জীবনানন্দ ও বনলতা সেন কবিতা

জসিম উদ্দিন মনছুরি

কবি জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪) বাংলা সাহিত্যে প্রকৃতি চেতনার কবি হিসেবে সুখ্যাতিতে সমুজ্জ্বল। তিনি একাধারে কবি ,প্রাবন্ধিক, সমালোচক ও ঔপন্যাসিক হিসেবে সমধিক পরিচিত। তার কবিতায় লক্ষ্য করা যায় প্রকৃতি চেতনা, ইতিহাস – ঐতিহ্য , উপমার সুনিপুণ ব্যবহার ও পরাবাস্তবতার একগুচ্ছ সম্মিলন। তিনি প্রকৃতিতে লীন হয়ে প্রকৃতির মাঝেই জীবনের সুখ খোঁজে পেতে চেয়েছিলেন। তাঁকে বাংলা সাহিত্যে নৈসর্গের কবি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। প্রকৃতি চেতনা নিয়ে তাঁর মতো করে কোন কবি এতো বেশি লিখে যান নি। যে কোনো কবি তাঁর পূর্বসূরীদের দ্বারা প্রভাবিত হন কিন্তু কবি জীবনানন্দ দাশ তাঁর মতো করেই স্বতন্ত্রভাবে বাংলা সাহিত্যে নিজের নামকে সমুজ্জ্বল করে রেখে গেছেন। নদীমাতৃক বাংলাদেশের বরিশাল বিভাগে তাঁর জন্ম হওয়ায় তিনি ছোটকাল থেকে নদীর সাথে পরিচিতো ছিলেন। এ সূত্রে তাঁর কবিতায় এসেছে নদীর কথা, প্রকৃতির কথা, ও পরাবাস্তবতার কথা। বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি জীবনানন্দ দাশ বাংলা সাহিত্যে রেখে গেছেন অনন্য কৃতিত্বের স্বাক্ষর। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থে বিদ্রোহী কবি নজরুলের প্রভাব থাকলেও পরবর্তীতে তিনি স্বমহিমায় কাব্যচর্চা করে গেছেন নিজস্ব ধ্যান ধারণায় আপন স্বকীয়তায়। তাঁর তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ বনলতা সেন কাব্যের বনলতা সেন কবিতাটি বাংলা কবিতায় শ্রেষ্ঠ কবিতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি পঠিত কবিতার মধ্যে বনলতা সেন কবিতা অন্যতম। যাকে আশ্রয় করে কবিতাটি রচিত সেই বনলতা সেনের পরিচয় এখনো ধোঁয়াশায় রয়ে গেছে। কবি জীবনানন্দ দাশও বনলতা সেনের পরিচয় স্পষ্ট করেননি। লাজুক কবিকে বনলতা সেন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি শুধু মুচকি হাসি দিয়েছিলেন ; কোন উত্তর দেননি। সমালোচকদের মতে বনলতা সেন তার স্বপ্নের নায়িকা। আবার অনেকের ধারণা বনলতা সেন মানে বনের তরুলতা।

তবে প্রচলিত আছে তখনকার কোন এক সময়ে কবি ট্রেনযোগে সফর করছিলেন। কবির কামরায় মামার সাথে যাচ্ছিলেন অপ্সরিতুল্য সুন্দরী বনলতা সেন। দীর্ঘক্ষণ পথ চলতে চলতে একজন অপরজনের দিকে চোখাচোখি হচ্ছিলো বেশ। লাজুক কবির পক্ষে লাজুকতা ভেঙ্গে বনলতা সেন এর সাথে পরিচয় হওয়া সম্ভবপর হচ্ছিলো না। বনলতা সেনের মামা কোন এক স্টেশনে খাবার সংগ্রহের জন্য নেমে পড়লে সে সুযোগে কবির সাথে বনলতা সেনের ক্ষণিকের আলাপচারিতা হয়। যা কবিকে শিহরিত করেছিলো।প্রশান্তি দিয়েছিলো অতিমাত্রায়। ফলশ্রুতিতে কবি লিখে ফেললেন বনলতা সেনের শৈল্পিক বর্ণনা দিয়ে বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবিতা বনলতা সেন। বনলতা সেন কবিতায় কবি মানব সৃষ্টির ইতিহাস থেকে শুরু করে ইতিহাস ঐতিহ্য ও প্রকৃতির অনিন্দ্য সুন্দর বর্ণনা তুলে ধরেছেন। সেই সাথে তিনি সব পাখি ঘরে আসে হারায় এ জীবনের সব লেনদেন বলে পাখির রূপকে পরাবাস্তবতার একটি চিত্র তুলে ধরেছেন। বনলতা সেন কবিতায় ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্থান সিংহলসমুদ্র, মালয়সাগর, বিম্বিসা, দারুচিনি দ্বীপ, শ্রাবস্তী ইত্যাদির কথা শিল্প সফলভাবে তুলে ধরেছেন। পৃথিবীর আদিলগ্ন থেকে মানুষের যে অনন্ত পথচলা তার চিত্র কবি জীবনানন্দ দাশ বনলতা সেন কবিতায় তুলে ধরছেন এভাবে-হাজার বছর ধরে আমি পথ হাটিতেছি পৃথিবীর পথে। অর্থাৎ পৃথিবীর আদিলগ্ন থেকে মানুষ পৃথিবীকে আবাদ করে আসছে তার চিত্র অতি চমৎকারভাবে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন। মানুষ নিজেদের প্রয়োজনে গড়ে তোলে শহর-নগর ও সভ্যতা। তার চিত্র এখানে উল্লেখ করা হয়েছে। মানুষের প্রয়োজনে মানুষ গড়ে তুলেছে ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সভ্যতা। প্রকৃতি থেকে শুরু করে এখানে নগর জীবনের কথা তিনি বনলতা সেন কবিতায় কৃতিত্বের সাথে তুলে ধরেছেন। পৃথিবীর কোলাহল ও যান্ত্রিকতায় কবি বিতৃষ্ণ হয়ে গিয়েছিলেন।

দু’দণ্ড সুখের নেশায় হাজার বছর ধরে পথ হেঁটেও সুখ খুঁজে পাননি। দু’দণ্ড সুখ খুঁজে পেয়েছিলেন তিনি বনলতা সেনের কাছে। তার কথা তিনি এভাবে তুলে ধরছেন-আমি ক্লান্ত প্রাণ এক চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন/আমারে দু’দণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন। এখানে তিনি যে উপমা ব্যবহার করছেন সেই উপমাগুলি তার আগে অন্য কোন কবি ব্যবহারের কৃতিত্ব দেখাতে পারেননি। চুলের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন-চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা। মুখের সৌন্দর্য বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি কারুকার্যময় শ্রাবস্তী শহরের সাথে তুলনা করে বলেন, মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য। বনলতা সেনের চুলের বর্ণনায় দেখা যায় তিনি এতই বিমোহিত হয়েছিলেন যে তা বর্ণনাতীত। তিনি বনলতা সেনের চুলের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে হিতাহিত জ্ঞান শূন্য দিগ্বিদিক হারা নাবিকের মতো হয়েছিলেন। চোখের বর্ণনা দিয়েছেন তিনি এভাবে যে বর্ণনাটা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ উপমা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পাখির নীড়ের সাথে তিনি চোখের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন-পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন। মানুষ যখন চলতে চলতে ক্লান্ত হয়ে যায় সম্ভবত তার দেহের অবচয় ঘটে তখন মৃত্যুই অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়। মানুষ পরপারের দিকে যাত্রা করে তিনি তার বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে – সব পাখি ঘরে আসে সব নদী ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন। জীবনের দেনা পাওনা চুকিয়ে সবাইকে পরকালে চলে যেতে হবে এটা চিরন্তন সত্য এ কথাটা তিনি বর্ণনা করেছেন।নির্দিষ্ট আয়ু শেষে মানুষকে ঠিকঠাক অনন্তহীন গন্তব্যে চলে যেতে হয় ।এ কথাটা তিনি এখানে চমৎকারভাবে চিত্রায়িত করেছেন। মানুষের জীবনের প্রারম্ভ যেমন অন্ধকার বা অন্তঃসারশূন্যতা তেমনি জীবনের শেষেও মহাশূন্যতা। তিনি তার বর্ণনায় এভাবে দিয়েছেন- থাকে শুধু অন্ধকার মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন। সবকিছু অন্ধকারে নিমজ্জিত হলেও প্রকৃতি থাকে জীবন্ত, অনিন্দ্য সুন্দর।

প্রকৃতির মাঝেই মানুষ খুঁজে জীবনের প্রকৃত সুখ। প্রকৃতির সাথে জন্ম জন্মান্তরে মানুষের মিতালি গড়ে উঠেছে। প্রকৃতির ভালোবাসায় প্রকৃতির দানে মানুষ পৃথিবীতে এখনো বেঁচে আছে। এ কথাটি কবি এখানে বলতে চেয়েছেন। যতই ক্লান্তি আসুক যতই ইতিহাস ঐতিহ্য এর জন্য মানুষ প্রতিযোগিতা করুক না কেনো প্রকৃতি হচ্ছে আসল। প্রকৃতি হচ্ছে মানুষের জন্ম জন্মান্তরের ঠিকানা। পরিশেষে বলা যায় কবি জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেন কবিতাটিতে যেমন রয়েছে মানব সৃষ্টির ইতিহাস, ইতিহাস ও ঐতিহ্য চেতনা, প্রকৃতির স্বভাব, পরাবাস্তবতা, অনিন্দ্য সুন্দর উপমার সমাহার। ফলে কবিতাটি হয়ে উঠেছে বাংলা কবিতায় অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা।