মাহে জমাদিউস সানির ফজিলত ও আমল

আরবি বর্ষপঞ্জির হিজরি সনের ষষ্ঠ মাস হলো জমাদিউস সানি। এর জোড়া মাস হলো জমাদিউল আউয়াল। এটি হিজরি সনের পঞ্চম মাস। এর বাংলা অর্থ হলো প্রথম জুমাদা ও দ্বিতীয় জুমাদা বা প্রথম শীত ও দ্বিতীয় শীত; অর্থাৎ শীতকালের প্রথম মাস ও শীতকালের দ্বিতীয় মাস। আরবে তৎকালে এই দুই মাস ছিল শীতকাল। আরবিতে মাস দুটির নাম হলো আল জুমাদাল উলা ও আল জুমাদাল উখরা বা আল জুমাদাল আখিরাহ অথবা আল জুমাদাস সানিয়াহ। সহজ করে বললে প্রথমটি জুমাদাল উলা; দ্বিতীয়টি জুমাদাল উখরা বা জুমাদাল আখিরা অথবা জুমাদাস সানিয়াহ। আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে মাস দুটি জমাদিউল আউয়াল ও জমাদিউস সানি নামে সমধিক পরিচিত।
জমাদিউস সানি শব্দের অর্থ দ্বিতীয় শুকনো ভূমিখন্ড। এটা আরবের গ্রীষ্মকালের শুরু বলা যেতে পারে এবং শীতের শেষ। আর শীতের সময় পানি যেমন একদম জমে যায় অপর দিকে গ্রীষ্মে যেমন পানি শুকিয়ে যায় আর তাই এই মাসকে জমাদিউস সানি বলা হয়।
জুমাদা শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো স্থির, অবিচল, দৃঢ়, কঠিন ; জমাটবদ্ধ, নিস্তব্ধ, নীরব, নিথর, পাথর ; শুষ্ক, নিরাপদ, নির্ভরযোগ্য, বিশ্বস্ত ; শীতল, শীতকাল, শীতবস্ত্র ; কার্পণ্য, বদ্ধমুষ্টি ; কিংকর্তব্যবিমূঢ়, অস্থির সময়, চিন্তাযুক্ত অবস্থা। যেহেতু শীতকালে তীব্র শীতে তরল পানি জমে কঠিন বরফে পরিণত হয়ে যায়; জড় পদার্থগুলো জমে শক্ত হয়ে যায় ; উদ্ভিদ ও জীব নিথর হয়ে যায় ; প্রাণীরা নীরব হয়ে যায় ; তাই এই মাসকে এই নামে নামকরণ করা হয়েছে। ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-বলেন জুমাদা হলো শীতকাল। এটি বসন্তের নিকটবর্তী গ্রীষ্মের পূর্ববর্তী। দুই ভূমির সীমানা বা দুই বাড়ির সীমানাকে এবং নিকট প্রতিবেশীকেও জুমাদা বলা হয়। একত্রে এই দুই মাসকে জুমাদায়ান বা জুমাদায়িন বলা হয় এতদুভয় হলো জুমাদা-এর দ্বিবচন ; অর্থ হলো জুমাদাদ্বয়।
অন্যান্য মাসের মতো এই মাসেও অধিক পরিমাণে নেক আমল করা বাঞ্ছনীয়। এ মাসে নফল নামাজ ও নফল রোজা আদায় করা, দান-খয়রাত করার ফজিলত অনেক। পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামাজের পাশাপাশি পাঁচ ওয়াক্ত নফল নামাজ তথা তাহাজ্জুদ, ইশরাক, চাশত, জাওয়াল ও আউওয়াবিন নামাজ আদায় করা ভালো। এ ছাড়া কাজা রোজা থাকলে তা পুরা করা ; মান্নত রোজা থাকলে তা আদায় করা ; মাসের ১, ১০, ২৯ ও ৩০ তারিখে রোজা রাখা এবং চাঁদের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ আইয়ামে বিদ-এর সুন্নাত রোজা রাখা গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত জমাদিউস সানি তথা দ্বিতীয় জুমাদা মাসে রজব মাসের প্রস্তুতি হিসেবে আরও বেশি নেক আমল এবং অধিক পরিমাণে নফল নামাজ ও নফল রোজা করা উচিত। মূল কথা হলো হার কে কদরে শব দারাদ ; হামা শব শবে কদর আস্ত অর্থাৎ যিনি রাতের মূল্য দেন প্রতি রাতকেই তিনি শবে কদর হিসেবে পান। মানে হলো নেক আমল ও সৎকর্মে সাধারণ সময়ও অসাধারণ হয়ে ওঠে।
জিকির-আসকার, দোয়া কালাম, দরুদ ও সালাম, তাসবিহ তাহলিল, তাওবা ইস্তিগফার, খতম তিলাওয়াত, সদকা খয়রাত ইত্যাদি আমলের মাধ্যমে মাস অতিবাহিত করলে নিশ্চিত এর বরকত ফজিলত লাভ করা যায়। অন্যথায় সময়ের অপচয়ের জন্য অনুতাপ ও অনুশোচনা করতে হবে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন পরকালে নেককার মুমিন জান্নাতিগণের কোনো আফসোস থাকবে না ; বরং তাদের আফসোস থাকবে শুধু ওই সময়ের জন্য যে সময়টুকু তারা নেক আমল ছাড়া অতিবাহিত করেছে বা বেহুদা কাটিয়েছে।
এ মাসের নফল ইবাদত প্রথম তারিখের ১ম রাতে ৪ রাকাত নফল নামায যদি এভাবে পড়া হয়-প্রত্যেক রাকাতে সূরা ফাতিহার পর ১৩ বার সূরা ইখলাস পড়বে এ নামায সম্পন্নকারীর আমলনামায় ১ লক্ষ নেকী লিপিবদ্ধ হয় ও ১লক্ষ গুনাহ্ মুছে ফেলা হয়। ১ম তারিখের ১ম সন্ধ্যায় বাদ মাগরীব ১২ রাকআত নামায হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু আদায় করতেন বলে বর্ণিত আছে। প্রতি রাকাতে সূরা ফাতিহার সাথে সূরা ইখলাস এগার বার এবং তিন বার আয়াতুল কুরসী দ্বারা এ নামায আদায় করতেন।
১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে দুই রাকাত বিশিষ্ট ১২ রাকাত নামায আদায় করতে পারেন। প্রতি রাকাতে সূরা ফাতিহার সাথে পনের বার সূরা ইখলাস পাঠ করবেন। এ নামায আদায়কারীর সগীরা গুনাহ সমূহ মার্জনা করা হবে এবং আর্থিক স্বচ্ছলতা নসীব হবে।
এ মাসের ২০ তারিখের পর হতে অবশিষ্ট দিনগুলি নফল রোজা রেখে প্রতি রাতে ২০ রাকাত করে নামায আদায় করা সাহাবায়ে কেরামের আমলের অন্তর্ভুক্ত। তাঁরা মাহে রজবকে স্বাগত জানানোর নিয়্যতে এ আমল করতেন। নামাযের পর নিম্নের দোয়াটি ১০০ বার পাঠ করলে পারিবারিক ও দাম্পত্য জীবনের সকল প্রকার অশান্তি হতে মুক্ত থাকবে। এ ছাড়া দোয়াটি প্রত্যহ ফজর ও মাগরীব নামাযের পর ১০০ বার পাঠ করলে দাম্পত্য ও পারিবারিক জীবনের সকল প্রকার অশান্তি হতে মুক্ত থাকবে “হুয়াল হাইয়ুল কাইয়ূমু ওয়া হুয়াল গনিইয়ুল মাতীন”।
সাধারণ সময় ও বান্দার ইখলাস ও তাকওয়াপূর্ণ সুন্নাতভিত্তিক নেক আমল ও ত্যাগ-তিতিক্ষা এবং শুভ উদ্যোগ ও সফল সার্থক অবদানের কারণে পুণ্যময় হয়ে ওঠে। হজরত আয়িশা (রা.)-বর্ণনা করেছেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিনটি আমল কখনো পরিত্যাগ করেননি। সেগুলো হলো ১. তাহাজ্জুদের নামাজ ২. প্রতি মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ আইয়ামে বিদ-এর রোজা পালন ও ৩. রমজানের শেষ দশক ইতিকাফ।
শীত ও গরমের মৌসুমে বিশেষ ইবাদতের প্রসঙ্গে কোরআন কারিমে আল্লাহ তাআলা বলেন যেহেতু কুরাইশদের আসক্তি আছে তাদের আসক্তি শীত ও গ্রীষ্মে ভ্রমণের। অতএব তারা এই (কাবা) গৃহের প্রভুর ইবাদত করুক। যিনি তাদের ক্ষুধায় অন্ন দিয়েছেন এবং শঙ্কায় নিরাপত্তা দান করেছেন। (সুরা-১০৬ কুরাইশ, আয়াত : ১-৪)।
নবীজি (সা.)-প্রায়ই প্রতি সোমবার ও বৃহস্পতিবার রোজা পালন করতেন। কারণ এই দুই দিন বান্দার আমল আল্লাহর দরবারে পৌঁছানো হয়। বিশেষত সোমবারে জন্মগ্রহণ ও ওহি প্রাপ্তির শুকরিয়াস্বরূপ তিনি এই আমল করতেন। আমল দ্বারা সময়কে ঋদ্ধ করা ও জীবনকে সমৃদ্ধ করা জ্ঞানীর কাজ। রাসুলে আকরাম (সা.)-বলেছেন তোমরা পাঁচটি জিনিসকে পাঁচটি জিনিসের পূর্বে মূল্যায়ন করো–যৌবনকে বার্ধক্যের পূর্বে, সুস্থতাকে অসুস্থতার পূর্বে, সচ্ছলতাকে দারিদ্র্যের পূর্বে, অবসরকে ব্যস্ততার পূর্বে, জীবনকে মৃত্যুর পূর্বে।
প্রিয়নবী (সা.)-এ দুদিন রোজা রাখার গুরুত্ব বর্ণনা করে ঘোষণা করেছেন। আবু হুরায়রা (রা.)-করেন রাসুলুল্লাহ (সা.)-বলেন প্রতি সোমবার ও বৃহস্পতিবার (আল্লাহ তায়ালার দরবারে) আমল পেশ করা হয়। সুতরাং আমার আমলসমূহ যেন রোজা পালনরত অবস্থায় পেশ করা হয় ; এটাই আমার পছন্দনীয়। আয়িশা (রা.)-বর্ণনা করেন রাসুলুল্লাহ (সা.)-সোমবার ও বৃহস্পতিবারের রোজার প্রতি বেশি খেয়াল রাখতেন।
জমাদিউস সানি মাস ইবাদতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়। নফল রোজা, নফল নামাজ, কোরআন তিলাওয়াত, দরুদ শরিফ, জিকির-আজকার, তাসবিহ-তাহলিল, দোয়া-কালাম, দান-সদকাহ খয়রাত, ওমরাহ হজ ইত্যাদির মাধ্যমে এই মাসকে সার্থক ও সাফল্যময় করা যায়। সুতরাং মুমিন মুসলমানের উচিত এ মাসজুড়ে নিজেদের ইবাদত-বন্দেগিতে নিয়োজিত রাখা।
উল্লেখ্য,যেসব দিবসের ও যেসব মাসের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ও ফজিলত কোরআন ও হাদিসে বর্ণিত হয়েছে সেসব দিনে ও মাসে সবাই ইবাদত করবেন এবং করেও থাকেন-এটাই স্বাভাবিক। সুতরাং যেসব দিন ও মাসের বিশেষ ফজিলত ও বৈশিষ্ট্য কোরআন ও হাদিসে উল্লেখ করা হয়নি, সেসব দিন ও মাসে বেশি করে নেক আমল করলে আমলকারী অবশ্যই অন্যদের চেয়ে এগিয়ে যাবেন ও অগ্রগামী হবেন। ইনশা আল্লাহ।
পরিশেষে : আল্লাহতাআলার কাছে এই প্রার্থনা করি হে দয়াময় সৃষ্টিকর্তা ! তুমি আমাদেরকে শ্রেষ্ঠ-নবির উম্মত হবার কল্যাণে আমাদের দোষত্রুটি ক্ষমা করে তোমার রহমতের বারিধারায় আমাদেরকে সিক্ত করুন। আল্লাহপাক আমাদের এই ফজিলতময় ও বরকতপূর্ণ জমাদিউস সানি মাসে বেশি করে নেক আমল করার তাওফিকে রাফিক এনায়েত করুন ও সকলকে প্রিয়নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি বেশি বেশি দরুদ ও সালাম পাঠানোর তৌফিক দিন। সকলেই পড়ি আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা সাইয়েদিনা মুহাম্মদ ওয়ালা আলেহি ওয়া আসহাবিহি ওয়া সাল্লাম। আল্লাহ আমাদেরকে অধিক পরিমাণে ইবাদত-বন্দেগি ও জমাদিউস সানি মাসে তওবা-ইস্তেগফার করে অতীতের সব গুনাহ থেকে মুক্ত হয়ে আল্লাহর আনুগত্য ও রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সুমহান আদর্শ অনুসরণে নিজেদের জীবন-পরিচালনার দৃঢ় প্রত্যয় ও শপথ গ্রহণ করা উচিত। প্রতিটি মাসের শুরু এবং শেষ বিশেষ দোয়া-কালাম ও নামাজ, রোজা এবং বিশেষ নেক আমলের মাধ্যমে পালন করা নবীজি (সা.)-এর সুন্নাত। আমল দ্বারা সময়কে রঙিন করা ও জীবনকে সাজানো বুদ্ধিমানের কাজ। সকলকে কবুল করুক আমিন।


লেখক : ফখরুল ইসলাম নোমানী, ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট।