উপমহাদেশে ইসলাম প্রচারে গরিবে নেওয়াজ খাজা মঈনুদ্দীন চিশতি (রহ.)’র অবদান

যুগে যুগে দেশে দেশে যাঁরা পাহাড়সম প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে, অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট ভোগ করে ইসলামের প্রচার ও প্রসারে অবদান রেখেছেন, তাঁদের মধ্যে ‘সুলতানুল হিন্দ’ খাজা গরিবে নেওয়াজ মঈনুদ্দীন চিশতি আজমিরী সঞ্জরী (রহ.)-এর নাম বিশেষভাবে স্মরণীয়। আজ থেকে হাজার বছর আগে তিনি জন্মভূমির মায়া ত্যাগ করে ইসলামের আলো জ্বালাতে ভারতবর্ষে এসেছিলেন। হজরত খাজা গরিবে নেওয়াজ (রহ.) খোরাসানের অন্তর্গত চিলতান প্রদেশের গন্জর নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা-মাতা উভয় দিক দিয়েই তিনি ছিলেন রাসুল (সা.)-এর বংশধর। খাজা গরিবে নেওয়াজের বিশেষত্ব ছিল তাঁর সাধনা। তিনি বড় আশ্চর্যজনকভাবে রেয়াজত সাধনা করতেন এবং বছরের বেশির ভাগ সময় রোজা রাখতেন। সারা রাত ইবাদত-বন্দেগি ও নফল নামাজে মশগুল থাকতেন। সুদীর্ঘ ৭০ বছর ধরে যে অজুতে এশার নামাজ পড়েছেন, সে অজুতেই ফজরের নামাজ আদায় করেছেন। দুনিয়াবি ধন-সম্পদের প্রতি তাঁর কোনো মোহ ছিল না, নজরানা হিসেবে যা কিছু পেতেন, তাও তিনি গরিব-দুঃখীদের দান করতেন। অনুসারীদের সব সময় বলতেন, যেন গরিব-দুঃখী,এতিম-অনাথ-মিসকিনদের প্রতি মায়া করা হয়। পরোপকারী মনোভাব ছিল বলেই শিশুকালে নিজের জামাকাপড় অন্য শিশুকে দান করতেন। সত্যের সন্ধানে তিনি জন্মভূমি ত্যাগ করে জ্ঞান অর্জনের কেন্দ্র বোখারায় চলে আসেন। অল্প সময়ের মধ্যে কোরআন মুখস্থ করেন এবং ধর্মের বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করেন। এরপর তিনি আল্লাহর পথের পথিকদের সন্ধানে বের হন। বিশেষ করে তিনি নিশাপুরের তৎকালীন প্রখ্যাত বুজুর্গ হজরত খাজা ওসমান হারুনী (রহ.)-এর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করে ধন্য হন। সাধনায় সিদ্ধিলাভের পর ওসমান হারুনী তাঁর মাথায় একটি চারকোণা টুপি পরিয়ে দেন। টুপিটি হজরত ওসমান হারুনী তাঁর পীর হজরত শরিফ জিলানী (রহ.) থেকে পেয়েছিলেন। ওসমান হারুনী ছাড়াও তিনি শেখ নাজমুদ্দীন কোবরা (রহ.), শেখ ইছমাঈল (রহ.) এমনকি বড়পীর হজরত আবদুল কাদের জিলানী (রহ.)-এর সানি্নধ্যও লাভ করেন। বড়পীর (রহ.) তাঁকে বলেছিলেন, ‘ইরাকের বেলায়ত সাহাবুদ্দীন সোহরাওয়ার্দীকে দান করা হয়েছে আর তোমাকে দান করা হয়েছে হিন্দুস্তানের বেলায়ত।’ ৫৮৬ হিজরি মোতাবেক ১১৯০ খ্রিস্টাব্দে খাজা মঈনুদ্দীন চিশতি (রহ.) মাত্র ৪০ জন সঙ্গী নিয়ে হিন্দুস্তানে আসেন। হিন্দুস্তানে প্রবেশ করে তিনি প্রথমে লাহোরে দাতা গনজে বক্স (রহ.)-এর মাজার শরিফে ৪০ দিন চিল্লা করেন। এরপর তিনি বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের প্রতি ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করে ইসলাম গ্রহণের আহ্বান জানান। সে সময় হিন্দু ধর্মাবলম্বীর সংখ্যাই ছিল বেশি। হিন্দুরা খাজা বাবার প্রস্তাবের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। কিন্তু খাজা বাবা ধৈর্য, সাহস ও আধ্যাত্দিক শক্তির বদৌলতে ওই সব প্রতিকূল অবস্থা মোকাবিলা করেন। একবার এক হিন্দু যুবক হুজুরকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে ধারালো ছুরি নিয়ে মাহফিলে প্রবেশ করে এবং ওত পেতে বসে থাকে। খাজা বাবা ওই যুবকের মনোভাব বুঝতে পেরে সুধামিশ্রিত কণ্ঠে বললেন, ‘চুপচাপ বসে আছো কেন? ছোরা দিয়ে তোমার কাঙ্ক্ষিত কাজ সমাধা করো, অযথা সময় নষ্ট করে লাভ কী?’ এ কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে যুবকটি ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে গেল এবং খাজা বাবার কারামত দেখে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে ফেলল। এ খবর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়লে হিন্দুরা আরো বেশি কৌতূহলী হয়ে খাজা বাবাকে অনুসরণ করতে লাগল। খাজা বাবার হৃদয়স্পর্শী বক্তব্য ও অনুপম আদর্শে মুগ্ধ হয়ে দলে দলে হিন্দু ইসলাম গ্রহণ করে মুসলমান হয়ে গেল। খাজা গরিবে নেওয়াজ (রহ.) এমন এক সময় আসেন যখন গোটা হিন্দুস্তান শিরক, কুফর ও পৌত্তলিকতার অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল। কিছুদিন দিলি্লতে অবস্থানের পর খাজা বাবা পুণ্যভূমি আজমির যাওয়ার সংকল্প করেন। আজমির পেঁৗছে তিনি সে সময়ের হিন্দুরাজা পৃথি্বরাজের প্রতিরোধের মুখে পড়েন। পৃথি্বরাজ খাজা বাবাকে উৎখাতের জন্য বিখ্যাত জাদুকর রামদেওকে পাঠান। কিন্তু তিনি খাজা বাবার বেলায়তি শক্তির কাছে মাথা নত করে মোহাম্মদ সাআফি নাম ধারণ করে মুসলমান হয়ে গেলেন। মোহাম্মদ ঘুরি হিন্দুস্তানের মুসলমান শাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি (রহ.)-এর বেলায়তি শক্তির প্রভাবে সারা ভারত উপমহাদেশে ইসলামের প্রচার ও প্রসার উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। মুহাম্মদ ঘুরির বিজয়ের পেছনেও খাজা বাবার দোয়া ও বেলায়তি শক্তির প্রভাব ছিল। তাঁর বেলায়তি শক্তির প্রভাবেই আজমিরের ঐতিহাসিক গুরুত্ব বৃদ্ধি পেতে থাকে। তবে ওই বেলায়তি শক্তির মূল ভিত্তি ছিল আল্লাহর ওপর অনুপম আস্থা ও বিশ্বাস। ভারতবর্ষের সিংহাসনে আরোহণ না করেও তিনি এমন এক সিংহাসন রচনা করে দিয়েছেন, যার নাম ‘লা-শরিক আল্লাহ মোহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ।’ এ কারণেই জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে লাখো মানুষ তাঁর বাতেনি ফায়েজ লাভের উদ্দেশ্যে আজমির শরিফ গমন করে। খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী ছিলেন পাক-ভারত উপমহাদেশে ইসলাম প্রচারে কিংবদন্তিতুল্য একজন ঐতিহাসিক ছুফি ব্যক্তিত্ব। ইসলাম প্রচারের ক্ষেত্রে তার এ সাফল্যের মূলে ছিল সুদৃঢ় ঈমান, কঠোর সাধনা ও নেক আমল। এছাড়া পবিত্র কোরআন ও হাদিসের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক, তেজোদীপ্ত প্রভাব বিস্তারকারী আধ্যাত্মিক শক্তি, আল্লাহ ও তার রাসূল (সা.)