জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে ‘বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন: তাৎপর্য’ শীর্ষক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে।

সেমিনারের প্রধান আলোচক ড. অনুপম সেন বলেন, বাঙালির ইতিহাসে কতগুলো অসাধারণ দিন আছে।

২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বর, ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৭ মার্চ ও ১০ জানুয়ারি। এগুলো ইতিহাসে লেখা থাকবে। কয়েক হাজার বছর ধরে বিভিন্ন বর্ণের সংমিশ্রণে এ বাঙালি জাতি গড়ে উঠেছে। অন্তত সম্পদশালী ছিল বাংলা। সেই দেশ ১৯০ বছর ব্রিটিশরা শাসন করেছে। বঙ্গবন্ধু কেন সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বলা হয়? মহৎ বাঙালির তো অভাব নেই। বাংলা ভাষা অত্যন্ত সমৃদ্ধ। কিন্তু নিজের রাষ্ট্র গড়তে পারিনি। পাল, সেন, সুলতানি, পাঠান, মোগল, স্বাধীন নবাব যুগ ছিল। কিন্তু কেউ বাঙালি ছিলেন না।
তাদের রাষ্ট্রের ভাষাও বাংলা ছিল না। এমনকি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলেও সরকারি ভাষা ছিল ফার্সি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে পরাভূত হয়েছিলাম জ্ঞানের কাছে। মাত্র ৩ বছরে তারা যে সম্পদ লুণ্ঠন করে তা দিয়ে যুক্তরাজ্যে শিল্পবিপ্লব হয়েছিল। তাদের লুণ্ঠনে আমরা দরিদ্র জাতিতে পরিণত হয়েছিলাম। ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হলো। ৫৬ শতাংশ বাঙালি। কিন্তু মুসলিম লীগ নেতারা পশ্চিম পাকিস্তানি। সব কাজ হলো সেখানে। অথচ হবার কথা ছিল পূর্ব পাকিস্তানে। ১৯৪৮ সালে বলা হলো- উর্দুই হবে একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা। বাংলাকে স্থান দেওয়া হয়নি। জিন্নাহ সাহেব ঢাকায় এসে ঘোষণা করলেন উর্দুই হবে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। তখন থেকে বঙ্গবন্ধু বুঝেছেন বাঙালির স্বাধীনতা ছাড়া পথ নেই। তিনি ভাষা সংগ্রাম পরিষদ করলেন। সেই জেলজীবন শুরু। ১৩ বছর তিনি জেলে ছিলেন।

ড. অনুপম সেন বলেন, ১৯৫৬ সালে এদেশে ভুখা মিছিল হয়েছে। ১৯৭০ সালে সিংহভাগ লোক ছিল দারিদ্র্য সীমার নিচে। এখন কৃষিজমি কমেছে কিন্তু উৎপাদন কয়েকগুণ বেড়েছে। বাংলাদেশ খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে। আজ বাংলাদেশ মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। বাঙালির নিজের রাষ্ট্র কখনো ছিল না। বাঙালির প্রথম স্বাধীনতা ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর সেই স্বাধীনতাকে প্রকৃত রূপ দিলেন, সেদিন বাঙালি পেল প্রথম সংবিধান। বঙ্গবন্ধু একটি যুদ্ধবিধস্ত দেশ পেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন এমন একটি দেশ সেটি কারো কাছে মাথা নোয়াবে না। দেশটি যেন স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়। আমাদের লোকেরা যেন পেট ভরে খেতে পায়। শৈশবে কঠোর দারিদ্র্য দেখেছি। কোনো শিল্পই ছিল না। পাটশিল্প ছাড়া সবই ছিল কৃষি খাত। সব জুট ইন্ডাস্ট্রির মালিক ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি। আজ কত শিল্প দেশে। কত এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। হেনরি কিসিঞ্জার বলেছিলেন এটা বটমলেস বাস্কেট কেস। সেই বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বিস্ময়। বঙ্গবন্ধুই সবকিছু শুরু করেছিলেন। যুদ্ধবিধস্ত দেশ, তখন বিশ্বজুড়ে মন্দা, জ্বালানির দামে ভয়াবহ উলম্ফন দেখেছি। সে অবস্থায় বঙ্গবন্ধু যাত্রা শুরু করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু শোষিতের গণতন্ত্র চেয়েছিলেন, শোষকের নয়। আমরা চাই সঠিক শিক্ষার সুযোগ পাক সবাই। স্বাস্থ্যসেবা পাক। এ খাতে খুব কম ব্যয় করা হয়। আমরা এগুচ্ছি। যদি আসল খাতে বিনিয়োগ না হয় তাহলে তা স্তব্ধ হয়ে যাবে। সেজন্য সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ দিতে হবে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে।

সভাপতির বক্তব্যে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো ইসমাইল খান বলেন, আমাদের ইতিহাসে যে দিনগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তার মধ্যে এদিন একটি। হাজার বছরে বাঙালির সবচেয়ে বড় অর্জন বাঙালির নিজেদের একটা দেশ- বাংলাদেশ। নিজেদের প্রকাশের জন্য দেশটা আমরা পেয়েছি। পরাধীন বাঙালি হাজার বছর ধরেই যেন মুক্তির বাসনায় ছিল। সেটা সবসময় অঙ্কুরেই ভেসে গেছে। কিন্তু একজন নেতা বাঙালির অন্তরাত্মাকে বুঝতে পেরেছিলেন। বাঙালির চাওয়া পাওয়া আত্মস্থ করে সুপ্ত আকাঙ্ক্ষাকে জাগিয়ে তুলতে পেরেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীনতা ও বিজয় অবশেষে ধাপে ধাপে বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে এসেছে। পথিকই পথ সৃষ্টি করে। স্বাধীন জাতিসত্তা, দেশ, ভূখণ্ড আমরা পেয়েছি মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশের ইতিহাসে বিজয়ের পূর্ণতা দিবস ১০ জানুয়ারি। ১৬ ডিসেম্বর থেকে মাঝখানে ২৫টা দিন কেমন ছিল তা যদি ভেবে দেখি তবে এর গুরুত্ব বুঝতে পারব। ১৬ ডিসেম্বরের পর ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত কোনো দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। যেই বঙ্গবন্ধু ফিরলেন জানুয়ারিতে ২৫, ফেব্রুয়ারিতে ৫০টা দেশ স্বীকৃতি দিল। আমাদের অস্তিত্বের জন্য বঙ্গবন্ধুর ফিরে আসাটা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ১০ জানুয়ারি রেসকোর্সের ভাষণ হলো ১৭ মিনিটের। সারা বিশ্বের জনগণকে তিনি ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন। আহ্বান জানিয়েছিলেন, আমাদের স্বীকার করে নিন। খুবই বাস্তব সম্মত বক্তব্য দিয়েছিলেন। জাতিসংঘসহ সবার সহযোগিতা চান। দেশবাসীর জন্য সরাসরি দিক নির্দেশনা দিয়েছিলেন।

কেউ বলার আগেই নিজে থেকেই বলেছিলেন, যখনই বলব ভারতীয় সৈন্য শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ফেরত নেবেন বলে জানিয়েছেন। যৌক্তিক ও আবেগময় সব নির্দেশনাই সে বক্তব্যে বলেছিলেন। বাংলার মানুষ হাসবে, খেলবে, মুক্ত হয়ে বাস করবে, পেট ভরে ভাত খাবে এ আমার সাধনা, এ আমার জীবনের কাম্য। এর আগে পর্যন্ত আমাদের স্বাধীনতা পূর্ণতা ও পুণ্যতা পায়নি। সোনার মানুষ চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। মৌলিক অধিকার, ধর্মনিরপেক্ষতা, সব বর্ণের ধর্মের মানুষের একতার মালা বাংলাদেশ। এখনো বিরোধী শক্তি সে মালা ছিঁড়ে দিতে চায়। তাই সবাইকে সজাগ থাকতে হবে।

সেমিনারে স্বাগত বক্তব্য দেন চমেবি নার্সিং অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মনোয়ারুল হক শামীম। চট্টগ্রাম মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) ডা. বিদ্যুৎ বড়ুয়ার সঞ্চালনায় সেমিনারে আলোচনা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ডা. দেলোয়ার হোসেন। উপস্থিত ছিলেন রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) ডা. হাসিনা নাসরীন, উপ কলেজ পরিদর্শক ডা. আইরীন সুলতানা, বিআইটিআইডির উপ-পরিচালক ডা. বখতিয়ার আলম।