হাড় ব্যথা হলো একটা উপসর্গ যা বেদনারূপে, একটা বা তার বেশি হাড়ে সংবেদনশীলতা অথবা অস্বস্তিরূপে প্রকাশ পায়। হাড় ব্যথা সাধারণত হাত ও পায়ের লম্বা হাড়গুলোকে আক্রান্ত করে। হাড় ব্যথা ভীষণভাবে একজন ব্যক্তির প্রাত্যহিক জীবন ও সাধারণ কাজকর্ম ও চলার পথকে ব্যাহত করে। হাড় ব্যথা বিভিন্ন উপসর্গের মধ্যে একটি মাত্র । ব্যথা কখনো একাকী এবং কখনো অন্যান্য উপসর্গসহ প্রতীয়মান হয়। প্রতিদিনের হাড় ব্যথা একজন লোককে চিন্তাগ্রস্ত ও বিষন্ন করে তোলে। হাড় ব্যথা মানুষের স্বাভাবিক জীবনের গুণগতমানকে সাংঘাতিকভাবে বাধাগ্রস্ত করে। অধিকাংশ ব্যথা হয় হাড়ের বাইরের সংবেদনশীল আবরণ (পেরিওসটিয়াম) আক্রান্ত হওয়ার জন্য। পর্যাপ্ত স্নায়ু থাকে বিধায় মেরুদণ্ডের হাড়ের (কশেরুকা) সবচেয়ে বেশি ব্যথা হয়। কিছুক্ষেত্রে হাড়ের গঠন দুর্বল (যেমন, ওসটিওমালাসিয়া) ও হাড় অকেজো (যেমন, ওসটিওনেকরোসিস) হলে হাড়ের ভেতরের আবরণের (এনডোসটিয়াম) উপর চাপ সৃষ্টি হয়।
ফলে তীব্র ব্যথার উদ্রেক হয়।
বিভিন্ন রোগের কারণে বিভিন্ন হাড়ের বিভিন্ন উপসর্গসহ ব্যথা
অসটিওআর্থ্রাইটিসে অতিরিক্ত হাড় বাইরের সংবেদনশীল আবরণকে ইরিটেশনের মাধ্যমে ব্যথার উদ্রেক করে। জোড়ার সাইনোভাইটিস নিকটবর্তী হাড়কে ব্যথায় আক্রান্ত করে। এ ছাড়াও জোড়ার স্থানচ্যুতি এবং অভ্যন্তরীণ অসামঞ্জস্যতা (পেশি, লিগামেন্ট ও মেনিসকাস ইনজুরি) নিকটবর্তী হাড়ে ব্যথা প্রসার করে। হাড় ব্যথার সঙ্গে শারীরিক অবসাদগ্রস্ত ও ওজন কমতে থাকলে বুঝতে হবে রোগী ক্যান্সারে আক্রান্ত।
হাড়ের প্রাথমিক ক্যান্সার ছাড়াও ফুসফুস, থাইরয়েড গ্রন্থি, স্তন, বৃক্ক (কিডনি) এবং প্রোস্টেটের ক্যান্সার হাড়ে বিস্তৃত হয়ে তীব্র ব্যথার উদ্রেক করে। শিশুদের হাড়ে ব্যথা হলে বুঝতে হবে সম্ভবত সে রিকেটে (ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি অভাব) ভুগছে । জ্বরসহ হাড়ে ব্যথা হলে ইনফেকশন হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। অসটিওপোরোসি হলে অল্প আঘাতেই ব্যথা হয় এবং হাড় ভেঙে যায়। অসটিওমালাসিয়ায় আক্রান্ত রোগীর হাড় নরম হয়, বেঁকে যায় এবং ব্যথা হয়। অতিরিক্ত কাজ, খেলাধুলা, প্রশিক্ষণ এবং হাঁটা ও দৌড়ানোর পর লেগের (টিবিয়া) হাড়ে স্ট্রেস ফ্র্যাকচারের জন্য ব্যথা হয়।
হাড় ব্যথার কারণ
১. হাড়ে আঘাত ও হাড় ভাঙা;
২. ইনফেকশন (সেপটিক ও টিবি);
৩. সেপটিসেমিয়া;
৪. টিউমার ও ক্যান্সার (ওসটিওসারকোমা);
৪. ক্যালসিয়াম এবং ভিটামিন ডি ও সি’র অভাব;
৫. বাতজ্বর (রিউমেটিক ফিভার);
৬. জোড়ার পেশি, লিগামেন্ট, ক্যাপসুল (আবরণ) ও মেনিসকাস ইনজুরি;
৭. রিউমাটয়েড, গাউটি, অসটিও, ইনফেকটিভ এবং প্রদাহ আর্থ্রাইটিস;
৮. রক্তশূন্যতা (সিকল সেল এনিমিয়া) এবং ব্লাড ক্যান্সার (লিউকেমিয়া);
৯. অসটিওপোরোসিস ও অসটিওমালাসিয়া;
১০. হাইপারপ্যারাথাইরোডিজম ও হাইপারক্যালসিমিয়া;
১১. পেজেটস ডিজিস;
১২. মাল্টিপোলমায়েলোমা;
১৩. নিউরোব্লাস্টোমা;
১৪. লেপ্টোস্পাইরোসিস ও এস্পারজিলোসিস;
১৫. ধূমপান ও মদপান।
চিকিৎসা: চিকিৎসার শুরুতে ব্যথা সম্পর্কে জ্ঞাত হতে হবে যে, কোনো হাড়ের ব্যথার উৎপত্তি- বাহু, নিম্নবাহু, হাত, মেরুদ-, লেগ বা গোড়ালির হাড়। আরও জানতে হবে প্রথম কখন ব্যথা শুরু হয়? কতদিন ধরে ব্যথা? ব্যথা কি বেড়ে যাচ্ছে? ব্যথা ছাড়া অন্যান্য উপসর্গ কি? সঠিক কারণ অনুসন্ধানপূর্বক প্রয়োজনীয় চিকিৎসা প্রদান করলে হাড় ব্যথা নিরাময়ে সুফল পাওয়া যাবে। ব্যথার কারণ নির্ণয় শারীরিক পরীক্ষা ছাড়াও রক্তের বিভিন্ন পরীক্ষা, প্রেসাব পরীক্ষা, অস্থিমজ্জা পরীক্ষা, এক্স-রে, বিএমডি, বোন স্ক্যান, সিটি স্ক্যান এবং এমআরআই করতে হবে। কায়িক পরিশ্রম করলে হাড় মজবুত ও শক্তিশালী হয়। ফলে হাড় ব্যথা কম হয়। উপযুক্ত ব্যায়াম যেমন নিয়মিত হাঁটা, জগিং, সিঁড়ি দিয়ে ওঠা-নামা করা এবং ওজন বহন করা হাড়কে মজবুত ও শক্তিশালী করে। কিশোর বয়সে কায়িক পরিশ্রম করলে হাড়ের পরিমাণ বেড়ে যায় এবং হাড় মোটা, মজবুত ও শক্তিশালী হয়। ফলে বৃদ্ধ বয়সে হাড় ব্যথা ও ভাঙা কম হয়। সুষম খাদ্য এবং কিশোর বয়সে ১৩০০ মিলি গ্রাম, ৫০ বছর পর্যন্ত ১০০০ মিলি গ্রাম এবং ৫০ বৎসরের ঊর্ধ্বে ১২০০ মিলি গ্রাম ক্যালসিয়াম দৈনিক সেবন করা উচিত। ধূমপান ও মদপান থেকে বিরত থাকা উচিত। পর্যাপ্ত পরিমাণ ক্যালসিয়াম এবং ভিটামিন সি ও ডি সেবনে হাড় ব্যথা প্রতিরোধ ও লাঘব হয়। হাড়ের বিভিন্ন উপাদানের ক্ষয় পূরণের জন্য পরিমিত ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি ও বিসফোসফোনেট (এলেনড্রোনেট, ইটিড্রোনেট ও রাইসোড্রোনেট) সেবন, হরমোন রিপেসমেন্ট থেরাপি এবং রেলোকিফন ও ক্যালসিটোনিন ইনজেকশন পুশের প্রয়োজন হতে পারে। ব্যথার ওষুধ ছাড়াও প্রাথমিক কারণের জন্য কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি, শল্য ও আর্থ্রোস্কোপিক চিকিৎসা এবং অন্যান্য ওষুধ গ্রহণ করতে হবে ।
লেখক: জনস্বাস্থ্য বিষয়ক লেখক ও গবেষক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক খাজা বদরুদজোদা মডার্ন হাসপাতাল, সফিপুর, কালিয়াকৈর, গাজীপুর।