ঘুণে ধরা সমাজ ও রাষ্ট্রকে সংস্কার করার এখনই সময়: চবি উপাচার্য

ঘুণে ধরা সমাজ ও রাষ্ট্রকে মেরামত করার এখনই সুবর্ণ সময়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীরাই এ সংস্কারের সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। এ সুযোগকে আমাদের যথাযথভাবে কাজে লাগাতে হবে। বিগত সরকার রাষ্ট্রের যে অর্থ লুট করে বিদেশে পাচার করেছে, তা দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করতে হবে। রাষ্ট্রচিন্তা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত ‘নির্বাচন ও সংবিধান সংস্কার’ শীর্ষক আলোচনা সভায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্য প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার এ কথা বলেন।

২৭ অক্টোবর ২০২৪ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় চবি উপাচার্য বলেন, ‘বিগত দলীয় সরকারগুলো নিজেদের স্বার্থের জন্য কাজ করেছে। দেশের জনগণের জীবন-মান উন্নয়নের জন্য তারা মোটেও ভাবেনি। জুলাই বিপ্লবের ফলে একটা সুবর্ণ সুযোগ এসেছে এ দেশের জনগণের পাশে থেকে কাজ করার। এ সুযোগকে আমাদের কাজে লাগাতে হবে। তিনি আরও বলেন, বিগত সরকারগুলো রাজনীতির নামে ছাত্র সংগঠনগুলোকে দিয়ে দুরবীত্তায়ণ করেছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান বানানো হয়েছে। উন্নয়নের নামে বিপুল পরিমাণ রাষ্ট্রীয় অর্থ বিদেশে পাচার করা হয়েছে। তিনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সংস্কারের জন্য একটি রাষ্ট্রীয় সংস্কার কমিটি গঠনের ব্যাপারে সরকারের নিকট জোর দাবী জানান। তিনি বলেন, বিগত সরকারের সময়ে বিচারের নামে দেশের মানুষের সাথে প্রহসন করা হয়েছে। স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা নিশ্চিত করে স্বাধীন নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। মাননীয় উপাচার্য বিগত সরকারের আমলে বেশ কয়েকটি নির্বাচনের দুর্নীতি ও অনিয়মের চিত্র তুলে ধরে সভায় বিস্তারিত আলোচনা করেন। তিনি বলেন, এ দেশ অপার সম্ভাবনার দেশ। এ দেশের মানুষের মৌলিক অধিকার, গণতান্ত্রিক অধিকারসহ সকল অধিকার ফিরিয়ে আনতে ছাত্র সমাজকে সব সময় সজাগ থাকতে হবে।

আলোচনা সভায় চবি মাননীয় উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) প্রফেসর ড. মোঃ কামাল উদ্দিন বলেন, বিগত ১৫ বছর ধরে সরকার জনগণকে রাষ্ট্র নিয়ে নয়, অন্য বিষয় নিয়ে চিন্তা করতে শিখিয়েছিল। এ সময়ে আমরা অর্ধেক মানুষ ছিলাম। ’২৪ এর গণআন্দোলনের পর পূর্ণ মানুষ হওয়ার সুযোগ পেয়েছি। সংবিধানে বর্ণিত মৌলিক অধিকারের অনেকগুলোই হরণ করা হয়েছে। সংবিধানে একজনকে অধিক ক্ষমতা দেয়ায় অনেক সমস্যা হচ্ছে। এটা বদলাতে হবে। নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। রাজনৈতিক সুযোগ যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারলে সংবিধান ও নির্বাচন কমিশন সংশোধন সুফল বয়ে আনবে। তিনি ছাত্র-জনতাসহ সকলকে নিজ নিজ অবস্থানে থেকে রাষ্ট্র সংস্কারে শামিল হওয়ার আহ্বান জানান।

সভায় বিশিষ্ট সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জনাব হাসনাত কাইয়ুম তার বক্তব্যের শুরুতেই চবি উপাচার্যের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান মাননীয় উপাচার্য প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার দেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সবসময় সোচ্চার ছিলেন, এখনো আছেন। এ বিষয়ে তিনি বিগত সময়ে প্রচুর লেখালেখি করে বিগত সরকারকে অন্ধকার থেকে আলোর পথ দেখানোর চেষ্টা করেছেন। সংবিধান বিশেষজ্ঞ হাসনাত কাইয়ুম বলেন, ‘রাষ্ট্রচিন্তা’ বর্তমান পরিবর্তনের আগে থেকে কাজ শুরু করেছে। এখন তাদের চিন্তা আরও জোরালোভাবে উপস্থাপন করা সম্ভব। বর্তমান যে রাষ্ট্র আমরা পেয়েছি, তার কাঠামো পেয়েছি বৃটিশদের থেকে। তারা সব কিছু সাজিয়েছিল এককভাবে ক্ষমতা প্রয়োগ করে এখানকার সম্পদ নেয়ার জন্য। কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী একটা দেশকে পাল্টে দিতে পারে। মানুষের কষ্টার্জিত অর্থ ফ্যাসিবাদীরা বিদেশে পাচার করেছে বৃটিশদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে। ভোট ছাড়া নির্বাচন দিয়ে সেটার ভিত্তিতে নাকি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছেন তারা! আওয়ামী লীগ এখন বলবে, ভালো নির্বাচন ব্যবস্থা করা দরকার। বিচার ব্যবস্থা ধ্বংস করা হয়েছে। বিদ্যুৎ খাতে কেনাকাটার জবাবদিহিতা চাওয়া যাবে না বলে তারা আইন পাস করেছে। ৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করতে হবে। বিচার বিভাগ স্বাধীন করতে হবে। স্থানীয় সরকার সংস্কার করতে হবে। তারা সেবা করবে। সংসদ সদস্যরা শুধু আইন বানাতে পারবে। অর্থনৈতিক খাতে সংস্কার করতে হবে। অধিকার প্রতিষ্ঠাই রাষ্ট্র সংস্কারের মূল কথা। শর্তাবলী দিয়ে অধিকার হরণ করা চলবে না।

আলোচনা সভায় চন্দনপুরা দারুল উলুম আলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষক, বিশিষ্ট চিন্তক মুহাম্মদ মনির উদ্দিন বলেন, রাজনীতি ও নৈতিকতা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ধর্ম যেহেতু নৈতিকতার ওপর জোর দেয়, তাই রাজনীতি থেকে ধর্ম বিচ্ছিন্ন করা যায় না। নাগরিক হিসেবে সবাই সমান। সবার অধিকার সমান। সকল ধর্মের অনুসারীদের অধিকার রক্ষা করতে হবে। সকল ক্ষেত্রে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। সংস্কার করতে হলে সকলে মিলে প্রচেষ্টা করতে হবে। নতুনভাবে লিখলে সংবিধানের বিদ্যমান মূলনীতিগুলো বাদ দেয়া উচিত।

অনুষ্ঠানে নির্ধারিত আলোচক হিসেবে প্রখ্যাত রাজনৈতিক বিশ্লেষক ডাঃ জাহেদ উর রহমান উপস্থিত হতে না পেরে সকলের জন্য অডিও বার্তা পাঠিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।

রাষ্ট্রচিন্তা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপদেষ্টা এবং চবি যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জনাব সায়মা আলমের সভাপতিত্বে এবং রাষ্ট্রচিন্তা, চবি’র সহ-সভাপতি সাদিয়া আফরোজ তৃনার সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন রাস্ট্রচিন্তা চবি’র সভাপতি এস.বি. ফখরুল হোসেন (রিফু)। আলোচনা সভায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগ ও ইনস্টিটিউটের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, আমন্ত্রিত অতিথি, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিক ও সুধীবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। আলোচনা সভায় উন্মুক্ত প্রশ্নোত্তর পর্বে উপস্থিত শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং সুধীবৃন্দ অংশগ্রহণ করে বিভিন্ন প্রশ্ন করেন এবং তাদের মতামত ব্যক্ত করেন। আলোচকবৃন্দ তাদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন। অনুষ্ঠানে গণআন্দোলনে শহীদদের স্মরণে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।