দর্জির দোকানে কাজ করেন নুরুল বশর। অল্প বেতনে কোনমতে চলছিল জীবন।
বিনামেঘে বজ্রপাতের মতোই খবর পেলেন, মাদকের মামলায় ১০ বছর কারাদণ্ডের আদেশ হয়েছে তার বিরুদ্ধে।
আসামির নাম-ঠিকানা সবই বশরের সঙ্গে হুবহু মিল। অনেকটা ভয় নিয়ে আদালতে এসে আইনজীবীর মাধ্যমে জানতে পারেন, এ মামলায় তিনি কারাভোগও করেছেন! তাহলে প্রকৃত আসামি কে?
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মূলত রোহিঙ্গা নাগরিক জোহর আলম দুই হাজার পিস ইয়াবাসহ গ্রেফতার হলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কাছে পরিচয় গোপন করতে নিজের নাম-ঠিকানা হিসেবে নুরুল বশরের ঠিকানা দেওয়া হয়। আটক হওয়ার আগে বশরের পাড়ায় দিনমজুরের কাজ করার সুবাদে নুরুল বশরের সঙ্গে পরিচয়, তারই সূত্রে নুরুল বশরের নাম-ঠিকানা জানতো মাদকের কারবারি জোহর আলম (২৭)। সে মিয়ানমারের বুচিডং স্ট্যাট চিংডং এলাকার সৈয়দ হোসেনের ছেলে। বর্তমানে কক্সবাজারের টেকনাফ থানার হোয়াইক্যং ইউনিয়ন ২ নম্বর ওয়ার্ড বালুখালি সৈয়দের বাড়ির বাসিন্দা।
নুরুল বশর বলেন, দীর্ঘ ১৮ বছর যাবত হোয়াইক্যং বাজারে ‘ইত্যাদি’ নামে এক দর্জির দোকানে কাজ করেছি। আমার বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ ও মামলা নেই। আমি কোনদিন কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম কারাগারে যাইনি। বাড়ির পাশে দর্জির কাজ করে আমার পরিবার চলে।
তিনি আরও বলেন, আমাদের এলাকার আব্দুল আলিম গ্রেফতার হয়ে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে যায়। সেখানে মিয়ানমারের নাগরিক জোহর আলম আমার নাম ব্যবহার করে কারাগারে যাবতীয় কাজ করে। পরে কারাগার থেকে বের হয়ে আব্দুল আলিম সম্প্রতি বিষয়টি আমাকে জানায়। আমি প্রথমে বিশ্বাস করিনি। জোহর আলম কারাগার থেকে জামিন পেয়ে বের হলে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে বিষয়টি তিনি স্বীকার করেন। থানায় খবর নিয়ে জেনেছি, আমার নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা রয়েছে। আমি নিরপরাধ, আমার পরোয়ানা প্রত্যাহার চাই। ঘটনায় জড়িত রোহিঙ্গার বিচার চাই।
কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের গ্রাম পুলিশ (চৌকিদার) নবী হোসেন বলেন, নুরুল বশর দীর্ঘদিন ধরে হোয়াইক্যং বাজারে দর্জির দোকানে কাজ করেছেন। শুনেছি তার নাম, পিতা ও মাতার নাম ব্যবহার করেছে রোহিঙ্গা জোহর আলম নামে এক ব্যক্তি।
হোয়াইক্যং ইউনিয়ন পরিষদের ২ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য সিরাজুল মোস্তফা প্রকাশ লালু মেম্বার বলেন, নুরুল বশর আমার ভাইপো। তার বিরুদ্ধে কোনও মামলা নেই। রোহিঙ্গা যুবক জোহর আলম মাদকসহ গ্রেফতার হয়েছিল। তখন জোহর আলম ইচ্ছাকৃতভাবে নুরুল বশরের নাম-ঠিকানা ব্যবহার করেছে। জোহর আলম আমাদের এলাকায় দৈনিক ভিত্তিতে কাজ করেছিল।
