ভয়ঙ্কর সুন্দর, নান্দনিক

ম্যাচের পর রোনাল্ডো নাজারিও ডি লিমাকে নাচ শেখাচ্ছিলেন রিচার্লিসন। ঠিক একটু আগেই মাঠে দক্ষিণ কোরিয়াকে এক রকম নাচিয়ে ছাড়ে ব্রাজিল। গ্যালারিতে বসে তা উপভোগ করেন রোনাল্ডো। নেইমার-রিচার্লিসনদের দেখে কি অতীতের কথা মনে পড়ছিল তার? হয়তো পড়েছিল। ২০০২ আসরে জাগো বনিতোর সুরে মহাকাব্যের পঞ্চম খণ্ড রচনা করেছিলেন রোনাল্ডো-রোনালদিনহোরা। তারপর ব্রাজিলের চিরচেনা সেই ছন্দ কোথায় যেন হারিয়ে যায়। এবার অতীত ফিরিয়ে আনলেন নেইমাররা। সোমবার সাম্বার সুরে ভেঙে খানখান হয়ে যায় দক্ষিণ কোরিয়ার রক্ষণ দেয়াল। শেষ ষোলোর ম্যাচে দক্ষিণ কোরিয়াকে ৪-১ গোলে বিধ্বস্ত করে সেলেসাওরা। ২০০২ সালের পর বিশ্বকাপে ব্রাজিলের এমন ‘ভয়ঙ্কর সুন্দর’ পারফরম্যান্স বোধহয় এটাই প্রথম ।

মাঠে কোরিয়াকে নাচানের পর নেইমাররা নিজেরাও নেচেছেন।

তাদের নাচে যোগ দেন কোচ তিতে। এতে জুটেছে সমালোচনাও। তিতে-নেইমারদের ‘কবুতর নাচ’ সাবেক আইরিশ তারকা রয় কিনের পছন্দ হয়নি। কিনের কাছে এই নাচ প্রতিপক্ষের জন্য অসম্মানের। কিন্তু তিতেদের কাছে স্রেফ আনন্দ প্রকাশের একটা পন্থা। আর ফুটবলটা ব্রাজিল আনন্দ দেওয়া এবং আনন্দ পাওয়ার জন্যই খেলে। এবারের বিশ্বকাপের শেষ ষোলোতে সবচেয়ে সুন্দর আর বিধ্বংসী ফুটবল উপহার দিয়েছে ব্রাজিলই। পারফরম্যান্সের নিরিখে এমন উদ্‌যাপন করতেই পারে তারা। দক্ষিণ কোরিয়ার জালে ২৯ মিনিটের মধ্যে চারবার বল পাঠায় লাতিন আমেরিকান জায়ান্টরা। যেভাবে একের পর এক আক্রমণ চলছিল তাতে গোল হতে পারতো ৭-৮টি। দ্বিতীয়ার্ধে একটু রয়েসয়ে খেলেছে সেলেসাওরা। কোচ তিতে মাঠ থেকে কয়েকজনকে উঠিয়ে নেন। কোয়ার্টার ফাইনালের আগে খেলোয়াড়দের ফিট রাখতে বিশ্রামটা জরুরি। যাই হোক, ব্রাজিলের এই চার গোলেই শিরোপাপ্রত্যাশী বাকি দলগুলোর ঘুম হারাম হয়ে গেছে। চলছে হিসাব-নিকাশ। কোয়ার্টার ফাইনালে ব্রাজিলের প্রতিপক্ষ গতবারের রানার্সআপ ক্রোয়েশিয়া। দলটির কোচ জ্লাতকো দালিচ ব্রাজিলকে বলছেন ‘বিধ্বংসী’ দল। নিজেদের ফেভারিট বলার সাহস করছেন না দালিচ।
কোয়ার্টার ফাইনালে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা দু’দলই জিতলে সেমিতে মুখোমুখি হবে। আর্জেন্টাইন সাংবাদিকদের ভয়, এই ব্রাজিলকে কীভাবে সামলাবে আলবিসেলেস্তেরা? বিশ্বকাপে ২৬ জনের স্কোয়াডে যখন ১০ জন অ্যাটাকার নিয়েছিলেন তিতে, তখনই আঁচ করা গিয়েছিল কেমন হবে ব্রাজিলের খেলা। ক্যামেরুনের কাছে হার ছাড়া গ্রুপপর্বের বাকি দুটি ম্যাচ ব্রাজিল জিতে নেয় সহজেই। সার্বিয়া ও সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে আক্রমণে প্রতাপ ছিল নেইমার-রিচার্লিসনদের। সঙ্গে সিলভা-মার্কিনহোসদের জমাটরক্ষণ গলে ঢোকার সাধ্য ছিল না কারোরই। দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে ব্রাজিলের এমন দুরন্ত পারফরম্যান্সের পেছনে প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে নেইমারের প্রত্যাবর্তন। তাকে পেয়ে দলের মনোবল অনেকগুণ বেড়ে গেছে।

আক্রমণে এসেছে ভারসাম্য। তিতে নেইমারকে খেলিয়েছেন অ্যাটাকিং মিডে। ব্রাজিলের প্রতিটি আক্রমণের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন পিএসজি তারকা। নেইমার নিজেও চমৎকার খেলেছেন এই ম্যাচে। মনেই হয়নি সদ্য চোট কাটিয়ে ফিরেছেন মাঠে। একটি গোল করেছেন। একটি করিয়েছেন। তাছাড়া কিংবদন্তি পেলের জন্যও কিছু করে দেখাতে চেয়েছিল ব্রাজিল। সোমবার নেইমাররা মাঠে নামার আগে ইনস্টাগ্রাম থেকে একটি পোস্ট করেন পেলে। বলেন, ‘আমি হাসপাতাল থেকে তোমাদের দেখছি।’ পেলেকে হতাশ করেনি ব্রাজিল। ৪-১ গোলের জয়ের পর ভিনিসিউস জুনিয়র জানান, জয়টা তাদের ফুটবল ‘কিং’-এর জন্য। ম্যাচের আগের দিন পেলের অসুস্থতার খবরে ধাক্কা খায় সেলেসাও ভক্ত-সমর্থকরা। ম্যাচের সময় গ্যালারিতে পেলের ব্যানার নিয়ে যান তারা। আরলেম নামের একজন ব্রাজিলিয়ান সমর্থক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরাকে বলেছেন, ‘পেলে আমাদের রাজা। আমরা তাকে ভালোবাসি। তাকে আইডল মানি। আশা করছি, তিনি দীর্ঘদিন আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন এবং ব্রাজিলকে আরেকবার বিশ্বকাপ জিততে দেখবেন।’ নেইমার-ভিনিদের কাছে পেলেরও এই একটাই চাওয়া-‘ট্রফিটা ঘরে ফিরিয়ে আনো।’ শেষ ষোলোতে ব্রাজিল যেমন খেললো, সে ধারা বজায় থাকলে পেলের ইচ্ছাপূরণ করেই এবার দেশে ফিরবেন নেইমাররা।