ভয় আর আতঙ্কের ভানগড় দুর্গ- আসলে কী আছে সেখানে?

রাজস্থানের আলবর জেলায় অবস্থিত ভানগড় কেল্লা এশিয়া মহাদেশের সবচেয়ে ভীতিকর স্থানগুলোর একটি। সন্ধ্যা ৬টার পর কেল্লার ভেতরে কাউকে অবস্থান করতে দেওয়া হয় না- এটা রীতিমতো সরকারি আদেশ। তাই বিকাল সাড়ে ৫টা থেকেই কেল্লার ভেতর থেকে পর্যটকদের বের করে দেওয়া শুরু করে নিরাপত্তাকর্মীরা- যাতে ভুলেও কেউ নির্দিষ্ট সময়ের পর সেখানে রয়ে না যায়। বলা হয়, গভীর রাতে এই কেল্লায় নর্তকীদের প্রেতাত্মার নাচসহ নানান অতিপ্রাকৃত ঘটনা ঘটে যা স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে সহ্য করা অসম্ভব।

বিশ্বের সেরা দশটি হন্টেড স্থানের একটি হিসেবে ধরা হয় ভানগড় কেল্লাকে। জানা গেছে, বার দুয়েক কিছু দুঃসাহসী সেখানে রাতের অন্ধকারে ঢোকার চেষ্টা করে। কিন্তু পরিণতি ভালো হয়নি তাদের। তেমনি দুই স্থানীয় দুঃসাহসী তরুণও সন্ধ্যা ঘনিয়ে যাওয়ার পর দুর্গের পাঁচিল টপকে ভেতরে ঢুকেছিল। কিন্তু তারা আর ফিরেনি। মারা গেছে কিনা তাও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। শুধু তাদের আর কোনোদিন দেখা যায়নি কোথাও।

দিনের আলো মিলিয়ে যেতেই যেন আতঙ্ক এসে ভর করে

এর বেশকাল পরে আরেকটি গ্রুপ যায় সেখানে। তিনজনের দলটি ভূতের অভিজ্ঞতা নিতে সন্ধ্যার পর আলো জালিয়ে ঢুকে যায় দুর্গে। এক বন্ধু চাইলো পুরো রাতটা সেখানে কাটিয়ে দিতে। তার সঙ্গীরা নিষেধ করলো। কিন্তু অসম্ভব সাহসী লোকেরা কেমন হয় জানেনই তো। তিনি ভেতরে রইলেন আর তার অপেক্ষায় দূর্গের বাইরে গাড়িতে অবস্থান নিলেন তার বন্ধু ও গাড়ির ড্রাইভার।

পরদিন ভোর হলে কেল্লার ভেতরে বন্ধুকে খুঁজতে গিয়ে অর্ধমৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। তাকে উদ্ধার করে যখন দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তখন গাড়িটি হঠাৎ দুর্ঘটনার শিকার হয়- মারা যায় দুই বন্ধুসহ গাড়ির ড্রাইভার। এরপর থেকে সেই ‘অভিশপ্ত’ কেল্লায় রাত কাটানো একেবারেই নিষেধ হয়ে যায়। এভাবেই কেল্লাটির ভীতিকর গল্প ছড়িয়ে পড়ে চতুর্দিকে। দিনদিন এর সঙ্গে যোগ হয় আরও কল্পিত অনেক কাহিনী।

এখনও পর্যটকরা ভানগড় গেলে সূর্যাস্তের আগেই ফিরতি পথ ধরেন। আর রাতে থাকতে হলে যেতে হয় কমপক্ষে ৫০ কিলোমিটার দূরের সিরিস্কায়, হোটেলে।

দিনের আলোয় খা খা করে ভানগড়ের সড়ক

ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, একসময় ভানগড় এক সমৃদ্ধ নগর ছিল। এই নগরটি বিরান হয়ে যায় স্রেফ একজন তান্ত্রিকের অনাচারী অসৎ কাজের জন্য- লোকমুখে এ ধারণা প্রচলিত। ঐতিহাসিক তথ্য মতে- ১৫৭৩ সালে আমের রাজ্যের রাজা ভগবন্ত দাস তার কনিষ্ঠ পুত্র মাধো সিংহের জন্যে এই নগর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তার পরবর্তী তিন অধস্থন পুরুষ এই নগর শাসন-পরিচালন করে।

