পবিত্র তুর পাহাড়

পবিত্র তুর পাহাড়। তুর পাহাড়ে মুসা (আ.) ৪০ দিন ইতিকাফ করেছিলেন, যেখানে নাজিল হয়েছিল পবিত্র তাওরাত। সুরা আ‘রাফে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘আমি মুসার জন্য ৩০ রাত স্থির করেছিলাম, তারপর আরো ১০ রাত বৃদ্ধি করে তা পূর্ণ করি। এভাবে তার প্রতিপালকের নির্ধারিত সময় ৪০ দিন পূর্ণ হলো।’ আমরা মহান রবের শুকরিয়া আদায় করছিলাম আর ভাবছিলাম, তাঁর কুদরতের সামনে পৃথিবীর সব কিছু কতই না তুচ্ছ! কোথায় সেই ফেরাউন? কোথায় তাঁর সেই বিশাল সৈন্যবাহিনী? আল্লাহর কুদরতের ইশারায় তা হারিয়ে গেছে যুগের অতল গহ্বরে। অন্যদিকে মুসা (আ.)-কে মহান আল্লাহ আজও বাঁচিয়ে রেখেছেন মানুষের অন্তরে।
  প্রাচীনকাল থেকেই মিসর সৌন্দর্যের লীলাভূমি হিসেবে স্বীকৃত। তুর পাহাড়ের কথা কোরআনে কারিমের কয়েক জায়গায় এসেছে। তুর পাহাড় মিসরের দক্ষিণ সাইনা জেলায় অবস্থিত। সাইনার মূল শহরের নাম‘আত তুর’। বড় শহর হলো শারমুশ শাইখ। জনসংখ্যা ১৭৭৯০০। এই পাহাড়ের উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২২৮৫ মিটার। এই পাহাড়কে জাবালে মূসা নামে নামকরণ করা হয়েছে। সাইনা অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি জেলা এবং এই এলাকার নাম কুরআন মাজীদে উল্লেখ হয়েছে। এই পাহাড়ি এলাকায় এক প্রকার গাছ হয় যা থেকে তেল তৈরি হয়। সাইনা নবীদের বরকতময় ভূমি। এই এলাকায় অনেক নবী রাসূলের আগমন ঘটেছে। এখানেই রয়েছে সেই ঐতিহাসিক‘জাবালে মূসা’,অনেক নবীদের কবর,বনী ইসরাঈলের ‘তীহ’ নামক ময়দান । আরো অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার সাথে এই মাটি ও পাহাড় সম্পৃক্ত। সুতরাং এই ভূমির বরকত ও নিয়ামত কিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে, ইনশাআল্লাহ। আগেই বলেছি এ স্থানটি মুসলিম, খ্রিস্টান ও ইয়াহুদিদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্যহ এখানে দেশ বিদেশের মুসলমান, খ্রিস্টান ও ইয়াহুদি ধর্মের লোকজন এসে যার যার উপাসনালয়ে নিজস্ব পদ্ধতিতে ইবাদাত করছে। কুশল বিনিময় করছে। কারো সাথে কারো সংঘাত নেই, বিরোধ নেই। এলাকাটি মিসরবাসী ওমিসর সরকারের কাছে বরং পুরো মুসলিম উম্মাহর কাছেও খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি জায়গা। ইসরাঈল সবসময় এটা দখল করতে চায়,যে কোনো মূল্যে। যার ফলে অনেক সময় হামলা করে বসে এবং বিভিন্ন গ্রুপও এই এলাকাটা দখল করার জন্য বিভিন্ন সময় সেনাবাহিনীর উপর হামলা করে থাকে। অনেক সেনাও এতে হতাহত হয়।
