লোহাগাড়ার সাবেক ওসি শাহজাহান ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা

লোহাগাড়া থানা ও সন্দ্বীপ থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শাহজাহান (৫৪) ও তার স্ত্রী ফেরদৌসী আকতার ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) দাখিলকৃত সম্পদ বিবরণীতে ১ লাখ ৭১ হাজার ৭৩৬ টাকার সম্পদ অর্জনের তথ্য গোপন করে মিথ্যা তথ্য প্রদান এবং ১ কোটি ৪৮ লাখ ৪ হাজার ৪১৩ টাকার সম্পদ স্থানান্তরের অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়েছে।

বৃহস্পতিবার (২৮ জুলাই) দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয় চট্টগ্রাম-২ এর উপ-পরিচালক মো. আতিকুল আলম বাদি হয়ে মামলাটি দায়ের করেন।

এর আগে গত ৪ জানুয়ারি ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) দাখিলকৃত সম্পদ বিবরণীতে প্রায় সাড়ে ৪৯ লাখ টাকার তথ্য গোপন করার অভিযোগে মো. শাহজাহানের বিরুদ্ধে দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয় চট্টগ্রাম-২ এর উপ-পরিচালক রতন কুমার দাশ বাদি হয়ে মামলাটি দায়ের করেছিলেন। বর্তমানে পরিদর্শক মো. শাহজাহান ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ চট্টগ্রাম অঞ্চলে কর্মরত আছেন। তিনি কুমিল্লা জেলার লালমাই থানার কাতালিয়া গ্রামের সুলতান আহমদের ছেলে। বর্তমানে নগরের খুলশী থানার লালখান বাজার হাইলেভেল রোডে স্ত্রীসহ শাহজাহান বসবাস করেন।
মামলার বিষয়টি বাংলানিউজকে নিরশ্চিত করেন মামলার বাদী দুদকের উপ-পরিচালক মো. আতিকুল আলম।

মামলায় অভিযোগ আনা হয়, লোহাগাড়া থানার ওসি থাকাকালে ২০১৭ সালে মো.শাহজানের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের একটি অভিযোগের প্রাথমিক অনুসন্ধানকালে সত্যতা পাওয়া যায়। এরপর ২০১৯ সালের ১৪ মার্চ শাহজাহান ও তার স্ত্রী ফেরদৌসী আকতারের বিরুদ্ধে পৃথক পৃথক সম্পদ বিবরণী দাখিলের আদেশ জারির নির্দেশ দেওয়া হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে এরপর ২০১৯ সালের ১৭ এপ্রিল ফেরদৌস আক্তার দুর্নীতি দমন কমিশনে সম্পদ বিবরণী দাখিল করেন। যা যাচাইয়ের জন্য দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয় চট্টগ্রাম-২ এর একটি অনুসন্ধান টিম গঠন করা হয়। আসামি ফেরদৌসী আকতারের দাখিল করা সম্পদ বিবরণীতে ৩ কোটি ২১ লাখ ৮৬ হাজার টাকার স্থাবর সম্পদ অর্জনের তথ্য দিয়েছেন।

তবে তার স্বামীর কাছ থেকে দান হিসেবে প্রাপ্ত ৪৩ লাখ ১০ হাজার ৮৬৭ টাকার সম্পদ বাদ দিয়ে ঘোষিত স্থাবর সম্পদ মোট ২ কোটি ৭৮ লাখ ৭৫ হাজার ১৩৩ টাকা। এছাড়া দুদক যাচাইকালে তার নামে মোট ২ কোটি ৮০ লাখ ৪৬ হাজার ৮৬৭ টাকার স্থাবর সম্পদ পেয়েছে। এছাড়া তিনি তার দাখিল করা সম্পদ বিবরণীতে নিজ নামে মোট ৪২ লাখ ৬৪ হাজার ৯৩১ টাকা মূল্যের অস্থাবর সম্পদ অর্জনের ঘোষণা দেন।

