সুফিসম্রাট হযরত মাওলানা সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারী (রহ.)’র জীবন দর্শন

মহান রাব্বুল আলামিন দুনিয়াবী আকাশকে যেমন সাজিয়েছেন অসংখ্য নক্ষত্রের মাধ্যমে তেমনি আধ্যাত্মিক আকাশকে সুশোভিত করেছেন তার প্রিয় বান্দা তথা গাউস, কুতুব, আবদাল, আওতাদ, নুক্বাবা, নুজাবা প্রমুখের মাধ্যমে। তাঁর সেই আধ্যাত্মিক আকাশের উজ্জ্বল নক্ষত্র হলেন যুগশ্রেষ্ঠ অলিয়ে কামেল মাইজভান্ডার দরবার শরীফের প্রাণপুরুষ গাউছুল আজম শাহছুফী হযরত মাওলানা সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারী (রহ.)।

আল্লাহর বন্ধু তথা মাহাবুব অলি আউলিয়াদের কোথায়ও কোন ভয় নেই। কারণ অলি আউলিয়ারা আল্লাহ তায়ালার রাজী খুশির অনুকলে নিজের জীবনকে পরিচালিত করে থাকেন। আল্লাহতায়ালা তাঁর মাহাবুব বান্দাদের সম্পর্কে আমাদেরকে অনেকটা ধমকের সাথে সতর্ক করে কুরআনে আয়াত নাজিল করে দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘মনে রেখো যারা আল্লাহর বন্ধু, তাদের না কোন ভয় ভীতি, না তারা চিন্বান্বিত হবে।’ (সূরা ইউনুছ : ৬২)। ইসলামের সোনালি ইতিহাসে কিছু কীর্তিমান মহাপুরুষের আগমন ঘটেছে, যাঁরা নিজেরাই ছিলেন একেকটি ইতিহাস। হেদায়তের ধারা অব্যাহত রাখার জন্য শাহছুফী হযরত মাওলানা সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারী (রহ.) মানুষের মনে খোদা-প্রেম জাগ্রত করার শিক্ষা দিয়ে গেছেন। তার আল্লাহ প্রদত্ত আধ্যাত্মিক শক্তির পরশে মানুষ আজ আলোর পথের পথিক।

জন্ম ও বংশপরিচয় : হযরত মাওলানার পিতা মৌলভী সৈয়দ মতিউল্লাহ। মাতা সৈয়দা খায়ের-উন-নেছা বিবি। ১৮২৬ সালে চট্রগ্রাম জেলার ফটিকছড়িতে জন্ম গ্রহন করেন। ১৯০৬ সালে সৃষ্টি জগতের এলাহীর নিকট মহামিলনে সম্মানিত হন। শাহছুফী হযরত মাওলানা সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারী (রহ.) মাইজভান্ডারী তরিকার প্রতিষ্ঠাতা।

শিক্ষা জীবন : হযরত মাওলানার শৈশব কেটেছে নিজ বাড়ির মক্তবে। সে সময় চট্রগ্রামে ধর্মীয় উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ সুবিধা ছিল না। তিনি উচ্চ শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে কলিকাতা গমণ করেন। কলিকাতা মাদরাসা থেকে হাদিছ, ফেকাহ, তাফছির, মান্তেক, হেকমত, বালাগত, উছুল আকায়েদ, ফিলছফা ও ফরায়েজ শাস্ত্রের উপর বিশেষ পান্ডিত্যে অর্জন করেন।

কর্ম জীবন : হিজরী ১২৬৯ সালে তিনি যশোর জেলায় কাজী (বিচারক) পদে যোগদান করেন। কিন্তু বিচারিক কাজের প্রতি অনীহার কারণে ১২৭০ হিজরীতে কাজী পদ থেকে পদত্যাগ করে কলকাতার মুন্সি বুয়ালী মাদ্রাসায় প্রধান মোদার্রেছের পদে যোগদান করেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি একই সাথে তিনি মুন্সেফী অধ্যয়নের কাজও চালিয়ে যান।

স্বভাব–চরিত্র : হযরত মাওলানা ছিলেন রাসুলে করিম (সা.) এর পূর্ণ অনুসারী। মানুষে মানুষে তিনি কোনো পার্থক্য করতেন না। বাদশাহ-ফকিরকে দেখতেন একই নজরে। এমনকি গরিবকে দিতেন তিনি প্রাধান্য। আমির লোকদের হাদিয়া তিনি গ্রহণ করতেন না। তবে গরিবের হাদিয়া গ্রহণ করতেন সন্তুষ্ট চিত্তে। জীবনে শাহি–দরবারে কখনো গমন করেননি। তাঁর দরবারে যত হাদিয়া উপস্থিত, হতো তিনি দরিদ্র ও অভাবগ্রস্ত লোকদের মধ্যে তা বিলিয়ে দিতেন। মানুষের দুঃখ সহ্য করতে পারতেন না। তা দূর করার জন্য ব্যাকুল ছিলেন। তিনি বন্ধুবৎসল, বিনয়ী, মিষ্টভাষী ও অমায়িক ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। অপরের সালামের অপেক্ষা তিনি করতেন না। আগেই সালাম দিতেন, মুসাফাহার জন্য আগেই হাত বাড়িয়ে দিতেন।

সাংসারিক জীবন : হযরত মাওলানা ১২৭৬ হিজরীতে ৩২ বছর বয়সে আজিম নগর নিবাসী মুন্সী সৈয়দ আফাজ উদ্দিন আহমদের কন্যা সৈয়দা আলফুন্নেছা বিবির সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। কিন্ত বিয়ের ছয় মাসের মাথায় তাঁর স্ত্রী মারা যান। সেই বছরই তিনি পুনরায় সৈয়দা লুৎফুন্নেছা বিবিকে বিয়ে করেন। ১২৭৮ হিজরী সালে তাঁর প্রথম মেয়ে সৈয়দা বদিউন্নেছা বিবি জন্মগ্রহন করেন। কিন্তু মেয়েটি চার বছর বয়সে মারা যায়। এরপর তাঁর আরোও একটি ছেলে জন্মগ্রহন করে অল্প দিনের মধ্যে মারা যান। অতঃপর ১২৮২ হিজরীতে দ্বিতীয় পুত্র সৈয়দ ফয়জুল হক (রহ.) এবং ১২৮৯ হিজরী সালে দ্বিতীয় কন্যা সৈয়দা আনোয়ারুন্নেছা জন্মগ্রহন করেন। তাঁর দ্বিতীয় পুত্রও পিতার পুর্বে ইন্তেকাল করেন।

বায়াত গ্রহণ : তিনি বড় পীর হযরত মহিউদ্দিন আবদুল কাদের জিলানী (রহ.)-এর বংশধর এবং ওই তরিকার খেলাফতপ্রাপ্ত হজরত শায়খ সৈয়দ আবু শাহামা মুহাম্মদ ছালেহ আলকাদেরি লাহোরি সাহেব (রহ.) এর হাতে বায়াত গ্রহণ করে ‘গাউছিয়াতে’র ও পরবর্তী সময়ে পীরে তরিকতের নির্দেশক্রমে হজরত শাহ্ সুফি সৈয়দ দেলাওয়ার আলী পাকবাজ (রহ.) থেকে ‘কুতুবিয়তে’র ফায়েজ হাসিল করেন।

জ্ঞান ও ওয়াজ নসিহত : হযরত মাওলানার কোরআন, হাদীস, ফিকাহ, ইতিহাস ও ইসলামের অন্যান্য দিকে জ্ঞান ছিল খুবই গভীর। ধর্মীয় ব্যাপারে তাঁর প্রজ্ঞা যুগের শ্ৰেষ্ঠ আলেমগণকে পর্যন্ত বিস্মিত করেছে। কিন্তু তিনি সে জ্ঞান নিয়ে পাণ্ডিত্য প্রদর্শন করাকে ঘৃণা করতেন। তাঁর আলাপ আলোচনা ছিল অতি সহজ ও প্রাঞ্জল। তিনি ক্ষুদ্রতম মতভেদ নিয়ে মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির ঘোর বিরোধী ছিলেন। সকল মুসলমান ঈমানী ভাই-তাদের মধ্যে সৌহার্দ বজায় রাখার জন্য চেষ্টা করাকে তিনি ঈমানী কর্তব্য মনে করতেন। সর্ব সাধারণের মাঝে আলেম সমাজের মর্যাদা সমুন্নত করতে তিনি আজীবন চেষ্টা চালিয়ে গেছেন।

রিয়াজত ও কামালিয়াত অর্জন : হযরত মাওলানার কানে আজানের ধ্বনি আসা মাত্র নামাজের জন্য অস্থির হয়ে পড়তেন। মাত্র সাত বছর বয়স থেকে জামায়াতের সাথে নামাজ আদায় করতেন। শৈশব থেকেই তার জগত স্রস্টার নৈকট্য লাভের প্রতি প্রবল আগ্রহ ছিল। জীবনের এক পর্যায়ে এসে হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রহ.) এর বংশীয় আওলাদ হযরত শাহ সূফী দেলওয়ার আলী পাকবাজের সান্নিধ্য লাভ করেন। হযরত দেলওয়ার আলী পাকবাজের ছোট ভাই হযরত আবু শাহমা ছালেহ লাহোরীর সাথে হযরত মাওলানার খুব ঘনিষ্ট সর্ম্পক ছিল। শাহছুফী হযরত মওলানা সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারী (রহ.) এর সাথে যখন হযরত আবু শাহমা ছালেহ লাহোরীর প্রথমবার দেখা হয়, বিদায় নেয়ার সময় তখন আবু শাহমা ছালেহ লাহোরী, শাহছুফী হযরত মওলানা সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারী (রহ.) এর সাথে মোসাফাহ করে বলেছিলেন, জীবনে এ প্রথম কারো সাথে মোসাফাহ করলাম। আজ আল্লাহ আমার মনের আশা পূর্ণ করেছেন। হযরত আবু শাহমা ছালেহ লাহোরী কোন একটি দিনও শাহছুফী হযরত মওলানা সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারী (রহ.) কে না দেখে থাকতে পারতেন না। একদিন দেখা সাক্ষাত না হলে, তিনি হযরত মাওলানার এর বাসায় চলে আসতেন। শাহছুফী হযরত মওলানা সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারী (রহ.) তরিকতের উচ্চ মোকামের এ দুই আউলিয়ার সান্নিধ্যে থেকে ফয়জ বরকত লাভ করেন।

আধ্যাত্মিকতা : হযরত মাওলানা আধ্যাত্মিক জ্ঞান সাধন কর্মে প্রচুর মোশাহিদা করেন। তিনি মোরাকাবা মোশাহিদায় নিজেকে নিয়োজিত রাখতেন। তাহাজ্জুত সহ-ফজরের নামাজের পর মোরাকাবা করতেন। এছাড়াও তিনি নিয়মিত কোরান এবং হাদিসের চর্চা করতেন। প্রিয় রাসুল (সা:) এর ভালোবাসাময় আকুলতায় তারা হয়েছেন সৃষ্টির দিশারী, পথহারাদের পাঞ্জেরী, তাদের নূরানী কর্নকুহরে যেন প্রতিনিয়ত ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয় নিপীড়িতদের আহাজারি, বঞ্চিতদের রোনাজারি। একজন মানুষকে যে সুমাহান উদ্দেশ্য নিয়ে খোদা তাঁর প্রিয়তম সৃষ্টিরুপে দুনিয়াতে পাঠায় মানুষ যখন তা ভুলে যায় তখন খোদার প্রতিনিধি হয়ে নবী (সা:) এর আদর্শকে বাস্তবায়ন করার মধ্য দিয়ে সলফে সালেহীনগন তথ্যযুগের যাঁরা সংস্কারক থাকেন তাঁরা দায়িত্ব গ্রহণ করেন, সে সমস্ত পথভোলা মানুষকে খোদার পথে এনে জান্নাতের সুঘ্রাণ দেয়ার। যার হৃদয়ে নবীর প্রেম থাকে, যারা আশেকে রসুল (সা:) এ পরিণত হয় তার জীবনতো সুন্নাতের অলংকারে সুসজ্জিত থাকবে। তার চলাফেরায়, চিন্তা ধারায়, কথা বার্তায় ইসলামের জ্যোতি, সুন্নাতের প্রীতি, খোদার ভীতি হবে দৃশ্যমান, ইনসানিয়াত হবে বেগমান। সর্বোপরি খুঁজে পাবে এহসান তথা খোদার সন্ধান, মারেফতের সুঘ্রাণ, জান্নাতের মেশক আম্বর সুঘ্রাণ। হযরত মাওলানা তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও প্রখর ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। তাঁর অসাধারণ ব্যক্তিত্ব মানুষকে সম্মোহিত করে রাখত ৷

অমূল্য নসিহত সমূহ : হযরত মাওলানার নসিহত সমূহের মধ্যে অন্যতম ছিল : ১). কবুতরের মত বাছিয়া খাও। হারাম খেয়োনা। নিজ সন্তান সন্তুতি নিয়ে খোদার প্রশংসা কর। ২). কুনজাসকের (চড়ই পাখি) মত নিজ হুজরায় বসে আল্লাহর নাম স্মরণ কর। ৩). কোরআন তেলোয়াত কর। ৪). আইয়ামে বীজের রোজা রাখ (প্রত্যেক চন্দ্র মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ)। ৫). নিজের হাতে খাবার পাকিয়ে খাও। ৬).তাহাজ্জুদের নামাজ পড়িও। ছালাতুত তাসবিহ্ এর নামাজ পড়িও।

মাইজভান্ডারী তরিকার সপ্ত-পদ্ধতি : আল্লাহর নৈকট্য লাভের ক্ষেত্রে মাইজভান্ডারী তরিকার সপ্ত-পদ্ধতির স্বীকৃতি রয়েছে সর্বত্র। যা উসূলে সাবা হিসেবে ভক্ত আশেকানদের নিকট পরিচিত। মাইজভান্ডারী তরিকায় প্রবর্তিত সপ্ত-পদ্ধতি চর্চার মাধ্যমে যারা দৈনন্দিন জীবন অতিবাহিত করবে, তারা খিজিরিয়া স্তরের অলির মোকাম অর্জন করতে পারে।

ওফাত ও ওরশ শরিফ : আল্লাহতায়ালার মাহাবুব অলি শাহছুফী হযরত মাওলানা সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারী (রহ.)–১৯০৬ সালের দশই মাঘে বেছাল হন। প্রত্যেক বছর বাংলা মাঘের দশ তারিখ তার ওরশ শরীফ অনুষ্ঠিত হয়। তাঁর বেছাল পরবর্তী সময়েও আশেক ভক্তরা তাকে মাইজভান্ডারী তরিকার ঈমাম বা প্রতিষ্ঠাতা মেনে নিয়ে অদ্যবধি অনুসরণ করে চলছেন। তাকে নিয়ে রচিত বিভিন্ন কালাম বা শের বাংলাদেশের সীমানা পেড়িয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের কোটি কোটি আশেক ভক্তদের হৃদয়ে সর্বদা আলোড়িত হচ্ছে। কুরআনে ইরশাদ হয়েছে,‘আর যারা আল্লাহর রাস্তায় নিহত হয়, তাদের মৃত বলো না। বরং তারা জীবিত, কিন্তু তোমরা তা বুঝ না।’ (সূরা বাকারা : ১৫৪)। মহানঅলি এবং তাঁর সুযোগ্য উত্তরসুরী হযরত বাবাভান্ডারী (রহ.)–হযরত দেলওয়ার হোসাইন মাইজভান্ডারী (রহ.)–ও শাহানশাহ হযরত জিয়াউলহক মাইজভান্ডারী (রহ.)–র প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও অজস্র সালাম নিবেদন করছি হযরত কেবলার ওফাত ও ওরশ শরিফ দিনে।

শেষ কথা : হযরত মাওলানার আদর্শিক জীবনধারা থেকে শিক্ষা নেয়ার মতো অনেক কিছু রয়েছে। তিনি আমাদের মধ্যে নেই। কিন্তু তার দেয়া কুরআন সুন্নাহর জীবন নির্দেশকা রয়ে গেছে। আল্লাহতায়ালা আমাদেরকে তার দেখানো পথ অনুসরণ করে দুনিয়া ও আখিরাতের মুক্তি অর্জন করার তৌফিক দান করুক। আল্লাহ আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে মহান অলি শাহছুফী হযরত মাওলানা সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারী (রহ.) এর আদর্শ বাস্তবায়ন করার তৌফিক দান করুন। আল্লাহতায়ালা তাকে জান্নাতে উচুঁ মাকাম দান করুন। আমীন।

আমীন।

লেখক :

ফখরুল ইসলাম নোমানী

হেড অব ফাইন্যান্স এন্ড একাউন্টস

এপিক হেলথ কেয়ার লিমিটেড