কক্সবাজার মেডিকেলে ৪ শিক্ষার্থীর ইমামতিতে খতমে তারাবীহ

সেলিম উদ্দীন, ঈদগাঁও: বিভিন্ন বর্ষে অধ্যয়নরত চারজন শিক্ষার্থীর ইমামতিতে কক্সবাজার মেডিকেল কলেজে (কক্সএমসি) প্রথমবারের মতো শুরু হয়েছে খতমে তারাবীহ। মেডিকেল কলেজের মসজিদে এ তারাবীহ চলছে।

ইমামতি করছেন কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের ১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী হাফেজ আহসান শাকীক, ১৪তম ব্যাচের শিক্ষার্থী হাফেজ হাসানাত আব্দুল্লাহ, ১৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী হাফেজ ইমতিয়াজ হোসেন ও ১৬তম ব্যাচের শিক্ষার্থী হাফেজ মাওলানা তাউসিফ করিম।

কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. সোহেল বকস বলেন, ‘কলেজ মসজিদের খতম তারাবীহ আমাদের ছাত্ররাই পড়াতে পারছে, বাইরে থেকে হাফেজ আনতে হচ্ছে না, এটা কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষকবৃন্দের জন্য খুবই আনন্দের ও গর্বের বিষয়। ছাত্ররাও আনন্দিত যে, তাদেরই বন্ধু কিংবা ছোট ভাই বা বড় ভাই, তাদের খতম তারাবী পড়াচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, হাফেজে কোরআন হয়েও তারা যে বিজ্ঞান বিভাগে পড়াশোনা করে কঠিন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে মেডিকেল কলেজে চান্স পেয়েছে, সেটাও দেশের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য অনুপ্রেরণাদায়ক।

হাফেজ আহসান শাকীকের অনুভূতির কথা জানিয়ে বলেন, ‘কুরআন হিফজ করা এবং সেটা ধরে রাখা অনেক বড় একটা দায়িত্ব। হিফজ ধরে রাখার জন্য নিয়মিত চর্চা রাখতে হয়। মেডিকেলে চান্স পাওয়ার পর ভয়ে ছিলাম সেই চর্চা ধরে রাখতে পারবো কিনা। আলহামদুলিল্লাহ, আমার সহপাঠীদের আন্তরিকতায় ক্যাম্পাসে রোজার প্রথম বছরই তাদেরকে নিয়ে একাই তারাবীতে কুরআন খতম দেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম হোস্টেলের বারান্দায়। পরবর্তীতে প্রতি ব্যাচেই নতুন নতুন হাফেজ ভর্তি হয় এবং আমাদের কলেজে হাফেজের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ফলে ২০২৩ সাল থেকেই হোস্টেলের মসজিদে সূরা তারাবীর পরিবর্তে আমরা খতম তারাবীহ পড়া শুরু করি। কিন্তু কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে বিগত দুই বছর একবারও আমরা সম্পূর্ণ কুরআন খতম করতে সক্ষম হইনি। তবে এইবার তারাবীহতে সম্পূর্ণ কুরআন খতম দেওয়ার ব্যাপারে আমরা সবাই দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। পাশাপাশি আমার যেই হাফেজ সঙ্গীগণ আছে তাঁরাও অত্যন্ত আন্তরিক। আল্লাহর অশেষ শুকরিয়া তিনি এমন কিছু দ্বীনি ভাই দিয়েছেন, যারা নিজেরাও দ্বীন পালন করেন এবং অন্যদেরকেও দ্বীন পালনে উৎসাহ দেন। দু’আ করি কক্সএমসিসহ সকল মেডিকেল কলেজেই নতুন নতুন হাফজ চান্স পাক এবং কলেজে শিক্ষার্থীদের দ্বারাই খতমে তারাবি পরিচালিত হওয়ার চর্চা ছড়িয়ে পড়ুক সব ক্যাম্পাসে।

হাফেজ তাউসিফ করীম বলেন, ‘হাফেজ হওয়ার পর থেকে টানা নয় বছর তারাবীহ পড়িয়েছি। সারাবছরের একাডেমিক পড়াশোনার চাপে হিফজুল কুরআনের পর্যাপ্ত সময় দেওয়া হয় না। তারাবীহ হলো একজন হাফেজের কাছে আল কুরআন রিচার্জের মতো। তারাবীহ ছাড়া কুরআন আয়ত্বে রাখা কষ্টসাধ্য। মেডিকেলে টিকে যাওয়ার পর এই আশঙ্কায় ছিলাম যে, রমাদানে তারাবীহ পড়াতে পারবো কিনা। মেডিকেলে ক্লাস আর পরীক্ষার পাশাপাশি তারাবীহর জন্য আলাদা প্রস্তুতি নেওয়া আসলেই কঠিন। আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহর অশেষ রহমতে এইবার রমাদানে কক্সএমসিতে সিনিয়র হাফেজ ভাইদের সাথে খতমে তারাবীহর ইমামতিতে অংশ নিয়েছি। এজন্য আমি প্রথমত আল্লাহর দরবারে এবং দ্বিতীয়ত কক্সএমসি পরিবারের কাছে কৃতজ্ঞ।

