শাহ আহমদ শফীর জানাজা লাখোয় মানুষের ঢল

হাটহাজারী প্রতিনিধি:: আল্লামা শাহ আহমদ শফীর জানাজা সম্পন্ন হয়েছে। এত লাখো মানুষের ঢল নামে চট্টগ্রামের দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসার অভিমুখে।

শনিবার(১৯ সেপ্টেম্বর)যোহর নামাজের পর বেলা দুপুর ২টার দিকে দারাল উলুম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসা মাঠ প্রাঙ্গনে পাখিয়ারটিলা কওমি মাদ্রাসার পরিচালক হুজুরের বড় সন্তান মাওলানা মোহাম্মদ ইউসুফ এর ইমামতিতে এ নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। লাখো মানুষের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে স্মরণকালের বৃহৎ নামাজে জানাজা শেষে হেফাজতে ইসলামের আমির  আল্লামা শাহ আহমদ শফীর ইচ্ছে অনুযায়ী মাদরাসা ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে বায়তুল আতিক জামে মসজিদ সংলগ্ন কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
জানাযা নামাজে কুমিল্লা, লক্ষ্মীপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নোয়াখালীসহ আশপাশের জেলাগুলোর বহু কওমি মাদ্রাসা থেকে বিপুল শিক্ষার্থী,আলেম, দেশবরেণ্য আলেমেদ্বীন আল্লামা শাহ আহমদ শফীকে শেষ বিদায় জানাতে আসা মানুষের ঢলে উত্তর চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলা জনসমুদ্রে পরিণত হয়। কয়েক বর্গ কিলোমিটার এলাকায় নামাজে জানাজায় শরিক হন লাখ লাখ মানুষ। জানাযা নামাজে শরীক হওয়া স্থানীয় সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, হুজুরের একান্ত প্রচেষ্টায় এদেশের কওমি মাদরাসার সনদের স্বীকৃতি পাওয়া সম্ভব হয়েছে। এদিকে আহমদ শফীর মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ,ভুমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ,চট্টগ্রাম-৯ আসনের সংসদ সদস্য ও শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল,বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী সহ আরো অনেকে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন ।
গতকাল বৃহস্পতিবার বিকালের দিকে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফী অসুস্থ হয়ে পড়লে রাতে অ্যাম্বুল্যান্সে করে তাঁকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করা হয়। সকালে হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা মেডিক্যাল বোর্ড বসান। তাঁর শারীরিক অবস্থা সংকটাপন্ন হওয়ায় দুপুরের দিকে চিকিৎসকরা তাঁকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। পরে শুক্রবার বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে তাকে হাসপাতালের আইসিইউতে থাকাবস্থায় এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকায় নিয়ে আজগর আলী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ভর্তির কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁকে মৃত ঘোষণা করা হয়। এর আগে চমেক হাসপাতালের এক চিকিৎসক সাংবাদিকদের জানান, বৃহস্পতিবার আল্লামা শফীর হার্টে মারাত্মক সমস্যা দেখা দেয়।বর্তমানে তিনার অবস্থা সংকটাপন্ন। তাই উন্নত চিকিৎসার জন্য দ্রুত ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি। তিনি দীর্ঘদিন ধরে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপসহ বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছিলেন।
