বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ, বিচারককে আইন মন্ত্রণালয়ে সংযুক্তি

নারায়ণগঞ্জের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক (জেলা ও দায়রা জজ) জুয়েল রানার বিরুদ্ধে এক তরুণী ঢাকার আদালতে মামলা করেছেন। গত সোমবার ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৫ তরুণীর অভিযোগের বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। সাত দিনের মধ্যে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমকে (সিএমএম) তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলেছেন ট্রাইব্যুনাল।

মামলা হওয়ার পর গত বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শে বিচারক জুয়েল রানাকে আইন মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে বলে প্রথম আলোকে জানান আইনসচিব আবু সালেহ শেখ মো. জহিরুল হক।

তরুণী তাঁর মামলায় বলেছেন, বিচারক জুয়েল রানা ঢাকার আদালতে অতিরিক্ত জেলা জজ পদে কর্মরত থাকা অবস্থায় তাঁর একটি পারিবারিক রিভিশন মামলা তাঁর (বিচারক জুয়েল রানা) আদালতে বিচারাধীন ছিল। পরে বিচারক নিজে তরুণীকে ফোন করে তাঁকে সরকারি চাকরি দেওয়ার প্রলোভন দেন। বিচারক তাঁর আদালতে অস্থায়ী স্টেনোগ্রাফার হিসেবে কাজে নিয়োগ দেন। সরকারি চাকরি নেওয়ার প্রস্তুতি হিসেবে তরুণীকে সাঁটলিপি শেখার জন্য ভর্তি হতে বলেন। এমন আচরণের মাধ্যমে তরুণীর বিশ্বাস অর্জন করেন বিচারক।

মামলার এজাহারে বলা হয়, বিচারক জুয়েল রানার অধীনে নিয়োগ পরীক্ষা হলেও তরুণীকে সরকারি চাকরি না দেওয়ায় তিনি অন্য কোম্পানিতে চাকরি নেন। তখন বিচারক জুয়েল রানা আবার তরুণীকে ফোন দিয়ে তাঁর আদালতে আসতে বলেন। কিন্তু তরুণী না আসতে চাইলে তাঁর পারিবারিক মামলার আপিলে ক্ষতি করে দেবেন বলে হুমকি দেন। তখন তরুণী বাধ্য হয়ে আবার বিচারক জুয়েল রানার আদালতে আসেন এবং অস্থায়ীভাবে তাঁর আদালতে কাজ করতে থাকেন।

তরুণী মামলায় বলছেন, ২০১৫ সালের ৮ জুন বিচারক তরুণীকে তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কথা বলে তাঁর বাসায় নিয়ে যান। তবে সেদিন বিচারকের বাসায় তাঁর স্ত্রী-সন্তান কেউ ছিলেন না। একপর্যায়ে হত্যার হুমকি দিয়ে তাঁকে ধর্ষণ করা হয়। ধর্ষণের কথা কাউকে জানালে হত্যার হুমকি দেন বিচারক।

এজাহারে বলা হয়, ওই তরুণী সেদিন বিচারকের বাসা থেকে বের হয়ে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে ঢাকা মেডিকেলে যান। পরদিন রমনা থানায় বিচারকের বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা করতে যান তরুণী। তবে অতিরিক্ত জেলা জজ শুনে মামলা না নিয়ে পুলিশ তরুণীকে আদালতে মামলা করতে বলেন। তরুণী সেদিন আদালতে তাঁর ল্যাপটপ আনতে যান। তখন বিচারক তাঁকে অফিসে কাজ করতে বলেন। মুখ খুললে মেরে ফেলবেন বলে হুমকি দেন বিচারক। পরে তরুণী গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে বিচারক তাঁর চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। তরুণীর সব চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করবেন বলে বিচারক তাঁকে আশ্বস্ত করেন। সুস্থ হলে তরুণীর সঙ্গে মীমাংসা করার মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেন।

তরুণী তাঁর মামলায় বলেন, ছয় মাস অসুস্থ থাকার পরও সুস্থ না হলে বিচারকের দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ২০১৫ সালের ৩ নভেম্বর তাঁর খাসকামরায় দেখা করেন তিনি। সেদিন বিচারককে বিয়ে করে ডাক্তার দেখিয়ে সুস্থ করে তুলতে বলেন তরুণী। তা না হলে আইনের আশ্রয় নেবেন বলে বিচারককে জানান। বিষয়টি নিয়ে খাসকামরায় দুজনের মধ্যে ঝগড়া হয়। এরপর ৮ নভেম্বর রাতে র‍্যাব তরুণীকে আটক করে নিয়ে যায়। সেদিন র‍্যাব সদস্যরা ধর্ষণসংক্রান্ত চিকিৎসকদের ব্যবস্থাপত্র নিয়ে যায়। তরুণীর বিরুদ্ধে খিলক্ষেত থানায় ২০টি ইয়াবা রাখার অভিযোগে মামলা দেয় র‍্যাব। ২২ দিন জেল খাটার পর জামিন পান তিনি।

এজাহারে বলা হয়, জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর র‍্যাবের নিয়ে যাওয়া চিকিৎসকদের সনদের কপি তোলার সব চেষ্টাই করেন তরুণী। কিন্তু ব্যর্থ হন। এর মধ্যে বিচারক তাঁর বন্ধু সেলিম পাশাকে দিয়ে তরুণীর সঙ্গে যোগাযোগ করান আপসের জন্য। পরে তরুণী ধর্ষণ ও ডিএনএ টেস্ট করার জন্য ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান সোহেল মাহমুদের কাছে যান। বিচারক এ খবর জানতে পেরে চিকিৎসক সোহেল মাহমুদকে ফোন দেন, সনদ না দেওয়ার জন্য বলেন।

তরুণী মামলায় বলেন, বিচারক সাময়িক বরখাস্ত থাকা অবস্থায় ইয়াবা মামলায় ঢাকার আদালতে হাজিরা দিতে গেলে ২০১৭ সালের ৩১ জুলাই তরুণীকে তুলে রমনা থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। পরে বিচারকের করা তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনে মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়। পরের বছর ২২ ফেব্রুয়ারি তরুণী সেই মামলায় জামিন পান।

ধর্ষণের কারণে শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ায় ও দুটি মিথ্যা মামলায় কারাগারে থাকায় মামলা করতে বিলম্ব হয়েছে বলে তরুণী আদালতকে জানান।

র‍্যাবের মুখপাত্র ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান প্রথম আলোকে বলেন, মামলার ঘটনা অনেক আগের। ওই তরুণী যদি র‍্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে থাকেন, তাহলে অবশ্যই তাঁকে সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণের ওপর ভিত্তিতে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। আর অপরাধীরা নানা ধরনের বক্তব্য দিয়ে থাকেন, সেটা তাঁদের ব্যক্তিগত মত। র‍্যাব সব সময় আইন অনুযায়ী কাজ করে থাকে। আইনের ব্যত্যয় ঘটানো হয় না।

সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র স্পেশাল অফিসার মোহাম্মদ সাইফুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বিচারক জুয়েল রানার বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা হওয়ার বিষয়টি জেনেছেন। এ ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্ত চলমান। এ ব্যাপারে কোনো বক্তব্য নেই।