রোবটের দুনিয়ায় নিয়ে যাচ্ছে কোভিড-১৯

কোভিড-১৯–এর বিস্তার ঠেকাতে গিয়ে বিশ্বের সব দেশ বর্তমানে অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপসহ বিশ্বের বেশ কিছু অঞ্চল এখন স্বাভাবিক হতে শুরু করলেও একটি বড় জনগোষ্ঠী কাজে ফিরতে পারছেন না। কারণ, সবকিছু আগের মতো করে চালু হয়নি এখনো। হলেও যে সবার কর্মহীনতা ঘুচবে, তা কেউ হলফ করে বলতে পারছে না।

বৈশ্বিক মহামারির কারণে হঠাৎ স্থবির হয়ে পড়ার বাস্তবতায়, বিশেষ করে উৎপাদন ও সরাসরি সেবা খাতে স্বয়ংক্রিয়করণের চাহিদা তৈরি হয়েছে ব্যাপকভাবে। মালিকেরা উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে এ ধরনের কাজে রোবট নিয়োগের কথা ভাবছেন। বিশেষ করে প্রযুক্তিতে এগিয়ে থাকা উন্নত বিশ্বে এ ধরনের প্রবণতা তৈরি হয়েছে ব্যাপকভাবে।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের গণ্ডিতে ঢুকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে জোর গবেষণা চালাচ্ছিল ধনী ও উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। এ নিয়ে নিয়মিত বিভিন্ন খবরাখবর আগে থেকেই আসছিল। মানুষ বিস্ময় নিয়ে এসব খবর দেখেছে। হঠাৎ কোনো রেস্তোরাঁয় রোবট দিয়ে খাবার পরিবেশন করার খবর শুনে বন্ধুদের সঙ্গে তা নিয়ে হয়তো কেউ ব্যাপক আড্ডায় মেতেছে। কারও বা হয়তো বুকে কাঁপন ধরেছে কাজ হারানোর ভয়ে। কিন্তু পরক্ষণেই তা আবার হেসে উড়িয়েও দিয়েছে নিশ্চয়। কিন্তু এখন যখন একটি ভাইরাস সবকিছুতে বিনা বাক্যব্যয়ে তালা ঝুলিয়ে দিল, তখন সেই আশঙ্কাই আবার ফিরে এসেছে। আর এবার তা ফিরে এল অনেক বেশি প্রামাণ্যভাবে।

কোভিড-১৯–এর কারণে সারা বিশ্বের কর্মক্ষম মানুষের অর্ধেকই কাজ হারাবে বলে আগেই পূর্বাভাস দিয়েছিল আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে নতুন করে চার কোটির বেশি মানুষ বেকার হওয়ার খবর এসেছে। উন্নত বিশ্বের বাকি দেশগুলোর দশাও ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশের মতো দেশগুলোয় অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রম বেশি হওয়ায় সুনির্দিষ্ট সংখ্যা জানা সম্ভব নয়। তবে তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের হাহাকার যখন কান পাতলেই শোনা যায়, তখন অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের অবস্থা সহজেই অনুমেয়। আইএলও বলছে, কোভিড-১৯–এর কারণে শুধু এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলেই অন্তত সাড়ে ১২ কোটি মানুষ কাজ হারাবে। আর ইউরোপে পাঁচ কোটির বেশি মানুষ কাজ হারাবে। সংকটের গভীরতা বুঝতে এটুকু তথ্যই যথেষ্ট।

প্রযুক্তির উৎকর্ষে অনেকটাই এগিয়ে চীন। বিশ্বের এই অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তিও অটোমেশনের ওপর তার নির্ভরতা বাড়াচ্ছে। কতটা? বলা হচ্ছে, বিশ্বের অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে চীনে এ প্রযুক্তি বেশি ব্যবহার হচ্ছে। সেন্টার ফর ইনোভেটিং ফিউচার জানাচ্ছে, বিশ্বের অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় চীন অটোমেশন বেশি ব্যবহার করে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, কারখানার কাজে রোবট ব্যবহার থেকে শুরু করে নানাভাবেই তারা এটি করছে। অথচ বেশি জনঘনত্বের দেশ হওয়ায় অন্য রকমই ভাবা হতো।

