গাউসুল আজম মাইজভাণ্ডারী’র ওরশ আজ

মাইজভাণ্ডার শরীফে আত্মিক শুদ্ধি প্রত্যাশীদের মহাসম্মিলন

পাক ভারত উপমহাদেশের সুফি সভ্যতার সুদীর্ঘ ঐতিহ্যের প্রবহমান ধারায় উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ি থানার মাইজভাণ্ডার গ্রামে আত্মপ্রকাশ করে এক মহান সুফি সাধকের। তাঁর নাম সৈয়দ আহমদ উল্লাহ [১৮২৬ – ১৯০৬ খ্রি.]। জন্মস্থানের নামানুসারে তাঁর নামের সাথে যুক্ত হয় ‘মাইজভাণ্ডারী’ এবং তাঁর প্রবর্তিত সাম্যবাদী দর্শন বাংলার মাটিতে উদ্ভূত ও প্রচারিত একমাত্র তরিকা ‘মাইজভাণ্ডারী তরিকা’ নামে পরিচিতি লাভ করে। এই মহান সুফিসাধককে কেন্দ্র করে গোড়াপত্তন হয় এক সুবিশাল আধ্যাত্মিক সাম্রাজ্যের, যার নাম ‘মাইজভাণ্ডার দরবার শরীফ’।
আজ ‘মহান ১০ মাঘ’। মাইজভাণ্ডার অধ্যাত্ম শরাফতের প্রতিষ্ঠাতা ও মাইজভাণ্ডারী তরিকার প্রবর্তক ইমামুল আউলিয়া, গাউসুলআজম মাইজভাণ্ডারী হজরত মাওলানা শাহসুফি সৈয়দ আহমদ উল্লাহ (কঃ)’এর ১১৫-তম পবিত্র বার্ষিক ওরশ মোবারক, লক্ষ কোটি মাইজভাণ্ডারী আশেক-ভক্তদের সর্বপ্রধান ও সর্ববৃহৎ মিলনমেলা। ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে দেশ বিদেশের লক্ষ লক্ষ আশেক ভক্ত এই মহান দিবসকে উপলক্ষ্য করে দূর দুরান্ত হতে মাইজভাণ্ডার দরবার শরীফে সমবেত হয়ে তাঁদের প্রেম ও ভক্তিপূর্ণ অর্ঘ্য পেশ করে। বহু আশেক-ভক্ত গরু, মহিষ, গয়াল, ছাগল, মুরগী যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী হাদিয়া নজরানা নিয়ে জিকির ও জুলুশ সহকারে দরবারে হাজির হয়। মাইজভাণ্ডার দরবার শরীফসহ তৎসংলগ্ন এলাকা লোকে লোকারণ্য হয়ে পড়ে। পথের পাশে বসে বাঙালি কৃষ্টির অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হওয়া ঐতিহ্যবাহী ‘মাঘের মেলা’। এ যেন শান্তিপ্রিয়, সাম্যবাদী বাঙালী জাতীর সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক চেতনার এক অভূতপূর্ব মহাসম্মিলন।
ওরশ শরীফ উপলক্ষ্যে প্রতিবছর মাইজভাণ্ডার দরবার শরীফে ব্যপক কর্মসূচী গৃহীত হয়ে থাকলেও এবছর করোনা মহামারীর কারণে আগত জায়েরীন মেহমানদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনায় রেখে ব্যপক কর্মসূচী গ্রহণ করা হয় নি। তবে, গাউছিয়া আহ মদিয়া মঞ্জিলের মোন্তাজেম, জিম্মাদার ও সাজ্জাদানশীন, গাউসুলআজম মাইজভাণ্ডারীর আদর্শবাহী সংগঠন ‘আঞ্জুমানে মোত্তাবেয়ীনে গাউছে মাইজভাণ্ডারী’র কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সভাপতি আলহাজ্ব শাহসুফি ডাঃ সৈয়দ দিদারুল হক মাইজভাণ্ডারীর তত্ত্বাবধানে ওরশে আগত দেশ বিদেশের আশেক-ভক্ত, জায়েরীনদের জন্য থাকা-খাওয়া, স্যানিটেশন, প্রাথমিক চিকিৎসা, পার্কিং, নিরাপত্তা, নির্বিঘ্নে চলাচলের জন্য লাইটিং এবং নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহসহ সব ধরণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা স্থানীয় প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, স্বেচ্ছাসেবী খাদেমান ও এলাকাবাসীর সহায়তায় ইতোমধ্যেই নেয়া হয়েছে। দরবার শরীফে ওরশ উপলক্ষ্যে আগত জায়েরীন মেহমানদের নিরাপত্তার স্বার্থে জনসমাগম যথাসম্ভব হ্রাস করার লক্ষে বিভিন্ন জেলার আশেক-ভক্তদের সরকার নির্দেশিত স্বাস্থ্যবিধি মেনে ভিন্ন ভিন্ন দিনে দরবার শরীফে আসার আহ্বান জানানো হয়েছে। গতকাল ২৩ জানুয়ারি শনিবার কোরআনখানি, মিলাদ ও খতমে গাউছিয়া আদায়ের পর রওজা-এ-পাকে গিলাফ চড়ানো হয়েছে। আজ ওরসের প্রধান দিবস (১০ মাঘ) ২৪ জানুয়ারি স্থানীয় প্রশাসনের আহবানে কেন্দ্রীয়ভাবে মিলাদ ও মুনাজাত পরিচালনা না করে ছোট ছোট দল করে পালাক্রমে জিয়ারত ও ফাতেহা পাঠের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। দরবার শরীফে বিভিন্ন পয়েন্টে স্বেচ্ছাসেবক দলের মাধ্যমে হ্যান্ড স্যানিটেশন, মাস্ক বিতরণ সহ বিভিন্ন স্থানে সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
গাউছিয়া আহমদিয়া মঞ্জিলের নায়েব মোন্তাজেম ও ওরশ শরীফ সুপারভিশন কমিটির প্রধান সমন্বয়কারী শাহজাদা সৈয়দ হোসেইন রাইফ নুরুল ইসলাম রুবাব মাইজভাণ্ডারী জানান, ওরশ শরীফে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, সার্বক্ষণিক শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখা আশেক ভক্তগণের যাতায়াত, ইবাদত-বন্দেগী, হাদিয়া চলাচল নির্বিঘ্ন রাখা এবং দরবার শরীফ এলাকায় সকল ধরনের বাদ্য-বাজনা মাইক্রোফোন,অডিও ভিডিও ফিল্ম প্রদর্শন থেকে সকলকে বিরত থাকার জন্য সংশ্লিষ্ট সকল স্বেচ্ছাসেবী খাদেমানদের প্রতি নির্দেশনা দেয়া হয়েছে জানিয়েছেন।
উল্লেখ্য, ফটিকছড়ি থানার আজিমনগর নিবাসী ইমাম সৈয়দ আবদুল কাদের (রহঃ)’র প্রপৌত্র মাওলানা শাহসুফি সৈয়দ মতিউল্লাহ (রঃ)’র পবিত্র ঔরসে ১৮২৯ ঈসায়ী, ১২৪৪ হিজরী, ১২৩৩ বাংলা ১ মাঘ, বুধবার জোহরের সময় হযরত মাওলানা শাহসুফি সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী (কঃ) জন্মগ্রহণ করেন। চার বছর বয়সে গ্রাম্য মক্তবে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয়। পরবর্তীতে ১২৬৮ হিজরী সনে তিনি কলকাতা আলীয়া মাদ্রাসার শেষ পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে পাশ করে হিজরী ১২৬৯ সনে যশোর জেলার কাজী (বিচারক) পদে যোগদান করেন। তিনি ভারতের হজরত মাওলানা আবু শাহামা মুহাম্মদ ছালেহ লাহোরী (রঃ)’র কাছ থেকে তরিকত চর্চা ও আধ্যাত্মিক ফয়েজ অর্জন করেন। ১২৭০ হিজরীতে কাজী পদ থেকে পদত্যাগ করে কলকাতার মুন্সি বু-আলী মাদ্রাসায় প্রধান মোদাররেস পদে যোগদান করেন। তাঁর চারিত্রিক গুণাবলী ও জ্ঞানের গভীরতায় মুগ্ধ হয়ে কলকাতাবাসী তাঁর ওয়াজ শুনার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকতেন। তাঁর পীরে তরিকত ছিলেন শেখ সৈয়দ আবু শাহামা মুহাম্মদ ছালেহ আল কাদেরী লাহোরী (রঃ)। অপরদিকে, স্বীয় পীরের নির্দেশে পীরে তরিকতের বড়ভাই হজরত শাহ সৈয়দ দেলাওয়ার আলী পাকবাজ (রঃ)’র কাছ থেকেও তিনি কুতুবিয়তের ফয়েজ অর্জন করেন। কঠোর রেয়াজত সাধনা পীরের নির্দেশেই ১৮৫৭ ঈসায়ী সনে তিনি নিজ জন্মভুমি মাইজভাণ্ডার গ্রামে ফিরে এসে হেদায়েত কার্যে মননিবেশ করেন। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর বুজুর্গির সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। জাতি, ধর্ম, নির্বিশেষে বিভিন্ন শ্রেনী পেশার অগুনিত মানুষ তাঁর বেলায়ত ও প্রেমবাদের দুর্বার আকর্ষণে তাঁর দরবারে ভিড় জমাতে থাকে। তাঁর বুজুর্গির প্রভাবে সাধারণ গ্রাম মাইজভাণ্ডার লোকসমাজে ‘মাইজভাণ্ডার দরবার শরীফ’-এ পরিণত হয়। অতঃপর ৭৯ বছর জাগতিকভাবে মানবজাতিকে হেদায়তের দায়িত্ব পালন করে ১৯০৬ ঈসায়ীর ২৩ জানুয়ারী, ১৩১৩ বাংলার ১০ মাঘ, ১৩২৩ হিজরীর ২৭ জিলক্বদ প্রেমাস্পদ মহান রবের আহবানে সাড়া দিয়ে এই মহান সাধক ওফাত বরণ করেন। প্রতিবছর তাঁর খোদামিলনের এই মহিমান্বিত ক্ষণের স্মারক উপলক্ষ্য ‘মহান ১০ মাঘ’ মাইজভাণ্ডারী আশেক-ভক্ত এই দরবার শরীফে সমবেত হয়ে তাঁদের প্রেম ও ভক্তিপূর্ণ অর্ঘ্য প্রদান করেন এই মহান অলিয়ে কামেলের রওজা শরীফে। তাঁর ওফাতের শতাব্দীকালেরও অধিক সময় পর তাঁর প্রেমময় জীবনদর্শনের দুর্বার আকর্ষণে আজো তাঁর পবিত্র দরবার ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে শান্তিকামী, মুক্তিউন্মুখ মানুষের এক অভূতপূর্ব মিলনকেন্দ্র হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছে।