‘বিএনপির সমাবেশকে ঘিরে গ্রেপ্তার-মামলা-হামলা অব্যাহত রয়েছে সরকার’

বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশকে ঘিরে দলের নেতাকর্মীদের খুন, গ্রেপ্তার, মামলা, হামলা ও নির্যাতন সরকার অব্যাহত রেখেছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেছেন, মানুষ তাদের মৌলিক অধিকার অন্ন, বস্ত্র, গণতান্ত্রিক অধিকার ভোটাধিকারের দাবিতে এবং এই সরকারের সকল অপকর্মের প্রতিবাদে সকল বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে সমাবেশগুলোতে হাজির হচ্ছেন।

বৃহস্পতিবার দুপুরে বিএনপির গুলশান কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ১২ অক্টোবর ২০২২ থেকে বিভাগীয় পর্যায়ে একই দাবিতে গণ-সমাবেশ কর্মসূচি পালন করে আসছি। এই ইতিমধ্যে ৬ বিভাগের সমাবেশ শেষ হয়েছে। সরকার কর্তৃক নির্দেশিত হয়ে পরিবহন মালিকরা আমাদের সমাবেশের দিনগুলোতে ধর্মঘট দিয়ে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করছে। এতে দেশের কি পরিমাণ অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে তা অর্থনীতিবিদ ও সুশীল সমাজের ব্যক্তিবর্গকে নির্ণয় করে জনসম্মুখে প্রকাশ করার আহবান জানাচ্ছি। আমরা সমাবেশ দিলেই জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হবে, মানুষের যাতায়াতের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হবে এই অজুহাত দেখায় প্রশাসন অথচ সরকার সারা দেশের অঘোষিত ধর্মঘট পালন করে সকল মানুষকে দুর্ভোগে সম্মুখিন করছে।

তিনি বলেন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কিছু কর্মকর্তা সরকারের প্রত্যক্ষ নির্দেশে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে বিরোধী মতের নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার নির্যাতন অব্যাহত রেখেছেন। কোথাও নিজেরাই গুলি করে বিরোধী মতের নেতা-কর্মীদের নামে মামলা দিচ্ছে, আবার কোথাও গ্রেফতার করে পুরাতন মামলায় জেলে পাঠাচ্ছে আবার কোথাও কোথাও নিজেরাই বোমা পেতে রেখে বিরোধী মতের নেতা-কর্মীদের নামে বিস্ফোরক আইনে মামলা দিচ্ছে। যা ইতিমধ্যে সরকারের দায়িত্বশীল মন্ত্রীদের বক্তব্যে উঠে এসেছে।

সারা দেশের আহত, নিহত ও গ্রেফতারের চিত্র তুলে ধরে মির্জা ফখরুল বলেন, ১২ই অক্টোবর চট্টগ্রামের গণ-সমাবেশে অংশগ্রহণ করতে নোয়াখালী, ফেনী, মিরেরসরাই, কক্সবাজার, খাগড়াছড়ি থেকে আসা প্রায় ২ শতাধিক নেতা-কর্মীদেরকে পুলিশ এবং আওয়ামী সন্ত্রাসীরা আহত করেছেন। ১৫ই অক্টোবর ময়মনসিংহের গণ-সমাবেশের আগের রাতে মরহুম নেতা মোশাররফ হোসেনের বাসভবনে বোমা হামলা চালায় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। পাগলা থেকে আসা নেতা জসিম উদ্দিনসহ ১০ জনকে আহত করে।

২২শে অক্টোবর খুলনার গণ-সমাবেশে অংশগ্রহণ করতে বিভিন্ন জেলা থেকে আসা নেতা-কর্মীদের আওয়ামী লীগ এবং সরকারি বাহিনী দ্বারা আহত এবং গ্রেফতার করেছে। খুলনা মহানগরে আহত প্রায় ৩শ’, জেলায় আহত প্রায় শতাধিক, গ্রেপ্তার ৫০এর অধিক। যশোর জেলায় আহত শতাধিক ও গ্রেফতার শতাধিক। চুয়াডাঙ্গা জেলায় আহত ১৪। কুষ্টিয়া জেলায় আহত ১৮ জন। বাগেরহাট জেলায় আহত দুই শতাধিক এবং গ্রেফতার শতাধিক। নড়াইল আহত ২৬ জন। ঝিনাইদহে আহত শতাধিক, মাগুরায় গ্রেফতার প্রায় ২০ জন নেতা-কর্মী। সাতক্ষীরা জেলায় আহত ১০ জন এবং গ্রেফতার ২০ জন। এছাড়া বাগেরহাট জেলা ছাত্রদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নূরে আলম ভূইয়া তনুকে গুলি করে হত্যা করেছে।
৫ই নভেম্বর বরিশাল বিভাগের গণ-সমাবেশে যাওয়ার পথে প্রকৌশলী ইশরাক হোসেনের গাড়ি বহরে হামলা, স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কাদের ভূইয়া জুয়েল এর গাড়ি বহরে হামলা, ভোলা থেকে আসা লঞ্চে হামলা, পটুয়াখালী পার্টি অফিস ও কলাপাড়া পার্টি অফিসে ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। গৌরনদী, আগৈলঝরায় বিএনপি নেতাদের মালিকানাধীন ২৮টি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানসহ অসংখ্য বিএনপি’র নেতা-কর্মীদের বাড়ি-ঘরে হামলা করে ২ শতাধিক নেতা-কর্মীদের আহত করা হয়েছে এবং ৫০ এর অধিক গ্রেফতার করা হয়েছে।

১২ই নভেম্বর ফরিদপুর বিভাগে গণ-সমাবেশ কে কেন্দ্র করে ২০ জন নেতা-কর্মীকে আহত এবং ১০ জনকে গ্রেফতার করেছে। ১৯ নভেম্বর সিলেট বিভাগের গণ-সমাবেশকে কেন্দ্র করে গ্রেফতার ও হামলা অব্যাহত রেখেছে। গতকাল বিকালে হবিগঞ্জ জেলা লাখাই উপজেলায় দলীয় কার্যালয়ে ওসি তদন্ত চম্পক, সাব-ইন্সপেক্টর দেবাশীষ ও রব্বানির নেতৃত্বে গুলি চালিয়ে ৩০ জন নেতা-কর্মীকে আহত করেছেন। ইতিমধ্যে সিলেট বিভাগে প্রায় ২০ জন নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করেছে। ৩ ডিসেম্বর রাজশাহী বিভাগে গণ-সমাবেশকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য মোহনপুর থানাধীন মৌগাছি ইউনিয়নে বসতদিয়া ডিগ্রি কলেজে বোমা পেতে রেখে পুলিশ উদ্ধারের নাটক করে বিএনপি’র নেতা-কর্মীদের উপর মামলা দায়ের করেছেন। সিরাজগঞ্জে রায়গঞ্জে প্রচারপত্র বিলির সময় আওয়ামী সন্ত্রাসীরা দলীয় কার্যালয়ে হামলা চালিয়ে ইকবাল হোসেন সহ ২০ জন নেতা-কর্মীকে আহত করেছেন। সিরাজগঞ্জ জেলার এসপি আরিফ মন্ডল বিভিন্ন থানার ওসিদেরকে সমাবেশের প্রচারণা যেন বিএনপি’র নেতা-কর্মীরা না চালাতে পারে তার নির্দেশ প্রদান করেছে।

তিনি আরো অভিযোগ করে বলেন, ঢাকার সমাবেশকে বানচাল করার লক্ষে মুন্সিগঞ্জের আমাদের নিরীহ নেতা-কর্মীদের উপর হামলা চালিয়ে শহিদুল ইসলাম শাওনকে হত্যা করে আবার বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে সাজানো মামলায় বিএনপি’র সমাজ সেবা বিষয়ক সম্পাদক, মুন্সিগঞ্জ জেলা বিএনপির সদস্য সচিব কামরুজ্জামান রতনকে মিথ্যা মামলায় জেলা হাজতে প্রেরণ করা হয়েছে। স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি রফিকুল ইসলাম হাওলাদার, যুবদলের সাবেক সহ-সভাপতি আলী আকবর চুন্নু সহ ঢাকার বিভিন্ন থানায় ইতিমধ্যে ৫০ জন নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে। গতকার নারায়ণগঞ্জে সোনারগাঁওয়ের আওয়ামী সন্ত্রাসীরা বিএনপি নেতা-কর্মীদের উপর হামলা চালিয়ে ৫০ জন নেতা-কর্মীকে আহত করেছেন।