হাফেজ ইমতিয়াজ বলেন, ‘প্রকৃতপক্ষে হাফেজ হওয়ার পিছনে আল্লাহ তায়ালার রহমত তো ছিলই, তার পাশাপাশি আম্মুর ইচ্ছা এবং প্রচেষ্টা ছিল অন্যতম সহায়ক। হাফেজ হবার পাশাপাশি মাদ্রাসা বিভাগ থেকে মেডিকেলে চান্স পাওয়া ছিল আমার জন্য অন্যতম সৌভাগ্যের বিষয়, আলহামদুলিল্লাহ।

‘হাফেজ হওয়া যেমন আল্লাহ তায়ালার রহমত ব্যতীত সম্ভব নয়, তেমনি হাফেজ হওয়ার পর সিনায় কোরআন ধরে রাখা অন্যতম একটি চ্যালেঞ্জের ব্যাপার। তাই প্রয়োজন রেগুলার একটু একটু হলেও কোরআন পড়া, কিন্তু মেডিকেলে আইটেম, কার্ড, টার্ম ও প্রফের ব্যস্ততার কারণে রেগুলার কুরআন পড়া হয়ে ওঠে না। তাই রমজান ও খতমে তারাবীহ আমাদের হাফেজদের জন্য রহমত স্বরূপ। কারণ রমজানে খতমে তারাবীহর মাধ্যমে পুরো কুরআন একবার তেলাওয়াত করা হয়’—যোগ করেন হাফেজ ইমতিয়াজ।

প্রতিবারের ন্যায় এবারও খতমে তারাবির আয়োজন করা করে নামাজ পড়ানোর সুযোগ করে দেওয়ার জন্য কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানান তিনি। পাশাপাশি এ ধারা অব্যাহত থাকবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন ইমতিয়াজ।

কক্সবাজার মেডিকেলের ১৬তম ব্যাচের সাধারণ শিক্ষার্থী মাসুম মারিয়ান বলেন, ‘বসন্তে কোকিল যেমন, রমাদানে হাফেজ তেমন।’

তিনি বলেন, ‘দ্বীনের পথে আসার পর থেকে আলহামদুলিল্লাহ রমাদানের তারাবীহ আদায় করা হয়। এ বছর আমার জীবনের তৃতীয় খতমে তারাবীহ। এর আগে ঢাকায় দুবার খতমে তারাবীহ পড়ার সুযোগ হয়েছে। তবে এবারের তারাবীহর আনুসাঙ্গিকতা একটু ভিন্ন। নিজের মেডিকেলের চারজন হাফেজ ভাইয়ের ইমামতিতে তারাবীহর নামাজ পড়ার অনুভূতিটা অন্যরকম।

তিনি বলেন, ‘তারাবীহর প্রথম দিন প্রথম রাকাআতে পঞ্চম বর্ষের হাফেজ শাকিক ভাইয়ের হৃদয়স্পর্শী তিলাওয়াত শুনে অজান্তে আমার চোখ থেকে অশ্রু ঝরতে থাকে, আমি বুঝতেও পারিনি কেন এমন হয়েছে। এ হয়ত মহামহিম খোদাতায়ালার বাণীর প্রভাব, যা ভাইয়ার কণ্ঠনিঃসৃত হয়ে আমার অন্তর প্রকম্পিত করেছে।

তিলাওয়াতের বৈশিষ্ট্যের বর্ণনা দিয়ে মেডিকেলে শিক্ষার্থী মাসুম বলেন, ‘ব্যাচমেট হাফেজ তাওসিফ করিমের তিলাওয়াতের কোনো তুলনায় হয় না। তার সুললিত সাবলীল স্রোতপ্রবাহের ন্যায় তিলাওয়াত শুনে চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। হাফেজ হাসানাত ভাই, হাফেজ ইমতিয়াজ ভাইয়ের তিলাওয়াতেও আমি মুগ্ধ হয়েছি। আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ তা’আলা হাফেজগণকে মেডিকেল পেশায় এনে দুনিয়া ও আখিরাত উভয় দিক থেকে সম্মানিত করেছেন। দোয়া করি, আল্লাহ তা’আলা যেন তাঁদের ঈমান ও আমলে বারাকাহ দান করুন।