কথিত আছে, ভানগড়ের রাজকুমারী রত্মাবলী অসম্ভব সুন্দরী আর বুদ্ধিমতি ছিলেন। সিন্ধিয়া নামের এক তান্ত্রিক রাজকুমারীর রূপে পাগলপারা হয়ে পড়ে। কালোজাদুতে সিদ্ধহস্ত তান্ত্রিক চাইলো রত্মাবলীকে নিজের করে পেতে। কিন্তু তার পক্ষে তো রাজকুমারীকে বিয়ে করা সম্ভব নয়! অসম্ভবকে সম্ভব করতে সে ফন্দি আঁটতে থাকে। একদিন রাজকুমারী রত্মাবলীর দাসী যখন রাজকুমারীর জন্য বিশেষ ধরনের সুগন্ধি তেল আনতে যাচ্ছিল তখন সিন্ধিয়া দাসীকে কায়দা করে মন্ত্রপড়া তেল দিয়ে দেয়। ওই তেলের প্রভাবে সম্মোহিত হয়ে রাজকুমারী তার কাছে চলে আসবে- কুটিল জাদুকর এমনটাই ফাঁদ পেতেছিল। কিন্তু দাসী যখন তেলের শিশি নিয়ে প্রাসাদে ফিরছিল তখন হঠাৎ তার হাত থেকে তা একটি বিশাল পাথরের ওপর পড়ে ভেঙে যায়। ভাঙা শিশির তেল গড়িয়ে পড়ে পাথরে। এরপর যাদুই তেলের আবেশে ওই পাথরটি তান্ত্রিকের দিকে চলতে শুরু করে। জাদুমন্ত্রতাড়িত পাথরটি চলতে চলতে একপর্যায়ে তান্ত্রিকের ওপর চেপে বসে এবং নির্মমভাবে তার মৃত্যু হয়। কেউ কেউ অবশ্য দাবি করেন, রাজকুমারী সখীদের সঙ্গে নিয়ে নিজেই গিয়েছিলেন সুগন্ধি তেল সংগ্রহে। এসময় তিনি তেল নিয়ে যাদুকরের তেলেসমাতি বুঝে ফেলেন। তাই তিনিই যাদুই তেলের শিশিটি একটি বড়সর পাথরে আছার দিয়ে ভেঙে ফেলেন।

অপরদিকে, নিজের অপকর্ম বুমেরাং হয়ে তার নিজেকেই নির্মম মৃত্যুর স্বাদ দেওয়ার মুহূর্তেই প্রতিশোধ নিতে মরিয়া তান্ত্রিক সিন্ধিয়া ভানগড় নগরকে বিনাশ করে ফেলার কায়দা করে ফেলে। কথিত আছে, তান্ত্রিকের মৃত্যুর পরের দিনের সূর্য ওই নগরের কেউ আর দেখেনি- রাজকুমারী রত্মাবলীসহ নগরের সবাই এক রাতেই শেষ হয়ে যায়। ঘটনাটি কীভাবে ঘটেছিল- তা নিয়ে নানা জনের নানা বয়ান রয়েছে।

এমন একটি বয়ান হচ্ছে, ভানগড় একরাতে শেষ হয়নি। মৃত্যুর আগে সিন্ধিয়া রাজকুমারীকে বলে যায়, রাজপরিবারের কাউকে সে বাঁচতে দেবে না। আর খোদ রত্মাবলীকে সে মরার পরেও ছাড়বে না। এর কিছুদিন পর প্রতিবেশী রাজ্যের সঙ্গে ভানগড়ের ভীষণ যুদ্ধ বাঁধে। যুদ্ধে রাজপরিবারসহ গোটা ভানগর ধ্বংস হয়ে যায়। স্থানীয়দের বিশ্বাস ওই কেল্লায় নাকি তান্ত্রিক ও রত্নাবতীর অতৃপ্ত আত্মা এখনও ঘুরে বেরায়।

অনেকেই বিশ্বাস করেন, রহস্যজনকভাবে এভাবে অকালে মৃত্যুর কারণে তাদের আত্মা অতৃপ্ত রয়ে গেছে। তাই এখনও ওই এলাকায় তাদের আত্মা ঘুরে বেড়ায়। তবে আরেক পক্ষ মনে করেন, অতৃপ্ত আত্মা বলে কিছু নেই। সেখানে সব জ্বিন-শয়তানরা আখরা বানিয়ে বসেছে। তারাই যা কিছু ভৌতিক আচরণ করে মানুষকে ভয় দেখায়।