আহমদ শফী চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া থানার পাখিয়ারটিলা গ্রামে ১৯১৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন।তিনার বাবার নাম মরহুম বরকত আলী এবং মাতার নাম মরহুমা মেহেরুন্নেছা। আহমদ শফীর শিক্ষাজীবন শুরু হয় রাঙ্গুনিয়ার সরফভাটা মাদ্রাসায়। এরপর পটিয়ার আল জামিয়াতুল আরাবিয়া মাদ্রাসায় (জিরি মাদ্রাসা) লেখাপড়া করেন। ১৯৪০ সালে তিনি হাটহাজারীর দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম মাদ্রাসায় ভর্তি হন। এবং পরে ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ মাদরাসায় শিক্ষালাভ করেন।তবে আহমদ শফী ১৯৪৬ সালে চট্টগ্রামে ফিরে আসেন এবং আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসায় শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৮৬ সালে মাদ্রাসাটির মজলিশে শুরা তাকে মহাপরিচালক বা মুহতামিম নিযুক্ত করেন। পরবর্তীতে তিনি মাদ্রাসাটির শায়খুল হাদিসের দায়িত্ব পান।  তিনি ২০১০ সালে হেফাজতে ইসলাম নামে একটি ধর্মীয় সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। ২০২০ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর আহমদ শফীর পদত্যাগ এবং তার ছেলে আনাস মাদানীকে বিভিন্ন অভিযোগে মাদ্রাসা থেকে বহিষ্কারসহ ৫ দফা দাবি নিয়ে দারুল উলুম হাটহাজারী মাদ্রাসার ছাত্ররা আন্দোলন শুরু করে। দুপুর দিকে এ আন্দোলন শুরু হয়, রাত্রে আনাস মাদানীকে বহিষ্কার করা হয় এবং পরদিন আহমদ শফী স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন। এদিকে স্বাস্থ্যবিধি লঙ্ঘনের কারণ দেখিয়ে সরকার অনির্দিষ্টকালের জন্য হাটহাজারী মাদ্রাসা বন্ধ ঘোষণা করে তবে ছাত্ররা সরকারের এ ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলন চালাতে থাকে। ফলে সংকট সমাধানে বৃহস্পতিবার(১৭ সেপ্টেম্বর)রাত সাড়ে দশটার দিকে জরুরী মজলিশে শুরার বৈঠকের আয়োজন করা হয়।সর্বশেষ এ বৈঠকে আল্লামা আহমদ শফি মুহতামিম পদ থেকে পদত্যাগ করে মাদরাসার দায়িত্ব মজলিসে শূরার হাতে অর্পণ করেন। উক্ত বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন, আল্লামা শাহ আহমদ শফী, আল্লামা শাহ মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী, মাওলানা শেখ আহমদ, মাওলানা নোমান ফয়েজি, মাওলানা সালাহউদ্দিন নানুপুরী, মুফতী নুর আহমদ, মাওলানা শোওয়াইব, মাওলানা ওমর, মাওলানা কবির আহমদ, মাওলানা আহমদ দিদার, মাওলানা আশরাফ আলী নিজামপুরী। বৈঠকে ঘোষণা দেয়া হয়, আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসার মুহতামিমের পদ থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করায় শূরা কমিটি আল্লামা আহমদ শফিকে সদর মুহতামিম হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন এবং মাদ্রাসার শিক্ষক মাওলানা আনাস মাদানীকে স্থায়ী ভাবে বহিষ্কার ও তার আগের দিন অর্থাৎ গত বুধবারের বৈঠকের সব সিদ্ধান্ত বলবত রেখে মাওলানা নুরুল ইসলাম কক্সবাজারিকে মাদ্রাসার সব দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এছাড়াও পরবর্তী মুহতামিম নির্ধারণের দায়িত্ব শূরা কমিটিকে দেওয়া হয়। ঘোষণার পর পর আন্দোলনরত ছাত্রদের দাবী বাস্তবায়ন হওয়ায় আন্দোলনের সমাপ্তিও ঘোষনা দেয় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সময মাদরাসায় অবস্থান করা আহমদ শফী অসুস্থ হয়ে পড়লে হাটহাজারী মাদরাসা থেকে অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করা হয়।পরে অবস্থার অবনতি হলে শুক্রবার বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে তাকে চমেক হাসপাতালের আইসিইউতে থাকাবস্থায় এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকায় নিয়ে আজগর আলী হাসপাতালে ভর্তি করা হলে শুক্রবার ১৮ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যার দিকে ১০৫ বছর বয়সে তিনি সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে দুই ছেলে ও তিন মেয়ে ও অনেক গুণগ্রাহী রেখে যান তিনি । তাঁর বড় ছেলে মাওলানা মোহাম্মদ ইউসুফ পাখিয়ারটিলা কওমি মাদ্রাসার পরিচালক এবং ছোট ছেলে আনাস মাদানি বর্তমানে হেফাজতে ইসলামের প্রচার সম্পাদক। তাঁর লেখা ‘হক্ব ও বাতিলের চিরন্তন দ্বন্দ্ব’, ‘ইসলামী অর্থ ব্যবস্থা’, ‘ইসলাম ও রাজনীতি’, ‘হাদিসসমূহের ব্যাখ্যা’সহ ২২টি প্রকাশিত গ্রন্থ রয়েছে। তাঁর সহকর্মীরা জানিয়েছেন, দেশ বিদেশে ৫০ লাখের বেশি মুরিদ ও ভক্ত রয়েছে আল্লামা আহমদ শফীর।