অপহরণ এর ১৪ বছর পর বাড়ি ফেরার গল্প

 

নিজস্ব প্রতিবেদক:: দক্ষিণ চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জলদী মখজনুল উলুম (বাইঙ্গাপাড়া) বাঁশখালী বড় মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা বিশিষ্ট আলেমেদ্বীন পীরে কামেল মরহুম মাওলানা মোহাম্মদ আলী সাহেবের নাতী, মিশর আল আজাহার বিশ্ববিদ্যালয় ও সৌদি আরব মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র অধ্যাপক ড. মাওলানা শিব্বির আহমদের ছোট ভাই লন্ডন “মসজিদুল আবরার” জামে মসজিদের খতিব, আল জামিয়াতুল আরবিয়া মদিনাতুল উলুম রাউজান দেওয়ানপুর মাদ্রাসার সাবেক মুহতামিম সহ অসংখ্য মসজিদ মাদ্রাসার মুহতামিম ও খতিব, জলদী মখজনুল উলুম বাইঙ্গাপাড়া (বাঁশখালী বড় মাদ্রাসার) মতোয়াল্লী মরহুম আলহাজ্ব মাওলানা আবু তাহের সাহেবের তৃতীয় পুত্র সাংবাদিক মুহাম্মদ মিজান বিন তাহেরের ছোট ভাই হাফেজ মুহাম্মদ ছফওয়ান। পরিবার সূত্রে জানা যায়,২০০৮ সালের (১০ অক্টোবর) জলদী মাখজনুল উলুম মাদ্রাসা (বাঁশখালী বড় মাদ্রাসার) সামনে থেকে নিঁখোজ হয়ে যায়। সে সময় তার বয়স ছিল ১০ বছর। নিখোঁজের ১৪ বছর পর গত শুক্রবার (৮ জুলাই) বিকেলে সে নিজ বাড়িতে ফিরে আসে।

এ বিষয়ে মোঃ ছফওয়ানের মেঝ ভাই বাঁশখালীতে কর্মরত দৈনিক মানবকন্ঠ ও দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ পত্রিকার বাঁশখালী প্রতিনিধি তরুন সাংবাদিক মুহাম্মদ মিজান বিন তাহের জানান- ‘আমার ছোট ভাই টি ২০০৮ সালে আমাদের মাদ্রাসার সামনে থেকে হারিয়ে যায়। সে তখন চট্টগ্রাম সেগুন বাগান তা’লীমুল কুরআন মাদ্রাসার হিফজ বিভাগের ছাত্র ছিলেন। তার হারিয়ে যাওয়া নিয়ে ২০০৮ সালের ১৩ অক্টোবর বাঁশখালী থানায় আমার মরহুম পিতা নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে বাঁশখালী থানায় সাধারণ জিডি নং- ৪৬৫ দায়ের করেন এবং বিভিন্ন প্রশাসনিক দপ্তরে অভিযোগ করেন। দীর্ঘ দিন অনেক খুঁজাখুঁজির পর তাকে না পেয়ে আমরা অনেক চিন্তিত ছিলাম। মনে মনে ভাবতাম ভাই টি আমাদের জিবনে আর ফিরে আসবে না। আমার ভাইটি আমাদের মাঝে ফিরে আসায় আমি মহান আল্লাহ তা’য়ালার দরবারে হাজার শুকরিয়া আদায় করছি। আমার ভাইটি একজন মহৎ ব্যক্তির সার্বিক সহযোগিতায় বাংলাদেশের নাগরিকতা তৈরি করে স্মার্ট কার্ড বানিয়ে আল্লাহ রহমতে অনেক কস্টের মাধ্যমে বাংলাদেশে ফিরে আসে। ১৪ বছর পর দেশে ফিরে মোঃ ছফওয়ান বলেন, আমি ২০০৮ সালে আমাদের মাদ্রাসার সামনে দোকানের পাশে রাস্তায় দাঁড়িয়েছিলাম তখন একটি মাইক্রোবাস দাঁড়ায়। মাইক্রোবাস থেকে ৭-৮ জন লোক নেমে মাদ্রাসার সামনে দোকানে থেকে চা নাস্তা খেয়ে বিভিন্ন চিপস ও খাবার দ্রব্য জিনিস পত্র ক্রয় করল। পাশে আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম দেখে তারা আমাকে জিজ্ঞেস করল তোমার বাড়ি কোথায়? আমি বললাম আমার বাড়ি তো এখানে, তখন তারা বলল বাঁশখালী ইকোপার্ক কতটুকু দূরে? তখন আমি বললাম একটু দূর আছে, তখন তারা আবারও বল্লো, তুমি কখনো গেছো,আমি বললাম হ্যাঁ আমি গেছি অনেকবার , বল্ল আমাদেরকে দেখিয়ে দিতে পারবা আমি বললাম হে পারব, তারা তখন আমাকে গাড়িতে উঠতে বল্লো । তখন আমি তাদেরকে নিয়ে বাঁশখালী ইকোপার্কে যাই , সেখান থেকে বিকেলে আমরা রওনা হই। তখন তারা আমাকে আমার বাড়ির সামনে নামিয়ে না দিয়ে চট্টগ্রাম শহর নিয়ে যাই আমি অনেক কান্নাকাটি করতে থাকি, এক পর্যায়ে তারা বলল আমরা আবার বাসায় দিয়ে আসব তোমাকে । চট্টগ্রাম শহরে কোন একটা বাসায় নিয়ে যায়, সেখানে দেখি সবাই হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন তাদের। সেখানে ৫-৭ জন মত মহিলা ও বাচ্চা কাচ্চার ও ছিল। তখন তাদের সাথে আমাকে সহ জোর পূর্বক একটি বাস গাড়িতে তুলে নিল। আমি কান্নাকাটি করতে করতে অজ্ঞান হয়ে পড়ি এরপর আমাকে কোথায় নিয়ে যায় আমি আর জানিনা। পরবর্তীতে আমার জ্ঞান ফিরে দেখি আমি কারো বাসায়। আমি প্রতিদিন কান্নাকাটি করছি আমাকে বাড়ীতে যেতে দাও, আমাকে বাড়িতে দাও, কিন্তু তারা কিছুই আমার কথা বুঝতো না। এভাবে কান্নাকাটি করতে করতে দিন যায়, মাস চলে যায়। কি নির্মম ছিল তাদের আমি এখন হারে টের পাচ্ছি। পরে তাদের বাসা থেকে আমাকে একটি রেস্টুরেন্টে দিয়ে বিভিন্ন কাজ কর্ম করায়। আমি মনে মনে ভাবতাম চট্টগ্রামের কোন এক জায়গায় আছি। এভাবে যেতে যেতে দীর্ঘ এক বছর পর আমি জানতে পারি এটা শান্তিপুর কলকতা ভারত। তখন আমি আরো ভেঙে পরি কিছু করার নাই এভাবে ৪-৫ বছর বিনা পয়সায় রেস্টুরেন্টে চাকুরী করি। তার মধ্যে একে একে ২ জনের সাথে আমার দেশে পালিয়ে যাওয়ার প্ল্যান করি। কিন্তু তারা পালিয়ে যাওয়ার বিষয় নিয়ে রেস্টুরেন্টের মালিক কে বলে দে, তখন তারা আমাকে কঠোর নজরদারীতে রাখে।বিভিন্ন হুমকি ও ভয়-ভীতি দেখায়। এরপর আমাদের সাথে থাকা রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার বাচ্চু ভাই বাংলাদেশী জেনে তাকে বলি আমাকে আপনার সাথে দেশে নিয়ে যাবেন। সে আমাকে কথা দে তার সাথে আমাকে দেশে নিয়ে আসবে। তখন আমি তাকে বিশ্বাস করে রেস্টুরেন্টে আসা কাস্টমাররা মাঝেমধ্যে নাস্তা দিলে যে টাকা বকশিস দিত সেগুলো আমি ম্যানেজার বাচ্চু ভাইকে জমা দিতাম। পরে দেখি সেও আমাকে পেলে চলে আসে। এরপর আমি মনে মনে ভাবতাম কান্নাকাটি করতাম আর জিবনেও দেশে ফিরতে পারব না। এর কিছু দিন আরেক জন বাংলাদেশী লোক তার সাথে আমাদের পরিচয় হয়। সে প্রায় সময় আমাদের রেস্টুরেন্টে আসত বিভিন্ন মালামাল সাপ্লাই দিতে। কেউ না দেখে মত তাকে মাঝে মধ্যে আমি আপ্যায়ন করতাম, সিগারেট কিনে দিতাম, এক পর্যায়ে তার সাথে ২-৩ বছর যাবৎ বন্ধুত্ব করে, তাকে সব কথা খুলে বলি। পরে আল্লাহর রহমতে এই মহৎ ভাইটি আমাকে সার্বিক সহযোগিতা করে বিভিন্ন পরিকল্পনা হাতে নি। তার পরিকল্পনা অনুযায়ী আমি তার মাধ্যমে বাংলাদেশী নাগরিকত্ব ভোটর আইডি কার্ড তৈরী করে বিভিন্ন কাগজ পত্র সংগ্রহ করে দেশে পালিয়ে আসি। এরপর বাংলাদেশে এসে একটি গ্রুপে ৬-৭ মাস যাবৎ চাকুরী করে। পরবর্তীতে আমি আমার মা-বাবা বাড়ি ঘরের খবর নিয়ে আস্তে আস্তে আমি মালিককে বলে ছুটি নিয়ে ঢাকা থেকে সরাসরি চট্টগ্রাম আসি। চট্টগ্রামে এসে কিছু ই চিনতে পারছিনা। একটা অটোরিক্সা সিএনজিকে বল্লাম আমি বাঁশখালী যাব কত টাকা নিবে। তখন সিএনজি ড্রাইভার আমাকে কর্ণফুলী নতুন ব্রীজ এলাকায় নামিয়ে দেয়। এরপর দেখলাম কর্ণফুলী তত্তার ব্রীজ নেই। কিছু ই চিনতে পারতেছি না। আরেকটি সিএনজি ড্রাইভার কে বল্লাম আমি বাঁশখালী যাব। তখন সে আমার কাছ থেকে ৫০০ টাকা নিয়ে আমাকে বাঁশখালী নিয়ে আসল। তবু ও আমি কিছু ই চিনতে পারছি না। ড্রাইভার কে বল্লাম আমাকে বাঁশখালী থানার আগে মাদ্রাসার সামনে নামিয়ে দিলে হবে, পরপর জিজ্ঞাসা করে করে আমি মাদ্রাসার সামনে আসি। এরপর দুপুর থেকে এসে কিছুই চিনতে পারছি না। সব দেখি এলোমেলো। দীর্ঘ ২টা থেকে ৬টা পযর্ন্ত বিভিন্ন ঘুরাঘুরি করে সন্ধ্যায় আমার ভাই মিজানের বাড়ি কোনটা, জিজ্ঞাসা করে বাড়িতে আসলাম। তখন কেউ দেখি আমাকে চিনতেছি না। পরবর্তীতে সবাইকে চিনতেছি। তারা ও আমাকে চিনতেছে। আমি আল্লাহ পাকের দরবারে হাজারো শুকরিয়া আদায় করি। আমি আমার মা -ভাই -বোন আত্বিয় স্বজন সবাইকে চিনতে পারছি। আজ আমি আমার দেশ গ্রামের মানুষকে পেয়ে অনেক আনন্দিত হয়েছি। মায়ের কোল যে কতটা শান্তির, তা ভাষায় প্রকাশের নয়। বাকিটা জীবন মাকে নিয়ে কাটিয়ে দিব। ’সবাই আমার পরিবারের জন্য দোয়া করবেন। এ খবর এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে পৌর এলাকার জলদী বাহার উল্লাহ পাড়া গ্রামে হারানো ছফওয়ানকে একনজর দেখার জন্য ভিড় জমে।