-এর প্রতি অগাধ ভালোবাসা, নিঃস্বার্থ মানবসেবা, ইসলামি শিক্ষার পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন ও তরিকার প্রতি পূর্ণ আনুগত্য প্রভৃতি। শুধু তাই নয়, খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি (রহ.) ইসলামের বাণী সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়ার জন্য ভারতবর্ষে বিভিন্ন স্থানে অনেক খানকা প্রতিষ্ঠা করেন। এসব খানকা ছিল উচ্চতর জ্ঞানচর্চার প্রধান কেন্দ্র। সাধারণত জ্ঞান-পিপাসুদেরই এসব খানকায় থাকার অনুমতি দেয়া হতো। উপমহাদেশে ইসলাম প্রচার করা সহজ হতো না। তবে একথা সত্য যে, তার আগমনের বহু আগেই ভারতবর্ষে ইসলামের আগমন ঘটে এবং অনেক সুফিসাধক ইসলাম প্রচারে নিজেদের নিয়োজিত করেন। কিন্তু খাজা সাহেবের আগমনে ইসলাম প্রচারে এক বিপ্লব ঘটে এবং তা একটি সামাজিক বিপ্লবে রূপান্তরিত হয়। ভারতবর্ষে তার আগমনে সময়-মানুষে মানুষে ভেদাভেদ চরম পর্যায়ে উপনীত হয়। সাধারণ মানুষ উচ্চ বর্ণের লোকদের দ্বারা নিগৃহীত হতো প্রতিনিয়ত। এমতাবস্থায় খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি (রহ.) এসব জাতিভেদ এবং স্পৃশ্য-অস্পৃশ্যতার বেড়াজাল ছিন্ন করে তাওহিদের দর্শন প্রচার করেন। ফলে তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে দলে দলে লোক ইসলাম গ্রহণ করতে থাকে।
তিনি স্বীয় পীর উসমান হারুনীর নির্দেশে ভারতে আগমন করে মানুষকে ইসলামের দাওয়াত দেন এবং তারই মাধ্যমে বহু লোক ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি কুতুবুদ্দীন বখতিয়ার খাকীকে খিলাফতের দায়িত্ব অর্পন করে সিলসিলার ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখেন। নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষ মনের বাসনা পূরণের জন্য খাজা বাবার উছিলা নিয়ে আল্লাহর দরবারে জানায় প্রাণের আকুতি। খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী ৬৩৩ হিজরীর ৫ রজব দিবাগত রাত অর্থাৎ ৬ রজব সূর্যোদয়ের সময় পর্দা গ্রহন করেন। তখন তার বয়স হয়েছিল ৯৭ বছর। তার বড় ছেলে খাজা ফখরুদ্দীন চিশতী তার নামাজে জানাজায় ইমামতি করেন। প্রতিবছর ১লা রজব হতে ৬ রজব পর্যন্ত আজমির শরীফে তার সমাধিস্থলে ওরছ অনুষ্ঠিত হয়, যাতে নানা ধর্ম, বর্ণ ও গোত্রের মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ হতে সমবেত হয়।
শেষ কথা : খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী রহ.-এর আদর্শিক জীবনধারা থেকে শিক্ষা নেয়ার মতো অনেক কিছু রয়েছে। তাঁর আদর্শিক জীবনের সামান্য অংশ যদি আমরা পালন করতে সক্ষম হই। তাহলে আল্লাহ ও তাঁর প্রিয় রাসূল (সা.) এর সন্তোষ্টি অর্জন সম্ভব। আল্লাহ আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে সুলতানুল আউলিয়া খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী রহ.-এর আদর্শ বাস্তবায়ন করার তৌফিক দান করুন। আল্লাহতায়ালা তাকে জান্নাতের উচুঁ মাকাম দান করুন। আমীন।

লেখক :ফখরুল ইসলাম নোমানী :হেড অব ফাইন্যান্স এন্ড একাউন্টস এপিক হেলথ কেয়ার লিমিটেড