মুসলিমদের বেঈমানী ও প্রতিশ্রুত আযাব

ফিরোজ মাহবুব কামাল: মুসলিম হওয়ার অর্থই হলো, মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডাকে বিজয়ী করার ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদ নিয়ে বাঁচা। পবিত্র কুর”আনে ঘোষিত মহান আল্লাহতায়ালার সে এজেন্ডাটি হলো: “লি‌ ইউয‌’হিরাহু আলা দ্বীনি কুল্লিহি”। অর্থ: সকল ধর্ম, মতবাদ, জীবনদর্শনের উপর ইসলামের বিজয়। সে এজেন্ডার ঘোষণা এসেছে সুরা তাওবা, সুরা ফাতাহ ও সুরা সাফয়ে। পবিত্র কুর’আনে মাহে রমযানের রোজার হুকুম এসেছে মাত্র একবার। আর তাতেই প্রতিটি মুসলিম রোজা পালন করে। অথচ জিহাদের হুকুম এসেছে অসংখ্যবার। কিন্তু মুসলিম সে জিহাদে নাই।

অথচ গৌরব যুগের মুসলিমদের চিত্রটি ভিন্নতর ছিল। এমন কোন মুসলিম ছিল না যাদের জীবনে জিহাদ ছিলনা। ।এবং অর্ধেকের বেশী সাহাবা শহীদ হয়ে গেছেন। সেকালের মুসলিমদের থেকে আজকের মুসলিমদের মূল পার্থক্য এখানেই। সেকালের মুসলিমগণ বাঁচতো মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডাকে বিজয়ী করার জিহাদ নিয়ে, আর আজকের মুসলিমগণ বাঁচে নিজের, নিজ দলের, নিজ গোত্রের বা নিজ জাতির এজেন্ডাকে বিজয়ী করার যুদ্ধ নিয়ে। তাদের যুদ্ধে আল্লাহতায়ালার এজেন্ডার কোন স্থান নাই। ফলে সেকালের মুসলিমগণ পেয়েছে মহান আল্লাহতয়ালার সাহায্য ও বিজয়; আর আজকের মুসলিমগণ পাচ্ছে পরাজয়, অপমান ও আযাব।

পরিতাপের বিষয় হলো, মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডার সাথে একাত্ম হওয়া দূরে থাক, ক’জন মুসলিম সে এজেন্ডার কথা জানে? সেটি জানতে হলে পবিত্র কুর’আন না বুঝে তেলাওয়াত করলে চলে না, পুরোপুরি বুঝতে হয়। অথচ সে কুর’আন বুঝার কোন তাড়না নাই। অথচ এই কুর’আন বুঝার প্রয়োজনে মিশর, ইরাক, সিরিয়া, সুদান, আলজিরিয়া, লিবিয়া, মরক্কো, তিউনিসিয়া, মৌরতানিয়ার জনগণ নিজেদের মাতৃভাষা পরিত্যাগ করে আরবী ভাষা গ্রহণ করেছিল।

বুঝতে হবে, যারাই মহান আল্লাহতায়ালার সে ঘোষিত এজেন্ডার সাথে একাত্ম হয় -একমাত্র তারাই প্রকৃত ঈমানদার। এমন ঈমানাদারদের জীবনে অবশ্যই জিহাদ এসে যায়। আগুনের সাথে তার উত্তাপ যেমন একত্রে চলে, তেমনি মুসলিম জীবনে ঈমান ও জিহাদ একত্রে চলে। জিহাদ না থাকার অর্থ ঈমান না থাকা। যেমন উত্তাপ না থাকার অর্থ আগুন না থাক। নামাজের ওয়াক্ত দিনে ৫ বার, আর জিহাদের ওয়াক্ত প্রতিক্ষণ। নামাজের আযান দেয় মুয়াজ্জিন, আর জিহাদের আযান দেন খোদ আল্লাহতায়ালা। পবিত্র কুর’আনে অসংখ্যবার ধ্বনিত হয়েছে সে আযান। নামাজে কাজা আছে, কিন্তু জিহাদে কাজা নাই।

মু’মিনের জিহাদটি মিথ্যার বিরুদ্ধে সত্যের; অনৈসলামের বিরুদ্ধে ইসলামের। প্রতিটি জিহাদের চুড়ান্ত লক্ষ্য হলো, শত্রুর বিরুদ্ধে বিজয়ী হওয়া। সে জিহাদে বিজয়টি সৈনিকদের সংখ্যাবল ও অস্ত্রবলে ঘটেনা। মুসলিমদের লোকবল কি কম? কিন্তু ১৫০ কোটির বেশি মুসলিমও কোন বিজয় পাচ্ছে না। বিজয়ের জন্য অতি জরুরি হলো মুসলিমের ঈমান। ঈমানদারদের বিজয়ী করার দায়িত্বটি খোদ আল্লাহতায়ালা নিয়েছেন। তাদের জন্য বিজয় প্রতিশ্রুতি শোনানো হয়েছে সুরা আল ইমরানের ১৩৯ নম্বর আয়াতে। বলা হয়েছে:

وَلَا تَهِنُوا۟ وَلَا تَحْزَنُوا۟ وَأَنتُمُ ٱلْأَعْلَوْنَ إِن كُنتُم مُّؤْمِنِينَ

অর্থ: “এবং তোমরা হতোদ্যম হয়ো না এবং দুঃখিত হয়ো না; তোমরাই বিজয়ী যদি মুমিন হয়ে থাকো।”

তাই বিজয়ী হওয়ার শর্ত হলো ঈমানদার হওয়া। এখানেই মুসলিমদের ব্যর্থতা। তারা নিজেদের মুসলিম রূপে দাবী করলেও ব্যর্থ হয়েছে ঈমানদার হতে। বুঝতে হবে মুসলিম হওয়া এবং ঈমানদার হওয়ার অর্থ এক নয়। কালেমা শাহাদত পাঠের মধ্য দিয়েই একজন ব্যক্তি নিজেকে মুসলিম রূপে ঘোষণা দিতে পারে। কিন্তু ঈমানদার হতে হলে তাকে আর বহুদূর এগুতে হয়। তাকে মহান আল্লাহতায়ালা ও রাসূলের পূর্ণ আনুগত্য নিয়ে বাঁচতে হয়। সেটি বুঝা যায়, সুরা হুজরাতের ১৪ নম্বর আয়াতে বর্ণিত মহান আল্লাহতায়ালার বয়ান থেকে। বলা হয়েছে:

قَالَتِ ٱلْأَعْرَابُ ءَامَنَّا ۖ قُل لَّمْ تُؤْمِنُوا۟ وَلَـٰكِن قُولُوٓا۟ أَسْلَمْنَا وَلَمَّا يَدْخُلِ ٱلْإِيمَـٰنُ فِى قُلُوبِكُمْ ۖ وَإِن تُطِيعُوا۟ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ لَا يَلِتْكُم مِّنْ أَعْمَـٰلِكُمْ شَيْـًٔا ۚ إِنَّ ٱللَّهَ غَفُورٌۭ رَّحِيمٌ ত

অর্থ: ‍“বেদুঈন আরবরা বললো, ‍“আমরা ঈমান এনেছি।” বল (হে মহম্মদ), “তোমরা ঈমান আননি, বরং বলো, আমরা আত্মসমর্পণ করেছি। আর এখন পর্যন্ত তোমাদের অন্তরে ঈমান প্রবেশ করেনি।” আর যদি তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করো, তাহলে তিনি তোমাদের আমলসমূহের কোন কিছুই হ্রাস করবেন না। নিশ্চয়ই আল্লাহ অধিক ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” মুসলিম হওয়ার অর্থ আত্মসমর্পণ, আর ঈমানদার হওয়ার অর্থ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পূর্ণ আনুগত্য। আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে ঈমানদার হওয়ার পথে যাত্রা শুরু হয় মাত্র। কিন্তু পূর্ণ ঈমানদার হতে হলে পূর্ণ পালন নিয়ে বাঁচতে হয় মহান আল্লাহতায়ালা ও তাঁর রাসূলের প্রতিটি হুকুমের। বিষয়টি বুঝার জন্য উদাহরন দেয়া যাক। যুদ্ধে কোন জার্মান সৈনিক ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করলেই সে ব্রিটিশ হয়ে যায়না। ব্রিটিশ হতে হলে তাকে ব্রিটিশ রাজা বা রানীর সার্বভৌমত্ব, ব্রিটিশ আইন ও ব্রিটিশ মূল্যবোধের প্রতি অনুগত হতে হয়।

ঈমানদারের জীবনে আল্লাহতায়ালা ও তাঁর রাসূলের হুকুমের প্রতি পূর্ণ আনুগত্যই হলো মূল। সে আনুগত্যই তাকে মুমিনের মর্যাদা দেয়। রব’য়ের কোন হুকুমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ব্যক্তিকে কাফির ও মুনাফিক বানায়। মহান আল্লাহতায়ালা ও তাঁর রাসূলের প্রতি আনুগত্য শুধু নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাতে হলে চলে না, সেটি হতে হয় রাষ্ট্র পরিচালনা, বিচার-আচার, শিক্ষা-সংস্কৃতি, অসত্য ও অবিচারের নির্মূলে এবং সত্য ও সুবিচারের প্রতিষ্ঠার জিহাদেও। নবীজী (সা:)’র অনুসরণের অর্থ: তিনি যে ভাবে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা দিলেন এবং ১০ বছর যাবত সে রাষ্ট্র পরিচালনা ও প্রতিরক্ষা করলেন -সেটির অনুসরণও। কিন্তু মুসলিমদের মাঝে কোথায় সে অনুসরণ? নবীজী (সা:) প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব ও তাঁর শরিয়তী আইনের। মুসলিমদের মাঝে বেঁচে আছে কি সে সূন্নত? মুসলিম শুধু মুসলিম হয়েই থেমেই আছে, ঈমান তাদের হৃদয়ে প্রবেশ করেনি। অর্থাৎ তারা সত্যিকার মু’মিন হয়নি।

মহান আল্লাহতায়ালা সুরা হুজরাতের উপরিউক্ত ১৪ নম্বর আয়াতে আরব বেদুঈনদের হৃদয়ে ঈমান প্রবেশ না করার যে রোগটি বর্ণনা করেছেন -সে রোগ নিয়ে বাঁচছে আজকের অধিকাংশ মুসলিম। তাদের হৃদয়ে ঈমান ঢুকলে তাদের মাঝে মহান আল্লাহতায়ালা ও তার রাসূলের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য দেখা যেত। সে আনুগত্য শুধু নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাতে সীমিত থাকতো না। তখন প্রতিষ্ঠা পেত ইসলামী রাষ্ট্র। তখন প্রতিষ্ঠা পেত মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব ও শরিয়তী আইন। তখন শুরু হতো দুর্বৃত্তির নির্মূল ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার বিরামহীন জিহাদ। তখন সৃষ্টি হতো ভাষা, বর্ণ ও ভৌগলিক পরিচয়ের বিভক্তি ভেঙ্গে একতাবদ্ধ মুসলিম উম্মাহ গড়ার অদম্য তাড়না। তখন জাতীয় ও গোত্রীয় রাষ্ট্রের বদলে গড়ে উঠতে ইসলামী সভ্যতার যুক্তরাষ্ট্র। বুঝতে হবে, মহান আল্লাহতায়ালা ও তাঁর রাসূলের অনুসরণের অর্থ পূর্ণ অনুসরণ। ইসলামে মহান আল্লাহতায়ালা ও তাঁর রাসূলের আংশিক অনুসরণের কোন স্থান নাই; থাকলে ইবলিসকে অভিশপ্ত শয়তান হতে হতো না। বুঝতে হবে পূর্ণ অনুসরণে যেখানে অনাগ্রহ বা বিদ্রোহ -সেটিই হলো সুস্পষ্ট বেঈমানী। আজকের মুসলিম জীবনে সে বেঈমানী অতি প্রকট। ফলে কোথাও প্রতিষ্ঠা পায়ন ইসলামী রাষ্ট্র। এবং প্রতিষ্ঠা পায়নি মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব ও তাঁর শরিয়তী আইন। মুসলিম বাঁচছে পূর্ণ ইসলাম ছাড়াই এবং নিজেদের জাহির করছে ঈমানদার রূপে। এমন বেঈমানদের বিরুদ্ধে আল্লাহতায়ালার সূন্নতটি অতি সুস্পষ্ট। ঈমানদের বিজয়ী করা, ইজ্জত দেয়া এবং আখেরাতে জান্নাত দেয়া যেমন তাঁর সূন্নত, তেমনি সূন্নত হলো, বেঈমানদের পরাজিত করা, অপমানিত করা এবং আখেরাতে জাহান্নামে নেয়া।