
মোঃ নজরুল ইসলাম লাভলু, কাপ্তাই প্রতিনিধি:
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ চট্টগ্রাম দক্ষিণ পূর্ব রিজিয়নের কাপ্তাই ব্যাটালিয়ন ৪১ বিজিবির ব্যবস্থাপনায় এক প্রেস ব্রিফ্রিং রোববার (২৮ ডিসেম্বর) অনুষ্ঠিত হয়েছে। স্থানীয় ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় কর্মরত গণমাধ্যম কর্মীদের সাথে এই প্রেস ব্রিফিংয়ের আয়োজন করেেন। কাপ্তাই ৪১ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ কাওসার মেহেদী উক্ত সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন, “বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা, সীমান্ত সুরক্ষা, চোরাচালান প্রতিরোধ, মাদক, মানব ও অস্ত্র পাচার রোধ, আন্তঃ সীমান্ত অপরাধ দমন, অভ্যন্তরীণ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা এবং যে কোনো জরুরি পরিস্থিতিতে সততা, নিষ্ঠা ও শৃঙ্খলার সাথে অর্পিত দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। এসব কার্যক্রম মিডিয়ার মাধ্যমে দেশের জনসাধারণকে অবহিত করার নিমিত্তে মাঠ পর্যায়ে দক্ষিণ-পূর্ব রিজিয়ন, চট্টগ্রামের পক্ষ থেকে উক্ত সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে। বাংলাদেশের মোট ৪ হাজার ৪শ’ ২৭ কিঃ মিটার (ভারতের সাথে ৪,১৫৬ ও মায়ানমারের সাথে ২৭১ কিঃ মিঃ) সীমান্তের মধ্যে দক্ষিণ-পূর্ব রিজিয়নের দায়িত্বপূর্ণ এলাকা ৫শ’ ৪০ কিঃ মিটার নিয়ে বেষ্টিত। যা চট্টগ্রাম জেলার মীরসরাই উপজেলার অন্তর্গত আমতলী হতে রাংগামাটি জেলার জুরাছড়ি উপজেলার কচুতলী পর্যন্ত বিস্তৃত। বিজিবি দক্ষিণ-পূর্ব রিজিয়নের আওতাধীন মোট ১৩টি ব্যাটালিয়ন সীমান্তের সুরক্ষা প্রদান করছে। একই সাথে দূর্গম সীমান্ত এলাকায় বসবাসরত সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা, জীবনমান উন্নয়ন এবং সামাজিক কল্যাণে বিজিবি সবসময়ই অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরী হয়েও বিজিবি দেশের সীমান্ত সুরক্ষার পাশাপাশি দেশের যে কোনো দূর্যোগ মোকাবেলায় সব সময় অসহায় ও বিপদাপন্ন জনগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়িয়েছে। সম্মানিত মহাপরিচালক, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের মূলনীতি “বিজিবি সীমান্তের নিরাপত্তা ও আস্থার প্রতীক” বাস্তবায়নে প্রতিটি বিজিবি সদস্য বদ্ধপরিকর। একটি প্রশিক্ষিত ও পেশাদার বাহিনী হিসেবে অর্পিত দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালনের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিজিবি সর্বসাধারণের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।
তিনি বলেন, দক্ষিণ-পূর্ব রিজিয়ন, চট্টগ্রামের অধীনস্থ ইউনিট সমূহ আভিযানিক কার্যক্রম পরিচালনা করে চলতি বছরে ২৯ জন আসামীসহ ৫৮ লাখ ৭৯ হাজার ১৩৫ টাকার মাদক এবং ২৭ কোটি ৭১ লাখ ৪৯ হাজার ৬৮৪ টাকার অন্যান্য মালামালসহ মোট ২৮ কোটি ৩০ লাখ ২৮ হাজার ৮১৯ টাকার অধিক মূল্যের বিভিন্ন প্রকার চোরাচালানী মালামাল আটক করতে সক্ষম হয়।
এরই ধারাবাহিকতায় দক্ষিণ-পূর্ব রিজিয়নের দায়িত্বপূর্ন সীমান্ত এলাকায় টহল তৎপরতা জোরদারসহ গোয়েন্দা নজরদারী বৃদ্ধি করা হয়েছে। এছাড়া মাদকের ভয়াল থাবা হতে যুব সমাজ তথা রাষ্ট্রকে সুরক্ষা দিতে বিজিবি কর্তৃক এনফোর্সমেন্ট সৃষ্টি ও সীমান্ত এলাকায় স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতিতে প্রতিনিয়ত মাদকবিরোধী জন- সচেতনতামূলক সভা ও সেমিনার পরিচালনা করা হচ্ছে। অস্ত্র চোরাচালান বিরোধী অভিযানে দক্ষিণ-পূর্ব রিজিয়ন, চট্টগ্রামের অধীনস্থ ইউনিট সমূহ সর্বদা তৎপর থেকে দায়িত্বপূর্ণ এলাকায় অস্ত্র চোরাচালান বিরোধী অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে সাফল্য অর্জন করে আসছে। এরই আলোকে দক্ষিণ-পূর্ব রিজিয়ন, চট্টগ্রামের আওতাধীন ইউনিট সমূহ বিশেষ অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র, গোলাবারুদ ও অন্যান্য দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে ০২টি দেশীয় রাইফেল, ২টি ১২ বোর পিস্তল, ১টি ১২ বোর শর্ট গান, ১টি ৯ এম এম যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি পিস্তল, ১টি ৮ এম এম ভারতীয় পিস্তল, ৫০০ গ্রাম গান পাউডার, ১টি ১ নলা দেশীয় বন্দুক, ১টি এসএমজি (এম-৪, এ-১), ২টি ম্যাগাজিন এবং দেশীয় অস্ত্র ৫০০টি (হাসুয়া ও দা)।
তিনি আরো বলেন, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে যে কোন অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ চোরাচালান বন্ধে প্রত্যেক বিজিবি সদস্য বদ্ধপরিকর। সাধারণ জনগণ যাতে অবৈধ অস্ত্র এবং সন্দেহজনক লোকজনের গতিবিধি সংক্রান্ত তথ্য বিজিবিকে প্রদান করে সে ব্যাপারে সীমান্ত এলাকায় প্রতিনিয়ত স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ ও জনসাধারণের উপস্থিতিতে জনসচেতনতামূলক সভার মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। ভবিষ্যতেও এধরণের কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।
সশস্ত্র সন্ত্রাসী ও বিদ্রোহী গোষ্ঠী দমন কার্যক্রমে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিজিবি তার নিজস্ব সীমান্ত রক্ষার দায়িত্ব ছাড়াও অত্র অঞ্চলে সক্রিয় দুষ্কৃতিকারীদের যেকোনো অপরাধমূলক ও সম্প্রীতি বিনষ্টকারী কর্মকান্ড প্রতিরোধে সবসময় তৎপর রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত সকল পাহাড়ি ও বাঙ্গালি জনগোষ্ঠীর সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত ও জীবনযাত্রার কাঙ্খিত মানোন্নয়নের লক্ষ্যে নিষ্ঠার সাথে কাজ করে যাচ্ছে। এজন্য নিয়মিত টহল ও অন্যান্য কার্যক্রম ছাড়াও গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে বিশেষ অপারেশন পরিচালনা করে আসছে। এ ব্যাপারে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠায় স্বাধীনতার পর হতে আজ পর্যন্ত ১শ’ ১০ জন বিজিবি সদস্য দায়িত্ব পালনকালে শহীদ হয়েছেন।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার্থে বিজিবি সরকার কর্তৃক অর্পিত দায়িত্ব পালনে সর্বোচ্চ ধৈর্য্য ও পেশাদারিত্বের পরিচয় বহন করে আসছে। বিশেষ করে জুলাই অভ্যুত্থানের পর দেশের সার্বভৌমত্ব ও সীমান্তের নিরাপত্তা রক্ষায় সীমান্ত উত্তেজনা ও পুশ-ইন রোধসহ বিভিন্ন নিরাপত্তা ঝুঁকি মোকাবেলায় বিজিবি নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। দেশের উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলা এবং জননিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে শৃঙ্খলা ও দেশপ্রেমের সহিত দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে বিজিবি সদস্যরা সর্বদা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। চট্টগ্রাম রিজিয়নের প্রতিটি সদস্য দেশ ও জনগণের নিরাপত্তা রক্ষায় এবং একটি নিরাপদ ও স্থিতিশীল নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে সর্বদা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ও অঙ্গিকারবদ্ধ হয়ে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে।
দক্ষিণ-পূর্ব রিজিয়নের অধীনস্থ বব্যাটালিয়ন সমূহ সীমান্ত সুরক্ষার পাশাপাশি সীমান্তবর্তী প্রান্তিক জনগোষ্ঠির জীবনমান উন্নয়নে নিয়মিত বিভিন্ন মানবিক ও জনকল্যাণমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। এরই ধারাবাহিকতায় নিজস্ব দায়িত্বপূর্ণ এলাকায় বিশেষ করে দূর্গম সীমান্তে বসবাসরত স্থানীয় দরিদ্র পাহাড়ী ও বাঙ্গালি জনগণকে শান্তি, সম্প্রীতি ও উন্নয়ন কর্মসূচীর আওতায় অনুদান প্রদানসহ গরীব ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা উপকরণ, শীতবস্ত্র বিতরণ এবং বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা প্রদানসহ বিভিন্ন প্রকার সহযোগিতা প্রদান করা আসছে। বিজিবি সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরী হলেও এসব মানবিক কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে সীমান্তবর্তী জনসাধারণের মাঝে আস্থার প্রতীক হয়ে উঠেছে।
এসময় তিনি বলেন, পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসরত জনসাধারণকে সাবলম্বী করার লক্ষ্যে কারিগরী প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার বরকল উপজেলাটি দুর্গম পাহাড়ী অঞ্চলে অবস্থিত। এই অঞ্চলে চলাচলের জন্য কোন রাস্তাঘাট না থাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থা তেমন উন্নত নয় এবং বরকল উপজেলায় সরকারীভাবে কোন কারিগরী স্কুল/কলেজ বা টিটিসি না থাকায় এখানে বসবাসরত জনসাধারণ কারিগরী কাজে দক্ষ হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে পারে না। বিজিবি’র তত্ত্বাবধানে পরিচালিত বরকল সীমান্ত কারিগরী প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর হতে অদ্যাবধি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিজিবি সদস্যসহ স্থানীয় বেসামরিক নাগরিকদেরকে (২৭১৮ জন) কারিগরী প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে তাদের জীবনমান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। এছাড়াও রাজনগর ব্যাটালিয়ন (৩৭ বিজিবি) কর্তৃক পার্বত্য অঞ্চলের আর্থ- সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া বেকার যুবসমাজকে দক্ষ ও আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তুলতে কারিগরি প্রশিক্ষণের আয়োজন করে। উক্ত প্রশিক্ষণে স্থানীয় পাহাড়ী-বাঙ্গালী মোট ১১০ জন প্রশিক্ষণার্থী অংশগ্রহণ করে। “অদূর ভবিষ্যতে বিজিবি স্থানীয় জনগণের সহযোগিতায় আরও উন্নয়নমুখী কর্মসূচি হাতে নেবে যাতে যুবসমাজ সঠিক পথে পরিচালিত হয় ও মাদক থেকে দূরে থাকে। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বিজিবি পার্বত্য এলাকার যুবসমাজকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে চায়, যাতে তারা মাদক, চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসবাদ থেকে দূরে থেকে দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে।
আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে বিজিবি তার নিজস্ব প্রস্তুতি নিয়ে যাচ্ছে। একটি অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন সংগঠনের জন্য বিজিবি’র প্রতিটি সদস্য তার সামর্থ্যের সর্বোচ্চ টুকু দিয়ে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে বদ্ধপরিকর। এরই ধারাবাহিকতায় পেশাদারিত্ব ও আন্তরিকতার সাথে নির্বাচনী দায়িত্ব পালনের লক্ষ্যে বিজিবি’র প্রতিটি সদস্যকে বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ ও যোগ্য করে গড়ে তোলা হচ্ছে। এছাড়াও নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্নের লক্ষ্যে নিজস্ব দায়িত্বপূর্ণ এলাকায় প্রতিটি বিওপি ক্যাম্প কর্তৃক নির্বাচন সংক্রান্ত বিষয়ে জনসচেতনতামূলক সভা আয়োজনের মাধ্যমে নির্বাচন কেন্দ্রিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ জনসাধারণকে অবহিত করা হচ্ছে।