আদালত, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও থানা সূত্র জানায়, ২০১৮ সালের ৫ ডিসেম্বর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর চট্টগ্রামের ‘ক’ সার্কেল গোপন সংবাদের ভিত্তিতে রাঙ্গুনিয়ার উত্তর পদুয়ার সুখবিলাস ইসলামিক মিশনারী সেন্টার গেইট থেকে জোহর আলমকে ২ হাজার পিস ইয়াবাসহ আটক করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে জোহর নিজের নাম গোপন রেখে নুরুল বশরের নাম, পিতা ও মাতার নামসহ পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা ব্যবহার করে। কিন্তু নুরুল বশরে আইডি কার্ডে নাম নুরুল বশর থাকলেও মামলার এজাহার, অভিযোগপত্র ও মামলার রায়ে মো. নুরুল বশর উল্লেখ করা হয়। অন্যদিকে নুরুল বশরের পিতার নাম এনআইডি কার্ডে সৈয়দ কাসিম থাকলেও মামলার এজাহার, অভিযোগপত্র ও মামলার রায়ে সৈয়দ কাশেম উল্লেখ করা হয়েছে। মায়ের নাম উল্লেখ করা হয়েছে- কুলসুমা বেগম।
মাদক উদ্ধারের ঘটনায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর চট্টগ্রামের ‘ক’ সার্কেল এর সহকারী উপপরিদর্শক মুহাম্মদ খোরশেদ আলম বাদি হয়ে রাঙ্গুনিয়া থানায় মামলা করেন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা চট্টগ্রামের ‘ক’ সার্কেলের পরিদর্শক জীবন চাকমা ২০১৯ সালের ৬ জানুয়ারি আদালতে অভিযোগ পত্র জমা দেন। ২০২০ সালের ৩ মার্চ হাইকোর্টের বিচারপতি মোহাম্মদ আব্দুল হাফিজ ও কাজী মো.ইজারুল হক আকন্দের বেঞ্চ আসামিকে জামিন দেন। ১ বছর ৯ মাস ১৮ দিন পর ২০২০ সালের ২৩ মার্চ চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পান। আদালতে ৫ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। তৎকালীন চট্টগ্রাম বিভাগীয় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল ও বিশেষ দায়রা জজ এ কে এম মোজাম্মেল হক চৌধুরী ২০২২ সালের ২০ জানুয়ারি ১০ বছরের কারাদণ্ডের আদেশ দেন। রায়ের সময় আসামি পলাতক ছিলেন।
এদিকে, গত ৬ আগস্ট জোহর আলমকে একটি মামলায় গ্রেফতার করে টেকনাফ থানা পুলিশ। বর্তমানে জোহর কক্সবাজার কারাগারে বন্দি।
জোহর আলম গ্রেফতার হওয়ার আগের একটি ভিডিও কাছে সংরক্ষিত আছে। সেখানে জোহর আলমকে বলতে শুনা যায়, ‘আমি হোয়াইক্যং ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডে কাজ করতাম। নুরুল বশরের বাড়িতে তিন-চার দিন কাজ করেছি ও সবার সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে ইয়াবাসহ গ্রেফতার হয়েছি। মারধরের ভয়ে নিজের নাম গোপন করে নুরুল বশরের নাম বলেছি। বার্মা কিনা প্রশ্ন করেছিল, আমি ভয়ে বাংলাদেশি বলেছি। পরিচয় দিয়েছি- নাম মো. নুরুর বশর, পিতা সৈয়দ কাশেম, মাতা কুলসুমা বেগম। নুরুল বশর পরিচিত কিংবা আত্মীয় নয়। আমি হিসাব করেছি, জেল থেকে কেউ মোহাব্বত করলে বের হতে পারবো। না হয় নুরুল বশর নামে জেলে জীবন কাটিয়ে দিতাম’।
নুরুল বশরের পক্ষে সংশ্লিষ্ট আদালতে একটি আবেদন দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন অ্যাডভোকেট সেলিম উল্লাহ চৌধুরী। এ ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু বলতে চাননি তিনি।
সুশাসনের জন্য নাগরিক চট্টগ্রামের সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী বলেন, প্রতিনিয়ত এই ধরনের ঘটনা ঘটছে। নিরপরাধ ব্যক্তি বিষয়টি আদালতের নজরে আনতে পারেন। কারাগারে আঙ্গুলের ছাপ নিলে প্রকৃত আসামি চিহ্নিত হবে। এক্ষেত্রে মামলার তদন্ত কর্মকর্তার অবহেলা রয়েছে। বিনাদোষে একজন ব্যক্তিকে কারাগারে যেতে হবে-এটা মেনে নেওয়া যায় না। যাদের অবহেলা রয়েছে, তাদেরও শাস্তি হওয়া দরকার।











