স্বাগত ১৪২৬

সকল অমানবিক অশুভ অপশক্তির ভিত্তি নাড়িয়ে দেয়ার বৈশাখ এসেছে। রবিবার ১৪২৬ বঙ্গাব্দের প্রথম দিন। পহেলা বৈশাখ। বাঙালীর বর্ষবরণের মহোৎসবে যোগ দেবে গোটা দেশ। এই বিশেষ দিনে হাজার বছরের সমৃদ্ধ সংস্কৃতির আলোয় নতুন করে জেগে উঠবে বাঙালী। শেকড়ের শক্তি নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার শপথ নেবে। মানুষের ভেতরে শুভ বোধ মানবিক চেতনা জাগ্রত করার আহ্বান জানানো হবে।

বছর শুরুর এই ক্ষণে নতুন নতুন স্বপ্ন বুনবে বাংলার কৃষক। ঐতিহ্য মেনে হালখাতা খুলবেন ব্যবসায়ীরা। সরকারী ছুটির দিনে রাজধানীসহ দেশে একযোগে চলবে লোকজ ঐতিহ্যের নানা উৎসব অনুষ্ঠান। নববর্ষের সূচনালগ্নে দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

বাঙলীর নববর্ষের সঙ্গে সবচেয়ে নিবিড় সম্পর্ক কৃষির। যতদূর তথ্য এ সম্পর্কের সূত্রেই বাংলা সাল প্রবর্তন করেন সম্রাট আকবর। তার আমলে প্রবর্তন হয় বাংলা সন, বঙ্গাব্দ। বঙ্গাব্দের মাস হিসেবে বৈশাখের প্রথম স্থান অধিকার করার ইতিহাস অবশ্য বেশি দিনের না হলেও, আদি সাহিত্যেও বৈশাখের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। দক্ষের ২৭ কন্যার মধ্যে অনন্য সুন্দরী অথচ খরতাপময় মেজাজ সম্পন্ন একজনের নাম বিশাখা। এই বিশাখা নক্ষত্রের নামানুসারেই বাংলা সনের প্রথম মাস বৈশাখের নামকরণ। সৌরমতে বৈদিক যুগে বছর গণনার পদ্ধতি প্রচলিত ছিল। সেখানেও সন্ধান মেলে বৈশাখের।

পেছনের যত ক্ষত ভুলে এ সময় ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখে বাঙালী। শুভ সূচনা হয় পহেলা বৈশাখে। কবিগুরুর ভাষায়: মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা/অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা…। পুরনো দিনের শোক-তাপ-বেদনা-অপ্রাপ্তি-আক্ষেপ ভুলে অপার সম্ভাবনার দিকে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ঘোষণা করে নতুন বছর।

এবারও দুই হাতে অন্ধকার ঠেলে, সব ভয়কে জয় করার মানসে নতুন করে জেগে উঠবে বাঙালী। ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে দেশের সব শেণী-পেশার মানুষ আজ একাত্মা হয়ে গাইবে: এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ …। আনন্দ উৎসবে কাটাবে। কবিগুরুর ভাষায়- নব আনন্দে জাগো আজি নব রবি কিরণে/শুভ্র সুন্দর প্রীতি-উজ্জ্বল নির্মল জীবনে …। একই আনন্দের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে নজরুল লিখেছেন, তোরা সব জয়ধ্বনি কর/তোরা সব জয়ধ্বনি কর/ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কালবোশেখির ঝড়/ তোরা সব জয়ধ্বনি কর …।

আবহমান কাল ধরেই চলছে বৈশাখ বরণের আনুষ্ঠানিকতা। প্রকৃত রূপটি দৃশ্যমান হয় গ্রামে। এক সময় গ্রামবাংলায় চৈত্রসংক্রান্তি ছিল প্রধান উৎসব। বছরের শেষ দিনে তেতো খাবার খেয়ে শরীর শুদ্ধ করতেন কিষান-কিষানী। নির্মল চিত্তে প্রস্তুত হতেন নতুন বছরে প্রবেশের জন্য। এখনও বৈশাখ বরণের অংশ হিসেবে বাড়িঘর ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করেন গৃহিণীরা। আল্পনা আঁকেন মাটির মেঝেতে। খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠেন সবাই। স্নান সারেন। নতুন পোশাক পরেন। আত্মীয় স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীর বাড়িতে বেড়াতে যান। ঘরে ঘরে সাধ্যমতো বিশেষ খাবার রান্না করা হয়। থাকে পিঠা-পুলির আয়োজন। আজ হাটে-মাঠে-ঘাটে বসবে ঐতিহ্যবাহী বৈশাখী মেলা। নানা রকম কুটির শিল্প, খেলনা, মিষ্টিসহ বাহারি পণ্যে স্টল সাজানো হবে। বিভিন্ন এলাকায় থাকবে নৌকা বাইচ, লাঠিখেলা কিংবা কুস্তির মতো ঐতিহ্যবাহী আয়োজন।

নাগরিক জীবনেও বিপুল আনন্দ যোগ করে পহেলা বৈশাখ। বর্ষবরণের দিন সব শহরেই আয়োজন করা হয় বর্ণাঢ্য উৎসব অনুষ্ঠানের। ধর্ম-বর্ণ ভেদ ভুলে অসাম্প্রদায়িক উৎসবে মাতে বাংলাদেশ। ষাটের দশকে বাঙালী চেতনাবিরোধী অবস্থানের প্রতিবাদে শহর ঢাকার রমনা বটমূলে শুরু হয় বৈশাখ উদ্যাপন। এর মাধ্যমে বাঙালী আপন পরিচয়ে সামনে আসার সুযোগ পায়। পরবর্তীতে বাঙালীর রাজনৈতিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে উত্থান ঘটে পহেলা বৈশাখের। নববর্ষের প্রথম দিবসটি বর্তমানে বাঙালীর জাতিসত্তায়, চেতনায় ও অনুভবের জগতে গভীরভাবে বিরাজ করছে। এ প্রসঙ্গে ড. মুহাম্মদ এনামুল হক চমৎকার বলেছেন। তিনি বলেছেন, আমাদের অধুনাতম নববর্ষ এ দেশের গ্রীষ্মকালীন উৎসব ও কৃষি উৎসব উদযাপনের একটি বিবর্তিত নব সংস্করণ। এর ঐতিহ্য প্রাচীন কিন্তু রূপ নতুন, নতুন সংস্কার, নতুন সংস্কৃতি, নতুন চিন্তাধারা অবারিত স্রোতে যুক্ত হয়ে সৃষ্টি করেছে এমন এক নতুন আবহ যাকে একটা দার্শনিক পরিম-ল বলে উল্লেখ করতে হয়। এ পরিমন্ডলে পুরনো বিলীন জীর্ণস্তূপ নিশ্চিহ্ন, মিথ্যা বিলুপ্ত ও অসত্য অদৃশ্য। আর নতুন আবির্ভূত নবজীবন জাগরিত সুন্দর সম্মিত ও মঙ্গল সম্ভাবিত কালবৈশাখীই এর প্রতীক। সে নববর্ষের অমোঘ সহচর। নব সৃষ্টির অগ্রদূত সুন্দরের অগ্রপথিক ও বিজয়কেতন।