২০১৮ বিশ্বকাপের বছর মদরিচের বছর

বিশ্বকাপের বছরে বাকি সবকিছুই চলে যায় পেছনের পাতায়। রিয়াল মাদ্রিদের টানা তৃতীয় চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ের ঐতিহাসিক কীর্তির পরও তাই ফুটবলের ২০১৮ সালটা শুধুই ফ্রান্সের। গত ১৫ জুলাই মস্কোর লুঝনিকিতে গোলপ্রসবা ফাইনালে ক্রোয়েশিয়াকে ৪-২ গোলে হারিয়ে ২০ বছর পর বিশ্বসেরার মুকুট পুনরুদ্ধার করেছে ফ্রান্স।

দস্যি-দামাল তারুণ্যের তেজ বিশ্ব মঞ্চে ছড়িয়েছে ফরাসি সৌরভ। ফেভারিট তত্ত্বকে অচল প্রমাণ করা পালাবদলের এই বছরে ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের মানদণ্ডে ফুটবলের উজ্জ্বলতম দুই মুখ কিলিয়ান এমবাপ্পে ও লুকা মদরিচ। দুটি প্রতীকী ছবিতেই সেটা স্পষ্ট।

বিশ্বকাপের শেষ ষোলোতে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে ফ্রান্সের ৪-৩ গোলের রোমাঞ্চকর জয়ের পর গোটা বিশ্ব অবাক চোখে দেখেছিল লিওনেল মেসিকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন এমবাপ্পে। বছরের শেষভাগে ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোকে হারিয়ে লুকা মদরিচের ব্যালন ডি’অর জয়ের ছবিটাও একটি যুগের অবসানের বার্তা। আধুনিক ফুটবলের দুই দিকপাল মেসি ও রোনাল্ডোর এক দশকের আধিপত্যে ছেদ টেনে এ বছর ফুটবলের ব্যক্তিগত সব পুরস্কারই জিতে নিয়েছেন ক্রোয়েশিয়া ও রিয়াল মাদ্রিদের নীরব জাদুকর মদরিচ। আর ফরাসি বিস্ময় এমবাপ্পের মাঝে ফুটবল খুঁজে পেয়েছে আগামীর বিশ্বসেরাকে।

মেসির আর্জেন্টিনার বিপক্ষে ১৯ বছর বয়সী এমবাপ্পের সেই গতির ঝড় বহুদিন ফুটবল রোমান্টিকদের চোখে লেগে থাকবে। ব্রাজিলীয় কিংবদন্তি পেলের পর প্রথম টিনএজ তারকা হিসেবে বিশ্বকাপে এক ম্যাচে জোড়া গোলের পর ফাইনালেও মদরিচের ক্রোয়েশিয়ার হৃদয় ভেঙে ফের পেলের স্মৃতি ফিরিয়ে আনেন এমবাপ্পে।

এর আগে ১৯৯৮ সালে প্রথম যেবার বিশ্বকাপ জিতেছিল ফ্রান্স, তখনও জন্মই হয়নি এমবাপ্পের। দুই দশক আগে বিশ্বজয়ে দলকে যিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, সেই দিদিয়ের দেশম এবার কোচের ভূমিকায় ফ্রান্সকে এনে দিয়েছেন দ্বিতীয় বিশ্বকাপ ট্রফি। একঝাঁক তরুণ তুর্কির ওপর আস্থা রেখে করেছেন বাজিমাত। ফ্রান্সের বিশ্বকাপ জয়ে এমবাপ্পের মতোই উজ্জ্বল ছিলেন আঁতোয়া গ্রিজমান।

তবে ফাইনালে হেরেও বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়ের স্বীকৃতি পান ক্রোয়েশিয়ার অধিনায়ক মদরিচ। ক্রোয়েশিয়ার মতো ছোট একটি দেশকে প্রথম বিশ্বকাপের ফাইনালে তুলে নতুন রূপকথাই লিখেছেন মদরিচ। এর আগে-পরে রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে জিতেছেন চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ও ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ। সোনায় মোড়ানো বছরে মাঝমাঠের এই জাদুকরের হাতে একে একে উঠেছে উয়েফা, ফিফা ও ফ্রান্স ফুটবল ম্যাগাজিনের বর্ষসেরার পুরস্কার।

তবে কী মেসি-রোনাল্ডো যুগের অবসান হল? তা বলা যাচ্ছে না। একই দিনে বিশ্বকাপের শেষ ষোলো থেকে বিদায় নেয়ার পর আর্জেন্টিনা ও পর্তুগালের জার্সিতে আর মাঠে নামেননি এ দুই মহাতারকা। তবে ক্লাব ফুটবলে বছর জুড়েই আলো ছড়িয়েছেন তারা। এ বছর মেসিই করেছেন সবচেয়ে বেশি গোল। বার্সেলোনার হয়ে জিতেছেন লা লিগা ও কোপা দেল রে।

অন্যদিকে রিয়ালকে টানা তৃতীয় চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতিয়ে বিশ্বকাপের পর গোটা বিশ্ব কাঁপিয়ে জুভেন্টাসে পাড়ি জমান রোনাল্ডো। এরপর তার বিরুদ্ধে ওঠা ধর্ষণের অভিযোগ নিয়ে অনেক জলঘোলা হলেও জুভেন্টাসের জার্সিতে আগুনে ফর্মে আছেন পর্তুগিজ যুবরাজ। ক্লাব ফুটবলে বড় দলগুলোর আধিপত্য অক্ষুণœ থাকলেও আন্তর্জাতিক ফুটবলে বড় ধরনের ভূমিকম্প ঘটে গেছে।

বিশ্বকাপের গ্র“পপর্ব থেকে জার্মানি এবং শেষ ষোলো থেকে স্পেন ও আর্জেন্টিনার বিদায় ছিল অভাবনীয়। আরেক হট ফেভারিট ব্রাজিলকে কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বিদায় করে দেয় বেলজিয়াম। ইংল্যান্ডের সেমিফাইনালে খেলাটাও কম বিস্ময়কর নয়।

বিশ্বকাপে এই প্রথম তৃতীয় হওয়া বেলজিয়াম বছর শেষ করেছে ফিফা র‌্যাংকিংয়ের শীর্ষে থেকে। বিশ্বকাপে ভরাডুবির পর এ বছরই হওয়া নতুন টুর্নামেন্ট উয়েফা নেশন্স লিগেও ব্যর্থতার ষোলোকলা পূর্ণ করেছে জার্মানি। তারপরও টিকে গেছেন কোচ জোয়াচিম লো। একইভাবে তিতের কোচিংয়েও আস্থা হারায়নি ব্রাজিল। তিতেও আস্থা হারাননি তার অধিনায়ক নেইমারের ওপর।

রাশিয়া বিশ্বকাপে পারফরম্যান্সের চেয়ে অযথা পড়ে যাওয়ার অভিনয়ের জন্য বেশি আলোচনায় ছিলেন নেইমার। তার ডাইভ দেয়ার প্রবণতা নিয়ে কম ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ হয়নি। বিশ্বকাপের হতাশা ভুলে এ মৌসুমে অবশ্য পিএসজির জার্সিতে চেনা ছন্দেই আছেন ব্রাজিলীয় ফরোয়ার্ড। পিএসজিতে এমবাপ্পের সঙ্গে নেইমারের রসায়নও দারুণ জমে উঠেছে।