অগ্নিসন্ত্রাস পুরোটাই আওয়ামী লীগের সৃষ্টি অভিযোগ করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, অবৈধ সরকারের মন্ত্রীরা দুটি কথা খুব জোর দিয়ে বলার চেষ্টা করছেন। একটি হলো, আর অগ্নিসন্ত্রাস হতে দেওয়া হবে না। ইতিহাস বলে, অগ্নিসন্ত্রাস পুরোটাই হচ্ছে আওয়ামী লীগের। তারা ২০০১-০৬ এর দিকে যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলন শুরু করে, তখন ১৭৩ দিন হরতাল দিয়েছে। সে সময় যত রকম জ্বালাও-পোড়াও আছে; ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ট্রেনে আগুন দিয়েছে, শেরাটনের সামনে একটি বাসে গান পাউডার দিয়ে ১১ জনকে হত্যা করেছে। একটা না, অসংখ্য ঘটনা এ রকম। একই ধারাবাহিকতা ‘১৩-১৪-১৫তে…একই ঘটনা ঘটেছে। তাদের উদ্দেশ্য অগ্নিসন্ত্রাসের কথা বলে ‘১৩-১৫ সালে মানুষকে, আন্তর্জাতিক মহলকে বিভ্রান্ত করেছিল, এখন আবারও যখন জনগণের আন্দোলন শুরু হয়েছে তখন তারা একই কাজ শুরু করেছে।

আরেকটি বিষয় হলো জঙ্গি। আমরা তো জঙ্গি দেখি না। এটাকে ইস্যু করার জন্য এর মধ্যে তারা বেশ কিছু গ্রেপ্তারও করেছে। চিকিৎসক আছেন বেশ কয়েকজন। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে তারা অভিযান শুরু করেছে। আমরা বা জনগণ জানে না সত্য ঘটনা কী। আমাদের মধ্যে যে সন্দেহের উদ্রেগ হয়, এটাকে ইস্যু করে তারা আবারও সাধারণ মানুষের ওপর নির্যাতন শুরু করবে। গণতন্ত্রের জন্য যারা আন্দোলন করছে তাদের ওপর আক্রমণ করবে কি না।

তিনি বলেন, বিএনপি আয়োজিত বিভাগীয় সমাবেশ বিশেষ করে ঢাকার গণসমাবেশকে কেন্দ্র করে অনির্বাচিত সরকারের মন্ত্রী ও নেতারা দায়িত্বহীন, উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে গণসমাবেশ নস্যাৎ করার হীন চক্রান্ত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে।

জাপান রাষ্ট্রদূতের বক্তব্য নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে বিএনপি মহাসচিব বলেন, জাপানের রাষ্ট্রদূত চরম সত্যি কথা বলেছেন। ভিয়েনা কনভেনশন এখন দেখেন, যখন আপনারা মানুষ হত্যা করেন, গুম করে দেন, দিনের ভোট রাতে করেন, ভোট না করে নিজেদের নির্বাচিত ঘোষণা করেন দেন—তখন কোথায় থাকে! আমাদের ইন্টারন্যাশনাল কমিউনিটির চোখ খুলেছে। তারা এখন দেখতে পাচ্ছে বাংলাদেশে কী চলছে। বাংলাদেশ তো বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নয়! গোটা বিশ্বের অংশ। এখন আর সেই দিন নেই যা খুশি করে যেতে পারবে, কেউ কিছু বলবে না। অংশীজনরা তো তাদের কথা বলবেই।
আন্তর্জাতিক মহল যদি আমাদের কথা শোনে তাহলে বুঝতে হবে আমরা জনগণকে সঙ্গে নিয়ে অনেকদূর এগিয়ে গেছি।