যদি হাত ও পায়ে ‘ঝিঁঝি’ অনুভূত হয়

হাতে বা পায়ে ‘ঝিঁঝি ধরা’ খুবই কমন বিষয়। সব মানুষেরই এমনটি হওয়ার অভিজ্ঞতা আছে। সাধারণত হাত বা পায়ের ওপর লম্বা সময় ধরে চাপ পড়লে সাময়িক যে অবশতা অনুভূতি তৈরি হয় সেটিকেই আমরা ‘ঝিঁঝি ধরা’ বলে থাকি। এই উপসর্গটিকে মেডিকেল পরিভাষায় ‘টেম্পোরারি প্যারেসথেসিয়া’ও বলা হয়ে থাকে। ইংরেজিতে এটিকে ‘পিনস অ্যান্ড নিডলস’ও বলা হয়। শরীরের যে অংশে ঝিঁঝি ধরে, সেখানে সাময়িক অসাড় এবং পাশাপাশি এমন একটি অনুভূতির তৈরি হয় যেন অসংখ্য সুঁই দিয়ে একসঙ্গে ঐ অংশে খোঁচা দেয়া হচ্ছে। তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই অসাড়তা এবং খোঁচা লাগার মতো অস্বস্তিকর অনুভূতি চলে যায়।

যেভাবে ঝিঁঝি ধরে বা অনুভূত হয়ঃ

মানুষের হাত বা পায়ে ঝিঁঝি ধরার বিষয়টি সবচেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হয় দীর্ঘক্ষণ বসা বা শোয়ার কারণে। আবার বিভিন্ন কারণে দীর্ঘসময় ঝিঁঝি ধরার মতো ঘটনাও ঘটে থাকে। বিশেষ করে উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের বা ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে দীর্ঘসময় কোনো একটি অঙ্গে অসাড়তা অনুভব করার ঘটনা ঘটতে পারে। মেরুদণ্ডের আঘাতজনিত সমস্যা থেকে ‘সার্ভাইক্যাল স্পন্ডাইলোসিস’ বা ‘লাম্বার স্পন্ডাইলোসিস’-এর ক্ষেত্রে হাতে-পায়ে ঝিঁঝি ধরার আশঙ্কা থাকে।

এ ছাড়া হাতে বা পায়ে রক্ত সঞ্চালন কমে গেলে ‘পেরিফেরাল আর্টারাল ডিজিজ’ হিসেবে ঝিঁঝি ধরতে পারে। এরকম ক্ষেত্রে শরীরের ঐ অংশে রক্ত প্রবাহ কমে যাওয়ায় মাংসপেশী দুর্বল হয়ে যাওয়ার কারণে ঝিঁঝি ধরে থাকে। ডায়াবেটিসের কারণে ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি নামক একটি রোগ হয়, যার কারণে হাত-পায়ে ঝিঁঝি ধরে। সাধারণত মানুষের হাত বা পায়ে ঝিঁঝি ধরার বিষয়টি সবচেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হয়। ঝিঁঝি ধরার অনুভূতিটা কিছুটা রহস্যজনক মনে হলেও এর পেছনের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা কিন্তু খুবই সহজ। আমাদের দেহের সবখানেই অসংখ্য স্নায়ু রয়েছে যেগুলো মস্তিষ্ক ও দেহের অন্যান্য অংশের মধ্যে তথ্য আদান-প্রদান করতে থাকে।
বসা বা শোয়ার সময় সেসব স্নায়ুর কোনো একটিতে চাপ পড়লে দেহের ঐ অংশে রক্ত চলাচলকারী শিরার ওপরও চাপ পড়ে। ফলে শরীরের ঐ অংশে রক্ত চলাচল ব্যাহত হয়। এর ফলে ঝিঁঝি ধরতে পারে। ‘ঝিঁঝি ধরা’ অনুভূতিটিকে তিন ধাপে বিভক্ত করা যায়। প্রথমত, চাপ প্রয়োগ হওয়ার মিনিটখানেক পর তিন থেকে চার মিনিটের জন্য স্থায়ী হওয়া অস্বস্তিকর অনুভূতি, যেটিকে ‘কমপ্রেশন টিঙ্গলিং’ বলা হয়। এই অনুভূতিকে অনেকে এমনভাবে বর্ণনা করেছেন যেন, তাদের ‘চামড়ার ভেতরের অংশে পিপড়া দৌড়াদৌড়ি করে।’ দ্বিতীয় ধাপটি সাধারণত শুরু হয় দশ মিনিট পর। এই ধাপে হাতে বা পায়ে অসাড়তা বোধ হয় এবং যতক্ষণ স্নায়ুর ওপর চাপ থাকে ততক্ষণ এই অনুভূতি থাকে। তৃতীয় ও শেষ ধাপটি শুরু হয় চাপ অপসারণ করার পর। সাধারণত প্রথম দুই ধাপের তুলনায় এই ধাপটি অপেক্ষাকৃত বেশি যন্ত্রণাদায়ক, তবে সাধারণত এই ধাপে যন্ত্রণা বা ব্যথার চেয়ে ভিন্ন ধরনের উত্তেজনা বোধ করে। তবে কিছুটা ব্যথা বা যন্ত্রণার অনুভূতি থাকলেও তার পুরোটাই শারীরিক। এই অনুভূতি কিছুক্ষণের মধ্যেই স্তিমিত হয়ে গেলেও ঠিক কোন জায়গায় এই অনুভূতির সূচনা হয়েছিল বা কোথায় শেষ হয়, সেটি নির্দিষ্টভাবে বলতে পারে না মানুষ। ঝিঁঝি ধরলে সাময়িকভাবে অসাড় হয়ে যাওয়া অঙ্গটি টানটান করে রাখলে সাধারণত কিছুক্ষণের মধ্যে দ্রুত ঐ অঙ্গ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যায়। আবার অস্থায়ী চেতনানাশক ব্যবহারের পর ঝিঁঝি ধরার মতো অনুভূতি তৈরি হয়।

কারণগুলো

যেসব ক্ষেত্রে ঝিঁঝি হতে পারে, তা হলো- ১. কেমোথেরাপির মতো চিকিৎসার ক্ষেত্রে। ২. এইচআইভি’র ওষুধ, খিঁচুনির ওষুধ বা বিভিন্ন ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ফলে। ৩. সিসা বা রেডিয়েশনের মতো বিষাক্ত বস্তুর সংস্পর্শে এলে। ৪. পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবারের অভাব হলে। ৫. স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হলে- বিশেষ করে কোনো অসুস্থতা বা আঘাতের পর। ৬. অতিরিক্ত মদ্যপানের ফলে। ৭. বিশেষক্ষেত্রে চেতনানাশক ব্যবহারের পর।

কখন চিকিৎসকের পরামর্শ প্রয়োজন

দীর্ঘসময় বা প্রায়ই ঝিঁঝি ধরার মতো উপসর্গ থাকলে বা অস্বস্তি লাগলে। কোনো অঙ্গে নিয়মিত ঝিঁঝি ধরার ঘটনা ঘটলে বা বারবার ঝিঁঝি ধরার ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলে এবং যে কারণে হয় তা অনুধাবন করে নিজে নিজেও সতর্ক হলে।

লেখক: জনস্বাস্থ্য বিষয়ক লেখক ও গবেষক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক খাজা বদরুদজোদা মডার্ন হাসপাতাল, সফিপুর, কালিয়াকৈর, গাজীপুর।