রাস্তা ছাড়া কোটে যাই।’

আব্দুস সামাদ গরু বাছুর নিয়ে আরডিআর বাজারের পাশে পলিথিন টাঙিয়ে গরু বাছুর রেখেছেন। তবে নিজেদের খাবারের কষ্টের সাথে গবাদী পশুর খাদ্য সংকটে তিনি হতাশ। একটি খড়ের আটি কিনতে সামাদ বলেন, ‘গরু বেচপ্যার চাই। দালাল অর্ধেক দাম করে।’ চর সারডোব প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে টিনের চাল খুলে রেখেছেন চৌকিদার দেলোয়ার হোসেন। তিনি জানান, একদিনে তার পুরো বাড়ি বিলীন হয়ে গেছে। এখন কোথায় যাবেন জানেন না। আপাতত স্কুল মাঠে আছেন।

করোনার পর বন্যার হানায় কাহিল দিনমজুররা। তাদের অনেকের ঘরে খাবার ফুরিয়ে গেছে। এখন ত্রাণ নির্ভর জীবন। সারডোবের দিনমজুর আমিনুর জানান, অন্যান্য বছর কুমিল্লা, বগুড়া, টাঙ্গাইলে গিয়ে আয় করে বন্যার সময় খরচ করেন। এবার কোথাও যেতে পারেননি। তাই ঘরে খাবার কেনার অর্থ নেই। এ পর্যন্ত ৩০ হাজার টাকা দাদন নিয়ে জীবন ধারণ করছেন। একই অবস্থা গ্রামের শত শত দিনমজুর পরিবারের।
যারা ছোটখাট ব্যবসা করেন তাদেরও আয় রোজগার বন্ধ। আরডিআরএস বাজারে ভাঙনে হাটশেড, টয়লেটসহ বেশ কিছু স্থাপনা বিলীন হয়েছে। বাজারের পূর্বে তীব্র স্রোতে বৈদ্যুতিক পোল, গাছপালা ভেঙে বাড়িঘরে আঘাত হানছে তীব্র স্রোত।

স্থানীয় ইউপি সদস্য বাকিনুর ইসলাম ও মোক্তার হোসেন নিজেই পানিবন্দি। বাকিনুর ইসলাম জানান, বন্যায় ঘর বাড়ি হারানো মানুষগুলো খাদ্য কষ্টে আছে। উপজেলা নির্বাহী অফিসার তালিকা তৈরি করতে বলেছেন।

কুড়িগ্রাম সদরের ভারপ্রাপ্ত উপজেলা নির্বাহী অফিসার ময়নুল ইসলাম জানান, সারডোবের বন্যা কবলিতদের জন্য ত্রাণ সহায়তা ইতোমধ্যে দেয়া হয়েছে। প্রয়োজনে আরো দেওয়া হবে।