তুর পর্বত বা জবলে মুসার পাদদেশে গোলাকার আকৃতির একটি গাছ রয়েছে, এ গাছের নিচের অংশ পাথর দিয়ে বাঁধানো। কথিত আছে, এটাই সে গাছ যেই গাছ থেকেই হযরত মুসা (আঃ) আলো বিচ্ছুরিত হতে দেখেছিলেন, অনেক মানুষ এ-গাছ দেখতে এখানে আসেন, তবে হাজার বছরের ব্যবধানে সেই গাছ কিনা, এ সম্পর্কে গবেষকদের ও ইসলামী চিন্তাবিদদের ধারণা সাধারণ মানুষের সম্পূর্ণ বিপরীত। হযরত মুসা (আঃ) যেখানে কুঞ্জবনের মধ্যে আগুন লেগেছে বলে দেখেছিলেন সে স্থানটি তূর পাহাড়ের পাদদেশে সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার ফুট ওপরে অবস্থিত। রোমান সাম্রাজ্যের প্রথম খ্রিস্টান বাদশাহ কনস্টানটাইন ৩৬৫ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে ঠিক যে জায়গায় ও ঘটনাটি ঘটেছিল সেখানে একটি গীর্জা নির্মাণ করেন। পূর্বে নির্মিত কনস্টান্টাইনের গীর্জাকে এই আশ্রমের মধ্যে শামিল করা হয়েছে। সে আশ্রম ও গীর্জা বর্তমানেও আছে এবং এটি গ্রীক অর্থোডক্স চার্চের অধীনে রয়েছে। নিজের স্ত্রী ও সন্তান এবং সাথের অন্যদের পথিমধ্যে রেখে হযরত মূসা (আঃ) সম্মুখে আলো দেখে আগুনের সন্ধানে চললেন। বেশ কিছুটা যাবার পরে তিনি যখন সেই বিচ্ছুরিত আলোকচ্ছটার মুখোমুখি হলেন, তখন সেই আলো থেকেই যেন আওয়াজ এলো- ‘হে মূসা ! আমিই আল্লাহ- তোমার রব। তুমি এখন পবিত্র উপত্যকায় রয়েছো, সুতরাং জুতা খুলে এখানে এসো ।’ এই ঘটনা সম্পর্কে পবিত্র কোরআনের বেশ কয়েকটি সূরায় বিস্তারিত আলোচনা এসেছে। আল্লাহতা’য়ালা পবিত্র কোরআনে বিষয়টি এভাবে উল্লেখ করেছেন, ‘সেখানে পৌঁছলে তাঁকে ডেকে বলা হলো, ‘হে মূসা! আমিই তোমার রব, জুতো খুলে ফেলো, তুমি পবিত্র তুওয়া উপত্যকায় আছো। আমিই আল্লাহ, তোমাকে বাছাই করে নিয়েছি, শোনো যা কিছু ওহী করা হয়। আমিই আল্লাহ, আমি ছাড়া আর কোন ইলাহ্‌ নেই, সুতরাং তুমি আমারই দাসত্ব করো এবং আমাকে স্মরণ করার জন্য নামাজ কায়েম করো।’ (সূরা ত্ব-হা ১১-১৪)। উপত্যকায় ডান কিনারায় পবিত্র ভূখণ্ডে একটি বৃক্ষ থেকে আহবান এল, ‘হে মূসা! আমিই আল্লাহ সমগ্র বিশ্বের অধিপতি।’ (সূরা আল কাসাস-৩০)। সেখানে পৌঁছানোর পর আওয়াজ এলো, ‘ধন্য সে সত্তা যে এ আগুনের মধ্যে এবং এর চারপাশে রয়েছে, পাক পবিত্র আল্লাহ সকল বিশ্ববাসীর প্রতিপালক। হে মুসা! আমিই আল্লাহ্‌ মহাপরাক্রমশালী ও সর্বজ্ঞ।’ (সুরা নাম্‌ল ৭-৮)।


কোরআনে কারিমে হজরত মুসা (আ.) সম্পর্কে অনেক আলোচনা রয়েছে। প্রচুর উপমা ও বিভিন্ন আঙ্গিকে তার ঘটনা বারবার উল্লেখ করা হয়েছে। যাতে মানুষ এসব থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে।

যেমন কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘মুসা যখন মেয়াদ পূর্ণ করল এবং নিজ স্ত্রীকে নিয়ে রওয়ানা হয়ে গেল, তখন সে তুর পাহাড়ের দিকে এক আগুন দেখতে পেল। সে নিজ পরিবারবর্গকে বলল, তোমরা অপেক্ষা কর। আমি এক আগুন দেখেছি, হয়ত আমি সেখান থেকে তোমাদের কাছে আনতে পারব কোনো সংবাদ অথবা আগুনের একটা জ্বলন্ত কাঠ, যাতে তোমরা উত্তাপ গ্রহণ করতে পার। সুতরাং সে যখন আগুনের কাছে পৌঁছল, তখন ডান উপত্যকার কিনারায় অবস্থিত বরকতপূর্ণ ভূমির একটি বৃক্ষ থেকে ডাকা হলো- হে মুসা! আমিই আল্লাহ, জগৎসমূহের প্রতিপালক। ’ -সূরা কাসাস: ২৯-৩০

তুর পাহাড়ে হজরত মুসা (আ.) আসমানি কিতাব তাওরাত লাভ করেছিলেন। আল্লাহতায়ালা সূরা আরাফে তা উল্লেখ করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি মুসার জন্য ত্রিশ রাতের মেয়াদ স্থির করেছিলাম (এ রাতসমূহে তুর পাহাড়ে এসে ইতিকাফ করবে)। তারপর আরও দশ রাত বৃদ্ধি করে তা পূর্ণ করি। এভাবে তার প্রতিপালকের নির্ধারিত মেয়াদ চল্লিশ দিন হয়ে গেল এবং মুসা তার ভাই হারুনকে বলল, আমার অনুপস্থিতিতে তুমি সম্প্রদায়ের মধ্যে আমার প্রতিনিধিত্ব করবে, সবকিছু ঠিকঠাক রাখবে এবং অশান্তি সৃষ্টিকারীদের অনুসরণ করবে না। মুসা যখন আমার নির্ধারিত সময়ে এসে পৌঁছল এবং তার প্রতিপালক তার সঙ্গে কথা বললেন, তখন সে বলল, হে আমার প্রতিপালক! আমাকে দর্শন দিন আমি আপনাকে দেখব। তিনি বললেন, তুমি আমাকে কিছুতেই দেখতে পাবে না। তুমি বরং পাহাড়ের প্রতি দৃষ্টিপাত কর। তা যদি আপন স্থানে স্থির থাকে, তবে তুমি আমাকে দেখতে পারবে। অতপর যখন তার প্রতিপালক পাহাড়ে তাজাল্লি ফেললেন ( জ্যোতি প্রকাশ করলেন) তখন তা পাহাড়কে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে ফেলল এবং মুসা সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে গেল। পরে যখন তার সংজ্ঞা ফিরে আসল, তখন সে বলল, আপনার সত্তা পবিত্র। আমি আপনার দরবারে তওবা করছি এবং (দুনিয়ায় কেউ আপনাকে দেখতে সক্ষম নয়- এ বিষয়ের প্রতি) আমি সবার আগে ঈমান আনছি। ’ -সূরা আরাফ: ১৪২-১৪৩

তুর পাহাড় মিসরের দক্ষিণ সাইনা জেলায় অবস্থিত। সাইনার মূল শহরের নাম ‘আত তুর’। বড় শহরের নাম- শারমুশ শাইখ। পাহাড়টির উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২২৮৫ মিটার। এই পাহাড়কে জাবালে মুসা নামে নামকরণ করা হয়েছে। এই পাহাড়ের পাদদেশে হজরত মুসা (আ.)-এর ভাই হজরত হারুন (আ.)-এর কবর রয়েছে।

(ছবি: সংগৃহীত)