রাজকুমারী রত্মাবলীর ঘটনা ছাড়াও আরেকটি ঘটনাকেও ভানগড় বিরান হওয়ার পেছনের কারণ বলে মনে করেন অনেকে। তাদের মতে, রাজা ভগবন্ত দাসের পুত্র মাধো সিংহের (ছত্র সিংহের বাবা। তার সময়েই ধ্বংস তথা বিলীন হয়ে যায় ভানগড়) জন্য কেল্লা তৈরি হচ্ছিল তখন বাধা দেন গুরু বালুনাথ নামের এক ক্ষমতাধর সাধু। কেল্লার পরিকল্পিত চত্বরের এককোণে বালুনাথের আশ্রম ছিল। বালুনাথ মাধোকে বলেছিলেন, কেল্লাতে তার আপত্তি নেই। তবে এর ছায়া যেন তার আশ্রমের ওপর না পড়ে। তেমন হলে তিনি কেল্লা ধ্বংস করে দেবেন। এই হুমকি দিয়েই কিন্তু বালু ক্ষান্ত হননি। রাজবংশের সবাইকে বিনাশ করার চূড়ান্ত ঘোষণাও দিয়েছিলেন তিনি।

সাধুর কথায় গুরুত্ব দিয়ে মাধো কথা দিয়েছিলেন, কেল্লা সেভাবেই নির্মিত হবে। কিন্তু কেল্লা দাঁড় করানোর পর দেখা গেল, দিনের দিনে কিছু সময়ের জন্য হলেও কেল্লার ছায়া বালুনাথের আশ্রমকে ঢেকে দিচ্ছে। ফল যা হওয়ার তাই হলো। ক্ষুব্ধ বালুনাথ কেল্লার সঙ্গে সঙ্গে গোটা ভানগর রাজ্য ধ্বংস করে দিলেন।

ভানগড় কেল্লার দরজার উচ্চতা প্রায় ৩০ ফুট। ঢুকলেই সামনে বাগান। বাগানে ফুলের সুবাস থাকে সব সময়। প্রচণ্ড খরায়ও বাগানে কোনো ফুল নাকি শুকিয়ে যায় না- এমিন বিশ্বাস স্থানীয়দের। এও এক রহস্য বটে! বাগান পেরিয়ে সামনে এগুলেই জলাধার দেখতে পাবেন। স্থানীয় ভাষায় একে ‘বাউলি’ বলে। বাউলির এই অংশ থেকেই অনেকে নূপুরের আওয়াজ শুনতে পেয়েছেন। যদিও কেল্লার কোনো শব্দ বাইরে থেকে শোনা যায় না।

স্থানীয় ভাষায় পর্যটকদের জন্য পুরাতত্ত্ব বিভাগের সতর্কবাণী; যার প্রথমেই আছে- সূর্যাস্তের আগে ও পরে প্রবেশ নিষেধ

এখনকার দিনে ভানগড় নগরে আপনি প্রবেশ করতে গেলে প্রথমেই চোখে পড়বে নগরের একসময়কার জমজমাট বাজারটির বিরান রূপ। রাস্তার পাশের দোকানগুলোর দেওয়াল এখনও দাঁড়ানো আছে কিন্তু তাদের ছাদগুলো ধসে পড়া। দেখে মনেই হয় না কখনো সেখানে ছাদ জাতীয় কিছু ছিল। সার্বিক পরিবেশ-পরিস্থিতি দেখে ধারণা হবে- কেউ ধারালো তলোয়ার দিয়ে ওইসব ঘরের ছাদগুলো কেটে ফেলে দিয়েছে অথবা দোকান ঘরগুলো বানানোই হয়েছে এমন কায়দায়। অনেকেই বলেন, নগরের একসময়কার জমজমাট নাচমহল (নর্তকী মহল) থেকে এখনও রাতে ঘুঙুরের শব্দ শোনা যায়।

তবে নামীদামী বাস্তুবিদরা ওই নগর পরিদর্শন করে এর বিভিন্ন দিক পরীক্ষা করে মত দিয়েছেন যে, পরিত্যক্ত ওই নগরীতে প্রচুর পরিমাণে বাদুর ও তেলাপোকা আবাস গেড়েছে। রাতে তাদের নড়াচড়ার কারণেই অমন আওয়াজ হয় যা ভবনের দেওয়ালে ও অন্যত্র প্রতিধ্বণিত হয়ে ঘুঙরু বাজার মতো শব্দের রূপ নেয়। ভানগড়ের ইতিহাস আর সত্যিকারে সেখানে কী ঘটেছিল এবং এখন কেন এসব হচ্ছে তার একটা যৌক্তিক কারণ সন্ধানীদের মত হচ্ছে এটা।

একের পর এক দাঁড়িয়ে আছে শক্ত দেয়ালের ঘর, তবে নেই তাদের ছাদ

কিন্তু তারপরও কেউ কেউ প্রশ্ন করেন, সেখানে কি সত্যিই কোনো ভূত বা অশরীরির দল আস্তান গেড়ে আছে? এই প্রশ্নের মীমাংসায় সুপার ন্যাচারাল পাওয়ার নিয়ে কাজ করেন- এমন একদল প্যারানরমাল ইনভেস্টিগেটর সেখানে গিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে অনেকেই সেখানে নেগেটিভ অ্যানার্জির উপস্থিতির কথা স্বীকার করেছেন। কিছু কিছু তদন্তকারীর ক্যামেরায় অদ্ভূত অদ্ভূত সব বস্তুর ছবিও ধরা পড়েছে বলে দাবি করা হয়- কিন্তু কেউ এমন দাবি করেননি যে এগুলোই ভূত বা ভূতের ছবি। তাদের মতে, গবেষণা এখনও চলছে। যতক্ষণ পর্যন্ত তা শেষ না হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত এমন কিছু বলা যাবে না।

কেউ প্রশ্ন করছেন, ভূত যদি নাই হবে তবে সেখানে নেগেটিভ অ্যানার্জির উপস্থিতি কেন? আর অনেকেই জানতে চাইতে পারেন যে নেগেটিভ অ্যানার্জি বলতে কী বোঝানো হচ্ছে? এ প্রসঙ্গে কিছু প্যারানর্মাল ইনভেস্টিগেটরের ব্যাখ্যা হচ্ছে- এমন শক্তি যা দীর্ঘকাল ধরে একই স্থানে আটকে আছে এবং কোনো কারণে যার স্বাভাবিক চলাচল থমকে আছে, এমন কিছুকে নেগেটিভ অ্যানার্জি বলা হয়।

বিজ্ঞান কখনো এটা বলে না যে ভূত আছে। কিন্তু ভূতের অস্তিত্বকে অস্বীকারও করে না সোজাসাপ্টা। প্যারানর্মাল অ্যাক্টিভিস্টরা বলেন, বিজ্ঞানের এমন অবস্থানের পেছনের কারণ হচ্ছে, ‘ভূত আছে’ এমন প্রমাণের চেয়ে ‘ভূত নেই’- এমন প্রমাণ বিজ্ঞানের হাতে অনেক বেশি রয়েছে। এ সূত্রে গুরুত্বপূর্ণ কথাটি হচ্ছে এই যে- বিজ্ঞানের হাতেও ভূতের অস্তিত্বের প্রমাণ রয়েছে! এখন হয়তো এর প্রমাণ তুলনামূলক কম আছে। এই লেখায় কোনো অন্ধবিশ্বাসকে উৎসাহিত বা প্রচারের চেষ্টা করা হচ্ছে না, শুধুমাত্র প্রাপ্ত তথ্যাদির সূত্রে কথা বলা হচ্ছে।

প্যারানরমাল সোসাইটি অব ইন্ডিয়ার প্রধান গোবিন্দ কুমার এ প্রসঙ্গে বলেন, যে কোনো স্থান যা ৪০ দিনের চেয়ে বেশি বন্ধ থাকে সেখানে নেতিবাচক শক্তি এসে আবাস গাড়ে। ভানগড়ের কেল্লা তো বছরে পর বছর বিরান থেকেছে। এমন অবস্থায় সেখানে নেতিবাচক শক্তির অনুভব হওয়া স্বাভাবিক।

তবে তিনি আরও বলেন, এমনিতে- আমি এবং আমার দল যখন সেখানে তদন্তে যাই তখন সেখানে এমন কিছু অনুভব হয়নি যার ওপর ভিত্তি করে বলা যায় যে ভানগড়ে ভূত বা আত্মার মতো কোনো ভয় জাগানিয়া বিষয়ের অস্তিত্ব রয়েছে।

শেষ করার আগে আরেকটি কথা। এখান থেকে শুধু সূর্যাস্তের আগে পর্যটকদের বের করে দিয়েই কর্তৃপক্ষ দোয়িত্ব শেষ করেনি। স্থানটিকে ঘিরে ভীতিকর কাহিনী এতই কঠিন শেকড় গেড়েছে যে সূর্যাস্তের পর আর সূর্যোদয়ের আগে এখানে প্রবেশ একেবারেই নিষেধ করে দিয়েছে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া কর্তৃপক্ষ।