আজিমপুর কবরস্থানে চিরনিদ্রায় ড. আনিসুজ্জামান

    ঢাকার আজিমপুর কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান। গতকাল সকাল ১০টায় আল মারকাজুল ইসলামী নামের একটি সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবীরা তাকে সমাহিত করেছে। এর আগে সকাল ৯টার দিকে স্বেচ্ছাসেবীরা সিএমএইচ থেকে আনিসুজ্জামানের মরদেহ গ্রহণ করে। পরে তারা কোভিড-১৯ নীতিমালা মেনেই গোসল ও কাফনের ব্যবস্থা করে। সেখান থেকেই আজিমপুর কবরস্থানে নিয়ে সমাহিত করা হয়। সমাহিত করার আগে ঢাকা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাকে গার্ড অব অর্নার দেয়া হয়।
    বৃহস্পতিবার বিকাল ৪টা ৫৫ মিনিটে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) মারা যান ৮৩ বছর বয়সী আনিসুজ্জামান। তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক এবং গবেষক ছিলেন।
    জাতীয় এই অধ্যাপক হৃদরোগ, কিডনি, ফুসফুসে জটিলতা, পারকিনসন্স ডিজিজ এবং প্রোস্টেটের সমস্যায় ভুগছিলেন। শেষ দিকে তার রক্তে ইনফেকশন দেখা দিয়েছিল। মৃত্যুর পর তার নমুনা পরীক্ষা করা হলে করোনা ভাইরাস পজিটিভ আসে।
    অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের মৃত্যুর খবরে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেন। এক শোকবার্তায় প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ বলেন, ড. আনিসুজ্জামান ছিলেন বাংলা সাহিত্য ও সাংস্কৃতির এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। বাংলাদেশে শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে তিনি অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছেন। তার মৃত্যু বাংলাদেশের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে পড়ার দিনগুলোতে আনিসুজ্জামানকে পেয়েছিলেন শিক্ষক হিসেবে। এক শোক বার্তায় তিনি বলেন, তার মত বিদগ্ধ ও জ্ঞানী মানুষের মৃত্যুতে দেশের এক অপূরণীয় ক্ষতি হল।
    গতকাল আজিমপুরে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের জানাজার সময় সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী, বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের লিটু, আনিসুজ্জামানের জামাতা আজিমুল হক, ভাই আখতারুজ্জামান, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা বাবর আলী মীর এবং সমাজকল্যাণ কর্মকর্তা শাহাদাত হোসেনসহ কয়েকজন আত্মীয় উপস্থিত ছিলেন।

    আজিমপুর কবরস্থানে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী খালিদ বলেন, সর্বজন শ্রদ্ধেয় জাতীয় অধ্যাপক ও বাংলা একাডেমির সভাপতি আনিসুজ্জামান-এর মৃত্যুতে দেশ ও জাতির যে ক্ষতি হল তা অপূরণীয়, শতবর্ষেও তা পূরণ হবার নয়। বাংলাদেশের শিক্ষা ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ছিলেন এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। অনাবিল সমাজ হিতৈষী, গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল চেতনা, সুশীল বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা ও ব্যক্তিগত মণীষা দিয়ে তিনি নিজেকে পরিণত করেছিলেন দেশের অগ্রগণ্য পুরুষে। তিনি বলেন, দেশের ক্রান্তিলগ্নে তিনি জাতিকে সঠিক পথের দিশা দেখিয়েছেন বারংবার। মহান ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধসহ সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তার অবদান জাতি কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করবে।

    অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ১৯৩৭ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারি পশ্চিমবঙ্গে জন্মগ্রহণ করেণ। শিক্ষা জীবনের শুরুটা তার সেখানেই হয়েছে। দেশভাগের সময় তিনি কলকাতার একটি স্কুলের সপ্তম শ্রেনির শিক্ষার্থী ছিলেন। এরপর পরিবারের সঙ্গে তিনি চলে আসেন বাংলাদেশ। ঢাকার প্রিয়নাথ হাই স্কুল থেকে ১৯৫১ সালে ম্যাট্রিক এবং জগন্নাথ কলেজ থেকে ১৯৫৩ সালে আইএ পাস করেন। ১৯৫৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও পরের বছর স্নাতকোত্তর শেষ করে সেখানেই শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করে ১৯৬৫ সালে তিনি শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পোস্ট ডক্টরাল ডিগ্রি পান।

    ১৯৬৯ সালে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের রিডার হিসেবে যোগ দেন। গণঅভ্যুত্থানের সেই উত্তাল সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য শিক্ষকদের সঙ্গে তিনি আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় ছিলেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে আনিসুজ্জামান চলে যান ভারতে। সেখানে প্রথমে শরণার্থী শিক্ষকদের সংগঠন বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। পরে বাংলাদেশের প্রথম সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে যোগ দেন। ১৯৮৫ সালে চট্টগ্রাম, থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেরেন আনিসুজ্জামান। সেখানে দেড় যুগ শিক্ষকতা করে ২০০৩ সালে অবসর নেন। দুই বছরের মাথায় আবার তাকে সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক হিসেবে বাংলা বিভাগে ফিরিয়ে আনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

    মওলানা আবুল কালাম আজাদ ইনস্টিটিউট অফ এশিয়ান স্টাডিজ (কলকাতা), প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় এবং নর্থ ক্যারোলাইন স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ভিজিটিং ফেলো হিসেবেও কাজ করেছেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের এই শিক্ষক। দীর্ঘ কর্মজীবনে শিক্ষকতা, গবেষণা ও মৌলিক সাহিত্য রচনার পাশাপাশি একক ও যৌথভাবে অসংখ্য গ্রন্থ সম্পাদনা করেছেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। ভাষা ও শিক্ষায় অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন অসংখ্য সম্মাননা। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য ১৯৮৫ সালে সরকার তাকে একুশে পদকে ভূষিত করে। সাহিত্যে অবদানের জন্য ২০১৫ সালে তিনি পান স্বাধীনতা পুরস্কার। ভারত সরকার ২০১৪ সালে তাকে পদ্মভূষণ পদকে ভূষিত করে। ২০১৮ সালের ১৯ জুন বাংলাদেশ সরকার জামিলুর রেজা চৌধুরী ও রফিকুল ইসলামের সঙ্গে আনিসুজ্জামানকেও জাতীয় অধ্যাপক ঘোষণা করে।

    অধ্যাপক আনিসুজ্জামান রাষ্ট্রের দুই সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা স্বাধীনতা পুরস্কার ও একুশে পদক লাভ করেছেন। তিনি একাত্তর সালে দেশের প্রথম সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ছিলেন। বাহাত্তরে তিনি কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনের সদস্য ছিলেন। তার হাত ধরেই বাংলাদেশ সংবিধানের বাংলা সংস্করণ এসেছে। সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদ ও যুদ্ধপরাধের বিচারের সোচ্চার আনিসুজ্জামান ১৯৯১ সালে গঠিত গণআদালতে অভিযোগকারীদের একজন ছিলেন। বাংলা অধ্যাপকের পাশপাশি তিনি সাহিত্য-গবেষণা, লেখালেখি, সাংগঠনিক কার্যক্রম ও সংকটকালে দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্যের জন্য অনন্য চরিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন।

    আমৃত্যু তিনি ছিলেন বাংলা একাডেমির সভাপতি। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান কৈশোর বয়স থেকেই তিনি রাষ্ট্রভাষার আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ভাষার দাবিতে মানুষকে সচেতন করার জন্য প্রথম যে বই প্রকাশ করা হয়েছিলো সেটি তিনি প্রকাশ করেছিলেন।