পবিত্র জুমার দিনে সূরা কাহাফ তিলাওয়াতের বিশেষ ফজিলত

জুমার দিন মুসলিম উম্মাহর সাপ্তাহিক ঈদ। ইবাদতের বসন্ত। মহিমান্বিত বরকত ও ফজিলতপূর্ণ একটি দিন। বাবা-ছেলে, যুবক-বৃদ্ধা, শিশু-তরুণ সবাই উপস্থিত হয় পাড়ার মসজিদে। সে এক অভূতপূর্ব বরকতের দৃশ্যের অবতারণা। ফেরেশতাদের পাক জবান দোয়া করে মসজিদে ছুটে আসা মুসল্লিদের জন্য। আর এই জুমার দিনের বিশেষ কিছু আমল করে দিনকে বানানো যায় আরো বরকতময়। জুমার দিনে রয়েছে ফজিলতপূর্ণ অনেক আমল। এগুলো মধ্যে একটি আমল অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তা হচ্ছে জুমার দিনে সুরা কাহফ তেলাওয়াত করা। পবিত্র কোরআনুল কারীমের ১৫তম পারার ১৮নং সুরা এটি। যদি কেউ সম্পূর্ণ সুরাটি তেলাওয়াত করতে না পারে তবে সে যেন এ সুরার প্রথম এবং শেষ ১০ আয়াত অথবা যে কোনো দশ আয়াত তেলাওয়াত করে। জুমার দিনে সূরা কাহাফ তেলাওয়াতের ফজিলত সম্পর্কে হাদিস শরিফে রয়েছে বিস্তারিত আলোচনা।
হজরত বারা (রা.)-থেকে বর্ণিত এক ব্যক্তি রাতে সুরা কাহাফ তেলাওয়াত করছিলেন। তার কাছে দুটি রশি দিয়ে একটি ঘোড়া বাঁধা ছিল। এরই মধ্যে একটি মেঘ এসে তাকে ঢেকে ফেলল। এরপর যখন মেঘখটি তার কাছে চলে আসছিল তখন তার ঘোড়া ছোটাছুটি করতে লাগল। অতঃপর সকালে ওই ব্যক্তি নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে রাতের ঘটনা বললেন। তিনি বললেন ওটা ছিল সাকিনা (রহমত) যা কোরআন তেলাওয়াতের বরকতে নাজিল হয়েছিল। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন যে ব্যক্তি জুমার দিন সুরা আল-কাহাফ পড়বে তার (ঈমানের) নূর এ জুমা হতে আগামী জুমা পর্যন্ত চমকাতে থাকবে। সূরা কাহাফ পবিত্র কোরআনের অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ একটি সূরা যা মক্কায় অবতীর্ণ হয়। এর আয়াত সংখ্যা ১১০। নিয়মিত সূরাটি তিলাওয়াতে অসংখ্য সওয়াবের কথা বিভিন্ন হাদিসে বর্ণিত হলেও বিশেষত জুমার দিনে এ সূরা তিলাওয়াতের অনেক সওয়াব ও ফজিলত রয়েছে। এ সূরায় আসহাবে কাহাফ তথা ওই সব মুমিন যুবক যারা দ্বীনকে সংরক্ষণের জন্য নিজেদের কোনো এক পাহাড়ের একটি গুহায় আত্মগোপনে রেখেছিলেন। তাদের ঘটনা বর্ণিত হওয়ায় এ সূরার নামকরণ করা হয়েছে সূরা কাহাফ।
হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.)-রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন যে ব্যক্তি জুমার দিন সূরা কাহাফ তিলাওয়াত করবে তার জন্য এক জুমা থেকে অপর জুমা পর্যন্ত নূর হবে। হজরত আনাস (রা.)