সুস্থ বিনোদনের পথ প্রদর্শক ইত্যাদি

কয়েক দশক ধরেই সুস্থ বিনোদনের পথ প্রদর্শক হিসেবে উচ্চারিত হয়ে আসছে হানিফ সংকেতের গ্রন্থনা, পরিচালনা ও উপস্থাপনায় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’র নাম। সব শ্রেণির দর্শক অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় থাকেন অনুষ্ঠানটির নতুন পর্ব প্রচারের। দেশকে জানতে এবং জানাতে প্রতিনিয়ত ইত্যাদিও যাচ্ছে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। এবারো তার ব্যতিক্রম হয়নি। এবারের পর্ব ধারণ করা হয় ঝালকাঠিতে। ইতিহাস, ঐতিহ্যের সঙ্গে বিনোদনের অপূর্ব মিশেল ছিল ঝালকাঠিতে ধারণকৃত এই ‘ইত্যাদি’তে। মঞ্চ নির্মাণ করা হয়েছে ধানসিঁড়ি, সুগন্ধা, বিষখালী, বাসণ্ডা, গাবখান-এই পাঁচ নদীর মোহনায়। আসলে ইত্যাদির স্থান নির্বাচনেও থাকে বেশ মুন্সিয়ানা। ঝালকাঠির এই পর্ব গত শুক্রবার রাতে প্রচার হয় বাংলাদেশ টেলিভিশনে। প্রচারের পর থেকেই ব্যাপকভাবে প্রশংসা কুড়ায় এ পর্ব।

শুরুতেই হানিফ সংকেত ঝালকাঠি জেলার অতীত, ঐতিহ্য ও সেখানকার বিখ্যাত মানুষদের পরিচয় তুলে ধরেন, যা ছিল বেশ তথ্যসমৃদ্ধ। অন্যদিকে প্রচারিত গানের ক্ষেত্রে বিষয় বৈচিত্র্যগুলো আবেগকে নাড়া দিয়ে গেছে। জন্ম এবং মৃত্যু একসূত্রে গাঁথা এক অভিন্ন চেতনার নাম। এমন বিষয়ের উপরে জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী রবি চৌধুরী ও শফি মণ্ডলের গান হৃদয় ছুঁয়ে গেছে। গানটির কথা লিখেছেন কবির বকুল, সুর করেছেন হানিফ সংকেত এবং সংগীতায়োজনে মেহেদি। ঝালকাঠির নদী ও গৌরবগাথা নিয়ে একটি পরিচিতিমূলক গানের সঙ্গে স্থানীয় প্রায় শতাধিক নৃত্যশিল্পীর নাচ ছিল মনোমুগ্ধকর। এই গানটিরও সুর করেছেন হানিফ সংকেত। লিখেছেন মনিরুজ্জামান পলাশ, সংগীতায়োজন করেছেন মেহেদী। শেকড় সন্ধানী ইত্যাদিতে সবসময়ই দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে প্রচার বিমুখ, জনকল্যাণে নিয়োজিত মানুষদের খুঁজে এনে তুলে ধরা হয়। এবারের পর্বেও ছিল কয়েকটি হৃদয় ছোঁয়া প্রতিবেদন। ছিল ঝালকাঠির ইতিহাস, ঐতিহ্য, কৃষ্টি-সংস্কৃতি, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত দর্শনীয় স্থান, নদী-খাল-চ্যানেল, বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী পণ্য এবং কীর্তিমান ব্যক্তিদের ওপর কয়েকটি তথ্যভিত্তিক প্রতিবেদন। এ পর্বে আঘাতজনিত কিংবা বিকলাঙ্গ রোগীদের ব্যতিক্রমধর্মী ইলিজারভ চিকিৎসা পদ্ধতির উপর ছিল একটি তথ্যসমৃদ্ধ প্রতিবেদন। এ প্রতিবেদনটি নিশ্চয়ই নতুন পথ দেখাবে বিকলাঙ্গ রোগীদের জন্য, কারণ হানিফ সংকেত তার স্বভাবসূলভ ভঙ্গিতে বিশদভাবে এখানে এই চিকিৎসা পদ্ধতি তুলে ধরেছেন। বিষয়ের সঙ্গে কম্পিউটার গ্রাফিকস্‌ এর সংযোজন বিষয়টিকে আরও সহজ বোধ্য করে তুলেছে। এ ছাড়া অজানা-অচেনা-দূর-দূরান্তের পথিকদের জন্য নীলফামারীর একজন মহান ব্যক্তির নির্মিত একটি মুসাফিরখানার উপর ছিল দৃষ্টান্তমূলক প্রতিবেদন। ঝালকাঠির পেয়ারা বাগান ও শীতল পাটির ওপর ছিল অসাধারণ প্রতিবেদন, যা নাড়া দিয়ে গেছে বেশ। কষ্ট লেগেছে পাটিকরদের দুর্দশা দেখে। আশা করি ইত্যাদির এই চিত্র দেখে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এগিয়ে আসবেন। ছিল নোয়াখালী জেলার সুবর্ণচরের এক সময়ের রিকশাচালক সৈয়দ আহমেদের উপর একটি ব্যতিক্রমধর্মী প্রতিবেদন। হানিফ সংকেত যথার্থই বলেছেন, ‘দান হয় মনে-ধনে নয়’। এই ভ্যানচালকের কাছ থেকে আমাদের ধনাঢ্য ব্যক্তিদের অনেক কিছু শেখার আছে। এবারের পর্বে ছিল আমেরিকার মিনেসোটা রাজ্যের উপর একটি তথ্যসমৃদ্ধ প্রতিবেদন। দর্শক পর্বের নিয়ম অনুযায়ী ধারণ স্থান ঝালকাঠিকে নিয়ে করা প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে উপস্থিত দর্শকের মাঝখান থেকে ৪ জন দর্শক নির্বাচন করা হয়। ঝালকাঠির ঐতিহ্যবাহী যাত্রার মাধ্যমে দর্শকদের দিয়ে পরিবেশন করা হয় গুণাই বিবির বর্তমান সংস্করণ। এই পর্বে চমৎকার একটি বার্তা দেয়া হয়েছে, ‘সংস্কৃতি খাবার জিনিস নয়, আমাদের আত্মপরিচয়, আমাদের অহংকার’। ঝালকাঠির মঞ্চে এবার নাতি এবং ভাগ্নেকে দেখা গেলেও দেখা যায়নি নানী এবং মামাকে। সাথী হারা নাতি এবং মামা ছাড়া ভাগ্নের নাট্যাংশ ছিল বিনোদনে ভরপুর, আবার মেসেজ নির্ভর। নিয়মিত পর্বগুলোতেও হানিফ সংকেত তুলে ধরেছেন সমসাময়িক ঘটনা নিয়ে বিভিন্ন নাট্যাংশ। বরাবরের মতোই যা মানুষকে সচেতন হতে ভূমিকা রাখবে। সিনেমা-নাটক আর ওয়েব সিরিজে গালি ব্যবহার নিয়ে মানুষের মনের কথা তুলে ধরেছে এবারের ইত্যাদি। কিন্তু এসব ব্যাপারে শুধু ইত্যাদিই নয়, সবারই এগিয়ে আসা উচিত। কর্তৃপক্ষেরও কঠোর ব্যবস্থা নেয়া উচিত। সবকিছু মিলিয়ে বলা যায়, বরাবরের মতো এবারো ইত্যাদি জয় করেছে দর্শক হৃদয়।