পেকুয়ায় ছিনতাই, ধর্ষণ, খুনের মত অপরাধে সক্রিয় তারা!

 পেকুয়া(কক্সবাজার)প্রতিনিধি

কক্সবাজারের পেকুয়ায় কিশোর অপরাধ জগত নিয়ন্ত্রণ করছে বেশ কয়েকটি গ্যাং। ভারী কোনো অস্ত্র নয় সাধারণ ছুরি ও ধারালো অস্ত্র দিয়েই এসব গ্যাংয়ের সদস্যরা খুন, ধর্ষণ, চুরি, ছিনতাই, দখল-বেদখলের মত কাজ করে যাচ্ছে। এমনকি নির্মমভাবে খুন করতেও কোন ধরণের দ্বিধা করেননা।  দিনদিন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে এসব গ্যাংয়ের সংখ্যা। থানা পুলিশসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারী থাকলেও নানা কৌশলে এসব অপরাধী এলাকায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। বিশেষ করে স্কুল-কলেজগামী মেয়েরা এসব গ্যাংয়ের সদস্যদের কাছে প্রতিনিয়তই নাজেহাল হচ্ছে। কিশোর ও যুবকদের সমন্বয়ে গড়া এসব গ্যাংয়ের উৎপাতে সর্বত্রই আতঙ্ক বিরাজ করছে। এতে স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের পরিবারগুলো রয়েছে শঙ্কায়। এদিকে এসব গ্যাংয়ের নেপথ্যে ‘বড়ভাই’রূপী গডফাদার থাকায় তারা দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে। এ ক্ষেত্রে পেকুয়া থানা প্রশাসনের ওসি কামরুল আজমের নেতৃত্বে কর্মকর্তারা ব্যাপক অভিযান অব্যাহত রেখেছে। একই সাথে র‌্যাবের কার্যকরী ভুমিকায় স্বীকৃত কয়েকজন অপরাধী নিহত ও পলাতক রয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, পেকুয়ায় ক্রমেই বাড়ছে কিশোর অপরাধ। মা-বাবার অবাধ্য সন্তান ও নেশাগ্রস্ত একশ্রেণীর বখাটেরা সংগঠিত হয়ে কিশোর গ্যাং গড়ে তুলেছে। এছাড়াও য্বুকদের সমন্বয়ে উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়নে বিভিন্ন নাম ধারণ করে সংগঠনও গঠন করেছে তারা। তাদের কাজ হচ্ছে খুনাখুনি, ধর্ষণ, চুরি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, ইভটিজিংসহ নানা অপরাধ। ভাড়া নির্ধারণ করে বসতবাড়ি, জমি ও দোকান দখল করে দেয়া, দখলকৃত জমিতে ঘর তৈরি করা এবং তৈরি করা ঘর ভেঙে দেয়ার মত কাজ করে থাকেন। এমনকি ধর্ষণের মত ঘটনা ঘটাতে তারা দ্বিধা করেনা। সাত ইউপির মধ্যে এর রকম অপরাধীরা পেকুয়া, টইটং ও মগনামা ইউনিয়নে বেশ তৎপরতা চালিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। ইতোমধ্যে প্রশাসনের অব্যাহত অভিযানে খুন, চুরি, ধর্ষণের অভিযোগে কিশোর গ্যাংয়ের বেশ কয়েকজন সদস্য গ্রেপ্তারও হয়েছেন। নেশার মধ্যে গাঁজা, ইয়াবা ও মদে বেশি আসক্ত তারা। এ সমস্ত নেশা সেবন করে বিভিন্ন অপরাধ সংগঠিত করে থাকে।  এছাড়াও এসব নেশাদ্রব্য তারা বিক্রিও করে থাকে।

পেকুয়া সদরের বটতলিয়া পাড়ার মোঃ আলীর ছেলে সাদ্দাম, সাগর, রিদুয়ান, বাহাদুরের ছেলে সালাউদ্দিন, গিয়াস উদ্দিনের ছেলে মোঃ কাইছার (সদ্য জেল ফেরত), নুরুজ্জামানের ছেলে আবুল শামা, মছিন্যাকাটা চকরিয়ার তোফাইল (বর্তমানে পেকুয়ায় নানার বাড়িতে থাকে) বাইম্যাখালী এলাকার হাধু ফকিরের ছেলে মকসুদ, মোঃ কালুর ছেলে ফয়সাল, জিয়াবুল, কামাল হোসেনের ছেলে মজিদ, সামশুল আলমের ছেলে মোঃ ইসমাঈল, মৃত বদিউল আলমের ছেলে ইউসুফ আলী, আনোয়ার হোসেনের ছেলে বদর আলম, শাহাব উদ্দিনের ছেলে মোঃ ইব্রাহিম, দুধু মিয়ার ছেলে মনিয়া, জয়নাল আবদীনের ছেলে জমির, কবির আহমদের ছেলে লোকমান, মামুইয়্যা, গোঁয়াখালী উত্তর পাড়ার বেবি আক্তারের ছেলে মোঃ এমরান, কুলসুমার ছেলে সুমন, অপরাধ কর্মকান্ডে জড়িত। তারা ইয়াসিন গ্রুপ, টুপি গ্রুপ ও সালাউদ্দিন গ্রুপ নামে পরিচিত। এর মধ্যে বেশ কয়েকজনের হাতে খুন হন বাইম্যাখালী এলাকার আবুল হাশেম, সিকদার পাড়ার মোঃ হেলাল (সাবেক বিডিআর)।

সদর শেখের কিল্লা ঘোনার সাজ্জাদ হোসেনের নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী কিশোর গ্যাং পরিচালিত হচ্ছিল। চম্পা নামের এক তরুণীকে ধর্ষণের পর হত্যা ঘটনায় সদ্য পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন। তার সহযোগি নন্দীর পাড়ার মোঃ আলীর ছেলে জয়নাল একই অপরাধে র‌্যাবের হাতে আটক হয়ে জেলে রয়েছে। শেখের কিল্লা ঘোনার মৃত রাজা মিয়ার ছেলে নুরুল হোছাইন, আদর্শ পাড়ার মৃত রশিদ আহমদের ছেলে ফরিদ উদ্দিন পুতু, মৌলভী পাড়ার আবুল হোসেনের ছেলে রবো, মিয়ার পাড়ার আবদু রশিদের ছেলে লিটন, মাতবর পাড়ার মদন আলীর ছেলে সেলিম, সাবেকগুলধি এলাকার মৃত মোস্তাকের ছেলে তারেক, ছিরাদিয়া এলাকার গিয়াস উদ্দিনের ছেলে মোঃ জহির ও ফোরকান ওই গ্রুপের সদস্য। পেকুয়া মৌলভী পাড়ার ‘ফ’ চৌমহুনীর ‘ম’ অধ্যাক্ষরের দুই ব্যক্তি তাদের নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।

শিশু আরফাত ও স্কুল ছাত্রী আয়েশাকে নির্মমভাবে হত্যার অভিযোগে মগনামার দরদী ঘোনা এলাকার মোঃ রায়হান, মিয়াজি পাড়া এলাকার মোঃ মানিক, মিয়া পাড়া এলাকায় ফারুক বর্তমানে জেল হাজতে থাকলেও তাদের টেন স্টার গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ করছে ১৫ জনের মত একদল কিশোর। মগনামা বাজার পাড়া এলাকার কিশোর সাইদুলকে হত্যার অভিযোগে গ্রেপ্তার কিশোর গ্যাংয়ের তিন নেতা নুরুল হোছাইনের ছেলে রহিম, গুরা মিয়ার ছেলে বাপ্পি ও ফরিদের ছেলে জিয়াউর রহমান জেল হাজতে থাকলেও গ্যাংটি সক্রিয়ভাবে পরিচালিত হচ্ছে। উজানটিয়া ইউনিয়নে বেলাল ও করিম নামে দুই কিশোরের হাতে রয়েছে ৩০ জনের মত একটি কিশোর গ্যাং সিন্ডিকেট।

রাজাখালী ইউয়িনের হাজির পাড়ার নুরুল আবছারের ছেলে জিয়াবুল ইসলাম, হাজির পাড়ার মিনহাজ উদ্দিন, মোঃ ইউনুছের ছেলে মোঃ জাহেদ, মৌলভী পাড়ার মোঃ মানিক, কাঞ্চন পাড়ার মোঃ হোছাইন, বদি উদ্দিন পাড়ার আন্টু, এনাম, মাদক বিকিকিনি, চুরি ও ছিনতাইয়ের ঘটনায় জড়িত। তাদের বিরুদ্ধে মামলা চলমান থাকলেও ভয় পায়না অপরাধ করতে।

টইটংয়ের দা-বাহিনী আবারো সক্রিয় হয়ে ওঠেছে। আবদুল হামিদ, আবদুল মালেক ও জমিরসহ আরো কয়েকজন ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি অপরাধ সংগঠিত করেছে। দেশীয় অস্ত্র সজ্জিত হয়ে তারা সব সময় পাহাড়ে অবস্থান নেয়ায় আতংকের মধ্যে বসবাস করছে এলাকাবাসীরা।

শিলখালীতে বাড়িতে ডাকাতি করতে গিয়ে খুন করে নুরুনবী নামে এক প্রবাসীকে। এ ঘটনায় স্থানীয়রা ক্ষিপ্ত হয়ে জামাল হোসেন ও কাইছার নামে দুই ডাকাতকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করে। বর্তমানে সাপের ঘারা ও উত্তরের ঝুম এলাকায় অস্ত্রধারী ডাকাতদলের অবস্থান রয়েছে। পুলিশের জোরালো অভিযানে ডাকাতিরমত ঘটনা কমে এসেছে। তবে চুরি, ছিনতাই ও মাদকসেবির সংখ্যা বেড়ে  চলেছে।  এছাড়াও বারবাকিয়ার কাদিমাকাটা এলাকার আবদুল মালেকের ছেলে মোঃ ফোরকান এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করতে নানা অপরাধ কর্মকান্ড পরিচালনা করে যাচ্ছে।

অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, সিএনজি শ্রমিক নামধারী বেশ কয়েকজন অপরাধী পেকুয়ায় নানা অপরাধ কর্মকান্ডে জড়িত রয়েছে। রাতের আধারে ওই সমস্ত অপরাধীরা ইয়াবা সেবন করে চুরি, ছিনতাই ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটায়। সদ্য চম্পাকে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় সিএনজি চালক জয়নাল র‌্যাবের হাতে আটক হয়েছেন।

স্থানীয় বশে কয়েকজন এলাকাবাসী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এ সমস্ত অপরাধীরা মদক সেবন করে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। ছোট ছোট অপরাধ করতে করতে এক সময় বড় অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। স্থানীয় প্রশাসন তালিকা প্রস্তুত করে তাদেরকে আইনের আওতায় না আনলে আরো বড় ধরণের অপরাধ হতে পারে। তাদেরকে যারা আশ্রয় প্রশ্রয় দেন তাদেরকেও আইনের আওতায় আনতে হবে। রাতের আধারে যারা সিএনজি চালায় তাদেরকেও নজরদারীতে রাখতে হবে। রাত হলে গাড়ি চলাচল বন্ধ রাখলে অপরাধ অনেকাংশে কমে যাবে। এছাড়াও স্থানীয় প্রশাসন যদি গ্রাম পুলিশদের সাথে কথা বলে কারা মাদক সেবন করে ছোট ছোট অপরাধ করে তাদের তালিকা করে আইনের আওতায় নিয়ে আসে তাহলেও আইনশৃঙ্খলা উন্নতিতে ভুমিকা রাখবে।

এবিষয়ে জানতে চাইলে পেকুয়া থানার ওসি কামরুল আজম বলেন, করোনা মহামারীর আগে ছোট বড় সব অপরাধীর বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযান অব্যাহত ছিল। বর্তমানে মহামারীর সুযোগে কিছু ছোট অপরাধ সংগঠিত হলেও প্রশাসন এক্ষেত্রে সক্রিয় রয়েছে। ইতোমধ্যে চম্পা হত্যা মামলার আসামীকে পেকুয়া থানা পুলিশ গ্রেফতার করেছে। এছাড়াও মাদক সেবী ও বিক্রেতার বিরুদ্ধে প্রশাসনের পক্ষ থেকে জিরো টলারেন্স রয়েছে। তালিকা প্রস্তুত করে তাদেরকেও দ্রুত আইনের আওতায় আনা হবে।