সুরা ফাতিহা ও সুরা বাকারার শেষ দুই আয়াত পাঠের ফজিলত ও আমল

সুরা ফাতিহা ও সুরা বাকারার শেষ আয়াত দুটি পড়ে যে দোয়াই করা হোক তা কবুল করা হবে। তাকে কাঙ্ক্ষিত জিনিস দেওয়া হবে। হাদিসে পাকে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিষয়টি সুস্পষ্ট করেছেন এভাবে :-বিশ্ব নবী (সা.)-একদিন বললেন এই মাত্র আকাশের একটি দরজা খোলা হয়েছে। এর আগে কখনও এ দরজাটি খোলা হয়নি এ দরজা দিয়ে একজন ফেরেশতা অবতরণ করছেন। এর আগে তিনি কখনও পৃথিবীতে অবতরণ করেননি। এ ফেরেশতা রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে সালাম করে বলেন সুসংবাদ গ্রহণ করুন আপাদম¯তক দুটি নূরের যা আপনার আগে কোন নবীকে দেয়া হয়নি :-
১. ফাতেহাতুন কিতাব অর্থাৎ সুরা ফাতেহা এবং ২. সুরা বাকারার শেষ দুই আয়াত। উভয় আয়াতে দোয়া আছে। আল্লাহর উসিলা করেও আপনি এসব দোয়ার যে অংশই পাঠ করবেন আল্লাহ আপনাকে অবশ্যই রহমত দান করবেন (অর্থাত কবুল করা হবে)। সহীহ মুসলিম।
সুতরাং-মুমিন মুসলমানের উচিত এ হাদিসের ওপর যথাযথ আমল করা। সুরা ফাতিহা ও সুরা বাকারার শেষ দুই আয়াত পড়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করা। কাঙ্ক্ষিত জিনিস বা আকাঙ্ক্ষা পূরণে আবেদন করা। ইসলাম হচ্ছে আল্লাহতায়ালার একমাত্র মনোনীত ধর্ম। আর কোরআন হচ্ছে এমন একটি পবিত্র গ্রন্থ যেখানে সবকিছুর সমাধান রয়েছে। আল্লাহ বলেন এটা সেই কিতাব এতে কোনো সন্দেহ নেই। (সুরা : বাকারা,আয়াত : ২)। দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণে আল্লাহতায়ালা কোরআন মাজীদে বেশকিছু ফযিলতপূর্ণ আয়াত নাযিল করেছেন তন্মধ্যে একটি হচ্ছে সুরা বাকারার শেষ দুই আয়াত।
পবিত্র কোরআনের প্রথম সুরা আল ফাতিহা। মক্কায় নাজিল হওয়া সর্বপ্রথম পূর্ণাঙ্গ একটি সুরা। বিশেষ বৈশিষ্ট্য,মর্যাদা ও বিষয়ব¯তুর প্রতি লক্ষ রেখেই ফাতিহা নামকরণ হয়েছে। প্রথম তিন আয়াতে মহান আল্লাহর প্রশংসা করার পদ্ধতি,পরের চার আয়াতে ইবাদতের তাওফিক, পূর্ণ হিদায়াত ও নেক বান্দাদের মধ্যে শামিল থাকার প্রার্থনা শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। সূরা ফাতেহা সর্ব রোগের দাওয়াই। সূরা ফাতেহা যে কোনো রোগের জন্য ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরামর্শগুলো মেনে চলার পাশাপাশি আমরা সূরা ফাতেহার আমলও করতে পারি।
সুরা বাকারা। পবিত্র কোরআনের দ্বিতীয় ও বড় সুরা। এ সুরার শেষ দুটি আয়াতের রয়েছে বিশেষ ফজিলত ও তাৎপর্য। নিয়মিত এ অংশের আমল বান্দাকে নানা বিপদাপদ থেকে রক্ষা করবে। জান্নাতের পথও সুগম করবে। রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করেছিলেন হে আল্লাহর রাসুল (সা.)-কোরআনের কোন সুরা সবচেয়ে বেশি মর্যাদাবান ? তিনি বললেন সুরা এখলাস। এরপর আবার বললেন কোরআনের কোন আয়াতটি মর্যাদাবান ? তিনি বললেন আয়াতুল কুরসি। এরপর আবার বলেন হে আল্লাহর নবী (সা.)-আপনি কোন আয়াতকে পছন্দ করেন যা দ্বারা আপনার ও আপনার উম্মত লাভবান হবে। নবীজি (সা.)-বললেন সুরা বাকারার ২৮৫-২৮৬ নম্বর শেষ দুটি আয়াত। এ দুটি আয়াত কখন অবতীর্ণ হয় ? সহিহ্ মুসলিমে এ দুটি আয়াতের ব্যাপারে বর্ণিত আছে যে এ দুটি আয়াত রাসুল (সা.)-কে মিরাজের রাতে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের সঙ্গে আসমানে দান করা হয়েছে।
সূরা বাকারার শেষ দুই আয়াত : আমানার রাসুলু বিমা উনঝিলা ইলাইহি মিররাব্বিহি ওয়াল মুমিনুন। কুল্লুন আমানা বিল্লাহি ওয়া মালা ইকাতিহি ওয়া কুতুবিহি ওয়া রুসুলিহি লা নুফাররিকু বাইনা আহাদিমমির রুসুলিহি। ওয়া কালু সামিনা ওয়া আতানা গুফরানাকা রাব্বানা ওয়া ইলাইকাল মাসির। লা ইউকাল্লিফুল্লাহু নাফসান ইল্লা উসআহা–লাহা মা কাসাবাত ওয়া আলাইহা মাকতাসাবাত-রাব্বানা লা তুআখিজনা ইন-নাসিনা আও আখতানা-রাব্বানা ওয়া লা তাহমিল আলাইনা ইসরান কামা হামালতাহু আলাল্লাজিনা মিন ক্বাবলিনা-রাব্বানা ওয়া লা তুহাম্মিলনা মালা তাকাতা লানা বিহি-ওয়াফু আন্না ওয়াগফিরলানা ওয়ারহামনা-আংতা মাওলানা ফাংসুরনা আলাল কাওমিল কাফিরিন। (সুরা বাকারা : আয়াত ২৮৫-২৮৬) এ দুটি আয়াতের অর্থ হচ্ছে রাসুল ইমান এনেছেন যেসব বিষয়ের ওপর তার পালনকর্তার পক্ষ থেকে যা কিছু তাঁর প্রতি নাজিল করা হয়েছে এবং মুসলমানেরা ও তারা সবাই ইমান এনেছে আল্লাহর প্রতি আর ফেরেশতাদের প্রতি তাঁর কিতাবসমূহের প্রতি তাঁর রাসুলদের প্রতি। (তারা বলে) আমরা তার নবীদের মধ্যে কোনো তারতম্য করি না আর তারা বলে আমরা শুনেছি এবং কবুল করেছি। আমরা আপনার ক্ষমা চাই হে আমাদের পালনকর্তা আপনারই দিকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে। আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যাতীত কোনো কাজের ভার দেন না সে তাই পায় যা সে উপার্জন করে এবং তার ওপর তাই বর্তায় যা সে করে। হে আমাদের পরওয়ারদেগার! যদি আমরা ভুলে যাই কিংবা ভুল করি তাহলে আমাদের অপরাধী করবেন না। হে আমাদের প্রভু আর আমাদের ওপর এমন দায়িত্ব অর্পণ করবেন না যেমন আমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর করেছেন হে আমাদের রব! আর আমাদের দ্বারা ওই বোঝা বহন করাবেন না যা বহন করার শক্তি আমাদের নেই। আমাদের গুনাহ মাফ করে দিন আমাদের ক্ষমা করুন এবং আমাদের প্রতি দয়া করুন। আপনিই আমাদের মাওলা। সুতরাং কাফের সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আমাদের সাহায্য করুন। সুরা বাকারার শেষ আয়াত দুটি নিয়ে হাদিসে আরও অনেক ফজিলত বর্ণনা করা হয়েছে।
সূরা বাকারার শেষ দুটি আয়াতের ফজিলত প্রসঙ্গে নবী (সা.)-বলেন যে ব্যক্তি রাতে এ দুটি আয়াত পাঠ করবে তার জন্য এটাই যথেষ্ট। অর্থাৎ সারারাত সে জিন ও মানুষের অনিষ্ট থেকে নিরাপদ থাকবে এবং প্রতিটি অপ্রিয় বিষয় থেকে তাকে হেফাজত করা হবে। জুবাইর ইবনু নুফাইর (রা.)-থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সা.)-বলেছেন সুরা আল-বাকারাকে আল্লাহতাআলা এমন দুটি আয়াত দ্বারা শেষ করেছেন যা আমাকে আল্লাহর আরশের নিচের ভান্ডার থেকে দান করা হয়েছে। তাই তোমরা এ আয়াতগুলো শিখবে। তোমাদের স্ত্রীদেরও শেখাবে কারণ এ আয়াতগুলো হচ্ছে রহমত (আল্লাহর) নৈকট্য লাভের উপায় ও দীন দুনিয়ার সকল কল্যাণলাভের দোয়া। বদরি সাহাবি আবু মাসউদ (রা.)-থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সা.)-বলেছেন সুরা বাকারার শেষে এমন দুটি আয়াত রয়েছে যে ব্যক্তি রাতের বেলা আয়াত দুটি তিলাওয়াত করবে তার জন্য এ আয়াত দুটোই যথেষ্ট অর্থাৎ রাতে কোরআন মজিদ তিলাওয়াত করার যে হক রয়েছে কমপক্ষে সুরা বাকারার শেষ দুটি আয়াত তিলাওয়াত করলে তার জন্য তা যথেষ্ট। হজরত আলী (রা.)-বলেছেন আমার মতে যার সামান্য বুদ্ধিজ্ঞান আছে সে এ দুটি আয়াত পাঠ করা ছাড়া নিদ্রা যাবে না। এ আয়াত দুটো নিয়মিত পড়লে বিপদ-আপদ দূরে থাকে জান্নাতের পথও সুগম হয়। আল্লাহতায়ালা মুসলিম উম্মাহকে সকাল-সন্ধ্যা এ আয়াতের তেলাওয়াতের মাধ্যমে দুনিয়ার প্রকৃত ঈমান লাভ এবং আখিরাতের সব কল্যাণ লাভের তাওফিক দান করুন।