অবশ্য বৈশ্বিক এ মহামারির আগে থেকেই অটোমেশন ও রোবটের কাছে কাজ হারাতে শুরু করেছিল মানুষ। বহু প্রতিষ্ঠান একটু একটু করে প্রযুক্তির ওপর নিজেদের নির্ভরতা বৃদ্ধি করছিল। এ নিয়ে সমালোচনাও তৈরি হচ্ছিল। বিভিন্ন দিকে দেখা দিচ্ছিল শ্রম অসন্তোষও। অনেকে আবার যথেষ্ট অটোমেশন হয়েছে, বলে আপাতত ক্ষান্ত হচ্ছিলেন। কিন্তু কোভিড-১৯ যখন শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার নীতি মানার দাবি নিয়ে হাজির হলো, যখন সবকিছু বন্ধের দাওয়াই একমাত্র চেনা দাওয়াই হলো, তখন দেখা গেল কিছুই আসলে অটোমেটেড হয়নি। ফলে এই পরিস্থিতিতে প্রতিষ্ঠানগুলো এখন ভয়াবহভাবে অটোমেশনের দিকে ঝুঁকছে। এ ক্ষেত্রেও যুক্তরাষ্ট্র ও চীন পাল্লা দিয়ে ছুটছে। এ দুই দেশের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে জাপানও।

চীনের সরকারি তথ্য বলছে, গত বছর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক গবেষণায় দেশটি তাদের মোট দেশজ উৎপাদনের আড়াই শতাংশ বা ৩৫ হাজার ৫৪০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছিল। একই খাতে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগই একমাত্র চীন থেকে বেশি। এই বৈশ্বিক মহামারির সময়ে অন্য সব দেশের মতোই চীনের অর্থনীতিও বিপাকে রয়েছে। কিন্তু এই সময়েই চীন এ খাতে ৪২ হাজার ৩০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করছে। আগামী ছয় বছরের মধ্যে উচ্চ প্রযুক্তির খাতে চীন ২ লাখ ৪৭ হাজার ডলার বিনিয়োগ করা হবে বলে জানিয়েছে সাংহাই সিকিউরিটিজ নিউজ।

সমস্যাটি অন্য জায়গায়। আর তা হলো, অটোমেশন বা অনুরূপ প্রযুক্তির প্রতি মানুষের সমর্থন বাড়ছে। করোনা-পূর্ব সময়ে এই রোবট বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকেন্দ্রিক অটোমেশনের প্রতি মানুষের যে সমর্থন ছিল, তা বর্তমানে দ্বিগুণ হয়েছে। ফলে এ ধারা বেগবান হবে সন্দেহ নেই। আর এটি গোট বিশ্বকেই এক নতুন বাস্তবতায় নিয়ে দাঁড় করাবে।

প্রযুক্তির এই ধাপে আসার পথে মানুষ নগর গড়ে তুলেছে। গ্রামীণ জনপদে জন্মানো ব্যক্তিটি শহরের খোঁজ করেছে। কাজের জন্য, উপার্জনের জন্য শহরমুখী হয়েছে সে। এই নগরসভ্যতাই প্রযুক্তির উৎকর্ষটি দিয়েছে বলতে হয়। এই প্রযুক্তি যত তার চূড়ান্ত উৎকর্ষের কাছে যাচ্ছে, নগরে ততই মানুষ উদ্বাস্তু হচ্ছে। অর্থাৎ, এখন পাল্টা স্রোতের কাল। মানুষকে এখন তার নিজের তৈরি এই নগরকে যন্ত্রের হাতে ছেড়ে দিয়ে মূল ঠিকানায় ফিরতে হবে। এবার একেবারে নিম্ন আয়ের অদক্ষ শ্রমিকেরাই উদ্বাস্তু হবে না। এবার এ দলে যোগ দেবে শিক্ষিত ও দক্ষ শ্রমিকেরাও। নগরকে তারা রোবট ও স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের হাওলা করে চলে যেতে বাধ্য হবে গ্রামে। এই ফেরা কোনোভাবেই রোমান্টিক নয়। কারণ, কোনো একটি খাত যখন এই প্রযুক্তির সুবিধা পাবে, তখন তা অন্য খাতগুলোও নিতে শুরু করবে। যেহেতু রোবটকে কোনো বেতন দিতে হয় না, সেহেতু এটি মালিকপক্ষ সাদরে গ্রহণ করবে সন্দেহ নেই। কিন্তু একই সঙ্গে এর মাধ্যমে যে শূন্যস্থান তৈরি হবে, যেভাবে একাধিক শ্রেণি আক্রান্ত হবে, তাতে এর রাজনৈতিক ধাক্কাটি সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে উঠতে পারে।