-বর্ণিত এ পুর্ণাঙ্গ সূরাটি এক সঙ্গে নাজিল হয়েছে এবং এর সঙ্গে ৭০ হাজার ফিরিস্তা দুনিয়াতে আগমন করেছেন। এ সূরায় আসহাবে কাহাফ তথা ওই সব মুমিন যুবক যারা দ্বীনকে সংরক্ষণের জন্য নিজেদের কোনো এক পাহাড়ের একটি গুহায় আত্মগোপনে রেখেছিলেন। তাদের ঘটনা বর্ণিত হওয়ায় এ সূরার নামকরণ করা হয়েছে সূরা কাহাফ। আবু সাইদ খুদরি (রা.)-থেকে বর্ণিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন যেমনভাবে নাজিল করা হয়েছে সেভাবে যে ব্যক্তি সূরা কাহাফ পড়বে তার জন্য সেটা নিজের স্থান থেকে মক্কা পর্যন্ত আলো হবে এবং যে শেষ দশ আয়াত পড়বে সে দাজ্জালের গনড়ির বাইরে থাকবে এবং দাজ্জাল তার ওপর কোনোরূপ প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না। রাসুল (সা.)-আমাদের আগেই সতর্ক করে দিয়েছেন আদমের সৃষ্টির পর থেকে বিচার দিবসের আগ পর্যন্ত দাজ্জালের চেয়ে বড় আর কোনো ফিতনা নেই। এটি দাজ্জালের বিরুদ্ধে একটি ঢাল।
ইবনে উমর (রা.)-থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-যে ব্যক্তি শুক্রবার দিন সূরা কাহফ পাঠ করবে তার পা থেকে আকাশের উচ্চতা পর্যন্ত নূর হয়ে যাবে যা কেয়ামতের দিন আলো দিবে এবং বিগত জুমা থেকে এ জুমা পর্যন্ত তার সব গুনাহ মাফ হয়ে যাবে। সুরা কাহাফের প্রথম দশ আয়াতে ইসলামের মৌলিক কয়েকটি বিষয়ে বলা হয়েছে। আর তাদের সতর্ক করার জন্য যারা বলে যে আল্লাহ সন্তান গ্রহণ করেছেন এ বিষয়ে তাদের কোনো জ্ঞান নেই এবং তাদের পিতৃ-পুরুষদেরও ছিল না। উদ্ভট কথাই তাদের মুখ থেকে বের হয় তারা কেবল মিথ্যাই বলে। (সুরা কাহাফ : ৪-৫)। রাসুলের (সা.)-এর ওপর ওহি অবতীর্ণ হওয়ার আলোচনা এসেছে প্রশংসা আল্লাহরই যিনি তাঁর দাসের প্রতি কিতাব অবতীর্ণ করেছেন ও এর মধ্যে তিনি কোনো অসংগতি রাখেননি। (সুরা কাহাফ : ১)
কিছু কিছু সুরা মুখস্ত করা আবশ্যক, যেমন সুরা ফাতিহা। এই সুরা ছাড়া নামাজ হয় না। আবার কিছু সুরা মুখস্ত করা আবশ্যক না হলেও সেগুলো শেখার ওপর বিশেষভাবে জোর দেওয়া হয়েছে যেমন আবার সুরা কাহাফ। সুরা কাহাফের ৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে তারা এই বাণীতে বিশ্বাস না করলে তাদের পেছনে পেছনে ঘুরে ঘুরে তুমি হয়তো দুঃখে নিজেকে শেষ করে ফেলবে। এ সুরার দশম আয়াতে একটি দোয়া আছে। এই দোয়া গুহাবাসী যুবকেরা করেছিল। হে আমাদের প্রতিপালক তুমি নিজ থেকে আমাদেরকে অনুগ্রহ দান করো ও আমাদের জন্য আমাদের কাজকর্ম সঠিকভাবে পরিচালনার ব্যবস্থা করো। কোরআন মুখস্ত করলে ইমান বৃদ্ধি হয়। সুরা আল কাহাফে কয়েকটি গল্প রয়েছে যেগুলি দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োগের জন্য বাস্তব পাঠ শেখায় এবং কোরআনের সঙ্গে দৃঢ সংযোগ গড়ে তুলতে সাহায্য করে। যেমন-পৃথিবীর ওপর যা কিছু আছে আমি সেগুলোকে তার শোভা করেছি মানুষকে এই করার জন্য যে ওদের মধ্যে কে কর্মে ভালো। (সুরা কাহাফ : ৭) সেই সঙ্গে দৈনন্দিনের আমলের বড়-ছোট সুরাগুলো শুদ্ধ করে নেওয়া খুব জরুরি। যেমন-‘চার কুল’, সুরা ইয়াসিন, ওয়াকিয়া, সুরা মুলক এবং সাপ্তাহিক সুরা আল-কাহফ ইত্যাদি।
সূরা কাহাফ তেলাওয়াতের চারটি ঘটনা থেকে চার রকম পরীক্ষার কথা জানা যায়। আসহাবে কাহাফের ঘটনা থেকে ধর্মবিশ্বাসের ওপর পরীক্ষা : দুটি বাগানের মালিকের ঘটনা থেকে সম্পদের ওপর পরীক্ষা : হজরত মুসা (আ.) ও খিজির (আ.) জ্ঞানী ব্যক্তির ঘটনা থেকে : জ্ঞানের পরীক্ষা ও জুলকারনাইনের ঘটনা থেকে ক্ষমতার পরীক্ষার বিষয়ে জানা যায়।
দাওয়াত : চারটি ঘটনায় দাওয়াতের কথা রয়েছে। আর আল্লাহ তো সব সময়ই আমাদের দাওয়াত দিয়ে যাচ্ছেন। ১৪ নম্বর আয়াতে যুবকেরা বাদশাহকে দাওয়াত দিয়েছে (আসহাবে কাহাফের ঘটনা)। ৩৭ নম্বর আয়াতে একজন সঙ্গী আরেক সঙ্গীকে দাওয়াত দিয়েছে (দুটি বাগানের মালিকের ঘটনা)। ৭০ নম্বর আয়াতে একজন শিক্ষক তার ছাত্রকে দাওয়াত দিয়েছে (হজরত মুসা (আ.) এবং জ্ঞানী ব্যক্তির ঘটনা)। ৮৭-৮৮ আয়াতে একজন শাসক তার প্রজাদের দাওয়াত দিয়েছে (জুলকারনাইনের ঘটনা)।
সুরা কাহাফে চারটি ঘটনা, চারটি বক্তব্য ও উপদেশ রয়েছে। সুরার ১ থেকে ৮ আয়াতে রয়েছে বক্তব্য। ৯ থেকে ২৬ আয়াতে আছে আসহাবে কাহাফের ঘটনা। ২৭ থেকে ৩১ আয়াতে আবার বক্তব্য এসেছে। ৩২ থেকে ৪৪ আয়াতে দুটি বাগানের মালিকের ঘটনা রয়েছে। এরপর আবার লম্বা বক্তব্য ও উপদেশ এসেছে ৪৫ থেকে ৫৯ আয়াতে।
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতি জুমার দিন এ সুরা তিলাওয়াত করতেন। এর রয়েছে ইহকালীন ও পরকালীন উপকারিতা। হজরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.)-থেকে বর্ণিত হাদিসে এসেছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন নিশ্চয়ই যে ব্যক্তি জুমার দিন সুরা কাহাফ তেলাওয়াত করবে তাকে দুই জুমার মধ্যবর্তী সময়টাতে নূর দান করা হবে। আর সুরা কাহাফের তেলাওয়াত সময় হলো বৃহস্পতিবার দিন শেষে সূর্য ডোবার পর থেকে শুক্রবার সূর্য ডোবা পর্যন্ত। সুতরাং উক্ত সময়ের যে কোনো সময় সুরা কাহাফ পাঠ করলে হাদিস অনুযায়ী আমল করা হবে। উল্লেখ্য তা এক বৈঠকে পুরা সুরা পড়া জরুরি নয় ; বরং বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর থেকে শুরু করে শুক্রবার সূর্যাস্ত পর্যন্ত একাধিক বৈঠকে ভাগ ভাগ করে উক্ত সুরা পড়ে শেষ করলেও একই সওয়াব পাওয়া যাবে ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ আমাদের প্রতি জুমাবারে এই অসাধারণ সুরাটি পড়ার ও বোঝার তৌফিক দিন। আমীন।


লেখক : ফখরুল ইসলাম নোমানী, ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট