পানি-বিদ্যুৎ সংকটে দ্বীপের মানুষ

মোখা’র আঘাত
ঘূর্ণিঝড় মোখা’র আঘাতে লণ্ডভণ্ড টেকনাফের সেন্টমার্টিন ও শাহপরীর দ্বীপ। দ্বীপ দু’টোর মানুষ ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী ক্ষয়ক্ষতি থেকে সেরে ওঠার চেষ্টা করছেন। বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি মেরামত করতে গিয়ে ভুগছেন পর্যাপ্ত উপকরণ সংকটে। এ ছাড়াও সুপেয় পানি ও তীব্র খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে এখানে। বিচ্ছিন্ন রয়েছে বিদ্যুৎ সংযোগ। কোথাও সুপেয় পানির খোঁজ পেলে ছুটছেন বাসিন্দারা। জানা গেছে, উপজেলা প্রশাসন, বিজিবি, কোস্ট গার্ড ও নৌবাহিনী থেকে কিছু শুকনো খাবার সরবরাহ করা হলেও তা পর্যাপ্ত নয়। এখন পর্যন্ত রান্না করা কোনো খাবার সরবরাহ করা হয়নি। গতকাল দুপুরে বিজিবি’র পক্ষ থেকে হেলিকপ্টারযোগে কিছু খাদ্যসামগ্রী পৌঁছায় সেন্টমার্টিনে। সেখান থেকে খাদ্য সহায়তা পায় ২৫০ থেকে ৩০০ জন।

এরমধ্যে ছিল ১ লিটার তেল, ২ কেজি চাল, আধাকেজি চিনি, আধাকেজি লবণ ও আধাকেজি ডাল। এ ছাড়া উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রায় ৬০০ জনকে ৪টি স্যালাইন, ২ লিটার পানি, আধাকেজি মুড়ি, আধাকেজি চিনি ও ১ কেজি চিড়া দেয়া হয়েছে। মূলত ট্রলার চালু না হওয়ায় নিত্যপণ্যের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে দ্বীপটিতে। এ ছাড়াও জলোচ্ছ্বাসে সমুদ্রের পানি প্রবেশ করায় মিঠাপানির উৎসগুলো লবণাক্ত হয়ে গেছে। যে কয়েকটি পুকুর ও টিউবওয়েল ঠিক আছে সেখানে সবাই সুপেয় পানির জন্য ছোটাছুটি করছে। অন্যদিকে স্থানীয় দোকানগুলোতে যে পরিমাণ খাদ্য মজুত ছিল তা শেষ হয়ে গেছে। সবমিলিয়ে কঠিন সময়ের মধ্যদিয়ে যাচ্ছেন স্থানীয় অধিবাসীরা। এদিকে ৩ দিন ধরে বিদ্যুৎহীন শাহপরীর দ্বীপ ও সেন্টমার্টিন। যেটি স্বাভাবিক হতে আরও দু’একদিন সময় লাগবে বলে জানিয়েছে স্থানীয় বিদ্যুৎ অফিস।
সেন্টমার্টিনের মতো এখানেও দেখা দিয়েছে তীব্র খাদ্য ও সুপেয় পানির সংকট। অন্যদিকে দ্বীপের জেলে পল্লীগুলোতে ভয়াবহ তাণ্ডব চালিয়েছে মোখা। প্রায় ৯৫ শতাংশ ঘরবাড়ি ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দ্বীপটির ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আবদুস সালাম বলেন, ঘূর্ণিঝড়ে এই ওয়ার্ডের জেলে পল্লীগুলো একেবারে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। জালিয়াপাড়া, ক্যাম্পপাড়া, বেড়িবাঁধের পূর্ব-পশ্চিম পাশে বেড়ার তৈরি ৪০০টি ও টিনশেডের ২০০টি ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দোকানপাট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৫০টির মতো। অনেক দোকানের মালামাল নষ্ট হয়েছে। তবে ঘূর্ণিঝড়ের পর সবচেয়ে বেশি সংকট দেখা দিয়েছে খাবার পানির। পুরো জেলে পল্লীতে বিদ্যুৎ না থাকায় এই সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। স্থানীয়রা জানান, এই এলাকায় পানি লবণাক্ত হওয়ায় আগে থেকেই সংকট চলছিল। এখানে ডিপ-টিউবওয়েলের সংখ্যাও কম। তারপরও পাইপ দিয়ে দুই-তিন কিলোমিটার দূর থেকে পানি আনতো জালিয়াপাড়ার মানুষ। যা এখন আরও তীব্র হয়েছে। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান নূর হোসেন জানান, আগে থেকেই জালিয়াপাড়া বেড়িবাঁধ এলাকায় পানির সংকট ছিল। ঘূর্ণিঝড়ে শাহপরীর দ্বীপ এলাকায় ১৪টি খুঁটি ভেঙে যাওয়ার তথ্য দিয়ে টেকনাফ পল্লী বিদ্যুতের ডিজিএম আবুল বশর আজাদ বলেন, বিদ্যুৎ অফিসের কয়েকটি টিম সোমবার থেকে কাজ করছে। আশা করছি, দুই-একদিনের মধ্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হবে। এদিকে সেন্টমার্টিনে খাদ্য ও পানির সংকটের বিষয় অস্বীকার করেছেন স্থানীয় চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান। তিনি বলেন, দ্বীপের অবস্থা স্বাভাবিক। কোনো খাদ্য সংকট নেই। গত ২ দিন ট্রলার চলাচল না করায় ভোগান্তি হয়েছিল। এখন সব স্বাভাবিক।

খোলা আকাশের নিচে অনেক পরিবার
টেকনাফ (কক্সবাজার) প্রতিনিধি জানান, ঘূর্ণিঝড় মোখায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেন্টমার্টিন, সাবরাং ও বাহারছড়া। এর মধ্যে সেন্টমার্টিন ও সাবরাং ইউনিয়নের শাহপরীর দ্বীপের বেশির ভাগ ঘরবাড়ি ভেঙে গেছে। সেন্টমার্টিন দ্বীপে ১০ হাজার ও শাহপরীর দ্বীপে বসবাস করেন প্রায় ৪০-৫০ হাজার মানুষ। এই শাহপরীর দ্বীপের জালিয়া পাড়া, ঘোলার পাড়া ও ক্যাম্প পাড়ায় পানি সংকট দেখা দিয়েছে।
অপরদিকে, সেন্টমার্টিন দ্বীপের সাগর কিনারার গ্রামগুলোতেও দেখা দিয়েছে সুপেয় পানির সংকট। বিশেষ করে গত ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের আঘাত ও জলোচ্ছ্বাস হওয়ায় লবণাক্ত পানিতে দ্বীপ প্লাবিত হলে সুপেয় মিঠা পানির গভীর নলকূপগুলো লবণ পানি হয়ে যায়। সেন্টমার্টিন থেকে নুর মোহাম্মদ জানান, দ্বীপের দক্ষিণাংশের ও পশ্চিম পাশের মানুষ সুপেয় পানি নিয়ে খুবই কষ্টে আছে। এখন মোখা’র আঘাত হানায় বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় আরও সংকটে পড়ে।

শাহপরীর দ্বীপের জালিয়া পাড়ার নুর কালাম জানান, মোখা’র আঘাতের আগে থেকেই পানি সংকট ছিল। অন্যান্য এলাকা থেকে পাইপের মাধ্যমে সুপেয় পানি আনা হতো। কিন্তু মোখা আঘাত হানায় বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে পানির তীব্র সংকট দেখা দেয়। এখন দেড়-দুই কিলোমিটার দূর থেকে পানি বহন করে আনতে হচ্ছে।

সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদের ৯নং ওয়ার্ডের (শাহপরীর দ্বীপ) মেম্বার আবদুস সালাম পানি সংকটের বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, পূর্ব থেকে সুপেয় পানির অভাব ছিল। জালিয়া পাড়া, ক্যাম্প পাড়া ও ঘোলার পাড়া নাফ নদ ঘেঁষা হওয়ায় টিউবওয়েলের পানি লবণাক্ত হয়ে যায়। ফলে দূর-দূরান্ত থেকে পানি সংগ্রহ করে আনতে হয়।
টেকনাফ উপজেলার চেয়ারম্যান নুরুল আলম বলেন, টেকনাফজুড়েই পানির সংকট। ঘূর্ণিঝড় হওয়ায় এই সংকট আরও বেড়েছে। বিদ্যুৎ সংযোগ পেলে পানি সংকট লাঘব হবে।

এদিকে মোখা’র আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত অনেক পরিবারকে খোলা আকাশের নিচে বসবাস করতে দেখা গেছে।
এদিকে ঘূর্ণিঝড় মোখায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেছেন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)’র মহাপরিচালক মেজর জেনারেল একেএম নাজমুল হাসান। ক্ষতিগ্রস্ত সেন্টমার্টিন দ্বীপের ৮০০ জন অসহায় মানুষের মাঝে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করেন তিনি।