সম্পদ বিবরণী যাচাইকালে তার নামে ৪২ লাখ ৬৪ হাজার ৯৩১ টাকার অস্থাবর সম্পদ পাওয়া যায়। অর্থাৎ, দান বাদে তিনি তার নামে সর্বমোট ৩ কোটি ২১ লাখ ৪০ হাজার ৬৪ টাকা সম্পদ অর্জনের ঘোষণা দেন। যাচাই-বাছাইকালে তার নামে সর্বমোট ৩ কোটি ২৩ লাখ ১১ হাজার ৭৯৮ টাকার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ পাওয়া যায়। ফেরদৌসী আকতার কর্তৃক দাখিল করা সম্পদ বিবরণীতে ১ লাখ ৭১ হাজার ৭৩৪ টাকার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ অর্জনের তথ্য অসৎ উদ্দেশ্যে গোপনপূর্বক মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন। উল্লেখ্য, ১ লাখ ৭১ হাজার ৭৩৪ টাকা তিনি চট্টগ্রাম জেলার খুলশী থানার লালখান বাজার পরশ মঞ্জিল, ১৪ নম্বর হাইলেভেল রোড এলাকায় নির্মিত বাড়ি নির্মাণ ব্যয় বাবদ গোপন করেছেন। ফেরদৌসী আকতার ২০০৬-০৭ কর বছর থেকে ২০২০-২১ কর বছর পর্যন্ত গৃহসম্পত্তির আয়, বৈদেশিক রেমিটেন্স, ব্যবসার আয় ও অন্যান্য উৎস বাবদ সর্বমোট ২ কোটি ৪৩ লাখ ৫১ হাজার ৪২৭ টাকা বৈধভাবে আয় করেছেন। তবে তিনি তার আয়কর রিটার্নে পোল্ট্রি খামার এবং মৎস্য খামার থেকে ২০১৫-১৬ করবর্ষে ১০ লাখ টাকা, ২০১৬-১৭ করবর্ষে ৪৯ লাখ ৮০ হাজার টাকা, ২০১৭-১৮ করবর্ষে ৫১ লাখ টাকা, ২০১৮-১৯ করবর্ষে ১৮ লাখ ৭২ হাজার ৬৮৫ টাকা, ২০১৯-২০ করবর্ষে ৯ লাখ ৭৮ হাজার ৫০ টাকাসহ মোট ২ কোটি ২৯ লাখ ৩০ হাজার ৭৩৫ টাকা আয় প্রদর্শন করেছেন। কিন্তু বর্ণিত ব্যবসা সম্পর্কিত ট্রেড লাইসেন্স ছাড়া অন্যকোনো রেকর্ডপত্র যেমন- সরকারি কর্মকর্তার স্ত্রী হিসেবে ব্যবসা করার জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতিপত্র, মৎস্য এবং পোল্ট্রি খামারে মিটার সংযোগের শুরু থেকে অদ্যাবধি যাবতীয় রেকর্ডপত্র এবং পরিবেশ ছাড়পত্র, খামারের লেনদেন সংক্রান্তে ব্যাংক স্টেটমেন্ট, মালামাল ক্রয়-বিক্রয় সংক্রান্তে চালান-বিল ভাউচার সংক্রান্ত কোনো প্রামাণ্য রেকর্ডপত্র পাওয়া যায়নি।

তাই তার প্রদর্শিত ওই আয় গ্রহণযোগ্য নয়। ফেরদৌসী তার স্বামী ওসি মো. শাহজাহানের সহযোগিতায়, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং দুর্নীতি ও ঘুষের মাধ্যমে অর্জিত অপরাধলব্ধ অর্থ স্থানান্তর, হস্তান্তর ও রূপান্তরপূর্বক ভোগ দখলে রাখার খারাপ উদ্দেশ্যে পোল্ট্রি ও মৎস্য ব্যবসার আয় দেখিয়ে ২ কোটি ২৯ লাখ ৩০ হাজার ৭৩৫ টাকা ভুয়া আয় প্রদর্শন করেছেন। ফেরদৌসী আকতারের পারিবারিক ব্যয়, কর পরিশোধ ও অন্যান্য ব্যয় বাবদ মোট খরচ ৫৪ লাখ ৯৩ হাজার ৮০৪ টাকা। এছাড়া তাদের যৌথনামে উত্তরা ব্যাংক লালখান বাজার শাখার বাড়ি নির্মাণের জন্য গ্রহণ করা ১২ লাখ টাকা ঋণের সুদ হিসেবে মোট ৭ লাখ ৩৪ হাজার ২৭০ টাকা পরিশোধ করেছেন। তার অংশের পরিমাণ ৩ লাখ ৬৭ হাজার ১৩৫ টাকা, যা তার খরচ হিসেবে গণ্য হবে। এছাড়া তিনি মাইক্রোবাস কেনার জন্য ঢাকা ব্যাংক সিডিএ এভিনিউ শাখা থেকে ৬ লাখ টাকা ঋণের সুদ হিসেবে মোট ২ লাখ ৯৯ হাজার ৭৯৫ টাকা পরিশোধ করেছেন। ওই ৩ খাতে তার সর্বমোট খরচ ৬১ লাখ ৬০ হাজার ৭৩৪ টাকা।

সংগৃহীত রেকর্ডপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, ফেরদৌসী আকতার তার স্বামী শাহাজাহানের সহযোগিতায় ২ কোটি ৮০ লাখ ৪৬ হাজার ৮৬৭ টাকার স্থাবর ও ৪২ লাখ ৬৪ হাজার ৯৩১ টাকার অস্থাবরসহ সর্বমোট ৩ কোটি ২৩ লাখ ১১ হাজার ৭৯৮ টাকার সম্পদ অর্জন করেছেন। একই সময়ে তিনি মোট ৬১ লাখ ৬০ হাজার ৭৩৪ টাকা পারিবারিক ব্যয়সহ অন্যান্য ব্যয় করেছেন। অর্থাৎ ব্যয়সহ তার মোট অর্জিত সম্পদের পরিমাণ ৩ কোটি ৮৪ লাখ ৭২ হাজার ৫৩২ টাকা। ওই সম্পদ অর্জনের বিপরীতে তার বৈধ ও গ্রহণযোগ্য আয়ের উৎস পাওয়া যায় ২ কোটি ৩৬ লাখ ৬৮ হাজার ১১ টাকা। এক্ষেত্রে ফেরদৌসী আকতার ১ কোটি ৪৮ লাখ ৪ হাজার ৪১৩ টাকার সম্পদের জ্ঞাতসারে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন,২০১২ সালের সম্পৃক্ত অপরাধ দুর্নীতি ও ঘুষ এর মাধ্যমে জ্ঞাত আয়ের উৎসের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণভাবে সম্পদ স্থান্তান্তর, হস্তান্তর ও রুপান্তর ভোগ দখলেররাখার অপরাধ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হওয়ায় মো. শাহজাহান ও তার স্ত্রী ফেরদৌসী আকতারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ এর ২৬ (২) ও ২৭(১) ধারা, মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ৪(২) ও ৪(৩) ধারা, ১৯৪৭ সনের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারাসহ দণ্ডবিধির ১০৯ ধারায় মামলাটি দায়ের করা হয়েছে।

মামলার বাদী দুদকের উপ-পরিচালক মো. আতিকুল আলম বলেন, পুলিশ কর্মকর্তা মো. শাহজাহান বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুদকে দাখিলকৃত সম্পদ বিবরণীতে তথ্য গোপন করার অভিযোগে গত ৪ জানুয়ারি মামলা হয়েছে। এই মামলাটি মূলত মো. শাহজাহানের স্ত্রী ফেরদৌসী আকতারের। স্ত্রীর সহযোগী হিসেবে মো. শাহজাহানকে আসামি করা হয়েছে।