রাসূলুল্লাহ (সা.)-বলেন যে ব্যক্তি রাতে এ দুটি আয়াত পাঠ করবে তার জন্য এটাই যথেষ্ট। এর ব্যাখ্যায় কেউ বলেন এর অর্থ রাতের নামাজ, কেউ বলেন শয়তান থেকে মুক্তি, কেউ বলেন বিপদ থেকে মুক্তি, কেউ বলেন মানুষ ও জ্বীনের অনিষ্ট থেকে মুক্তি। নবী (সা.)-বলেছেন আল্লাহতায়ালা সাত আসমান ও জমিন সৃষ্টি করার এক হাজার বছর আগে কোরআন লিখেছেন এবং তার মাঝে দু’টি আয়াত অবতীর্ণ করেছেন। যে ঘরে এ দু’টি আয়াত পাঠ করা হয় না সে ঘরে শয়তান অবস্থান করে। সহিহ্ মুসলিম শরিফ এ দুটি আয়াতের ব্যাপারে বর্ণিত আছে যে এ দুটি আয়াত রাসুল (সা.)-কে মিরাজের রাতে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের সঙ্গে আসমানে দান করা হয়েছে। রাতের বেলা ঘুমানোর পূর্বে সুরা বাক্বারার শেষ দুই আয়াত তেলাওয়াত করলে তাহাজ্জুদ নামাযের সমান সওয়াব পাওয়ার আশা করা যেতে পারে। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.)-বর্ণনা করেন যে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এরশাদ করেন যখন আমাকে সিদরাতুল মুনতাহায় নিয়ে যাওয়া হয় তখন তিনটি জিনিস দান করা হয়। ১. পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ২. সুরা বাকারার শেষ দুই আয়াত ৩. এ উম্মতের মধ্যে যারা শিরক করে না তাদের কবিরা গুনাহ মাফ হওয়ার সুসংবাদ।
হজরত নুমান ইবনু বাশীর রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন আল্লাহতাআলা আসমান-জমিন সৃষ্টির দুই হাজার বছর আগে একটি কিতাব লিখেছেন। সেই কিতাব থেকে তিনি দুটি আয়াত নাজিল করছেন। সেই দুটি আয়াতের মাধ্যমেই সুরা আল-বাকারা সমাপ্ত করেছেন। যে ঘরে তিন রাত এ দুটি আয়াত তেলাওয়াত করা হয় ; শয়তান সেই ঘরের কাছে আসতে পারে না। (তিরমিজি-২৮৮২)। হজরত আলী (রা.)-বলেছেন এটা আমার জানা নেই-উপযুক্ত বয়সের এবং জ্ঞান-বিবেক বুদ্ধিসম্পন্ন কোনো মুসলমানদের মধ্যে এমন কেউ রয়েছে কিনা যে রাতে ঘুমানোর আগে আয়াতুল কুরসি ও সুরা বাকারার শেষ দুটো আয়াত তিলাওয়াত করে না।
হজরত মুহাম্মদ (সা.)-নবুয়ত প্রাপ্তির শুরুর দিকেই সূরা ফাতিহা এক সঙ্গে নাজিল হয়। নামাজের জন্য এ সূরাটি পড়া বাধ্যতামূলক। সূরা ফাতিহা ছাড়া নামাজ হয় না। প্রত্যেক নামাজে সূরা ফাতিহা বার বার পাঠ করা হয় বলে এ সূরাকে সূরাতুস সালাত (নামাজের সূরা) ও বলা হয়। এ সূরার ৭টি আয়াতের প্রথম ৪টি আয়াতে আল্লাহর প্রশংসা এবং শেষ তিনটি আয়াতে বান্দার প্রার্থনার কথা বর্ণনা করা হয়েছে। সূরা ফাতিহা এবং সূরা বাকারার শেষ তিনটি আয়াত হল আল্লাহর পক্ষ হতে প্রেরিত বিশেষ নূর যা ইতিপূর্বে কোনো নবী কে দেয়া হয়নি।
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সবাইকে পবিত্র কোরআন শরিফের এ বরকতময় সম্মানিত আয়াত পাঠ এবং আমল করার তাওফিক দিয়ে দুনিয়া ও আখিরাতের সব মুসিবত, বিপদ-আপদ, রোগ-শোক অতিক্রম করে শান্তিময় ও সুখের জীবনলাভে ধন্য করুন। সব চাওয়াকে পূরণ করে দেবেন। জান্নাতের পথও সুগম হয়। আমিন!
লেখক : ফখরুল ইসলাম নোমানী, ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট