ভাড়া বেড়েছে স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে আংশিক

মানবজমিন: করোনাভাইরাসের কারণে টানা ৬৭ দিন বন্ধ থাকার পর ফের চালু হয়েছে গণপরিবহন। গতকাল দূরপাল্লার বাসের পাশাপাশি ঢাকার প্রায় সব রুটেই বাস চলাচল করেছে। যাত্রীদের চাপ কম থাকলেও বেশিরভাগ বাসে স্বাস্থ্যবিধি মানা হয়নি। বাস স্টাফরা বর্ধিত ভাড়া আদায়ে তৎপর ছিলেন। যাত্রীদের স্বাস্থ্যবিধি বজায় রাখার ক্ষেত্রে তাদের তেমন কোনো আগ্রহ দেখা যায়নি। বেশিরভাগ বাসে ছিল না হ্যান্ড স্যানিটাইজারসহ জীবাণুনাশক স্প্রে। টিকিট কাউন্টারগুলোতে মানা হয়নি শারীরিক দূরত্ব। সরকারি নির্দেশনায় বাসে উঠার আগে হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিষ্কারে নির্দেশ থাকলেও সেটি লক্ষ্য করা যায়নি।
যাত্রী উঠানোর আগে শরীরের তাপমাত্রা পরীক্ষা করার যন্ত্র নেই অনেক বাসে। সিটি বাসগুলো যত্রতত্র থেমে যাত্রী উঠা নামানো করেছে। ছাত্রী ছাউনিতে ছিল না কোনো রকম স্বাস্থ্যবিধি। দূরপাল্লার বাস টার্মিনালগুলোতে ছিল অনেকটা ঘিঞ্জি পরিবেশ। আর ৬০ শতাংশ ভাড়া বৃদ্ধি করায় যাত্রীদের অভিযোগ ছিল চরমে। কিছু কিছু বাসের যাত্রীরা অভিযোগ করে বলেন, ৬০ শতাংশের বেশি ভাড়া আদায় করছে বাস চালকরা। চালকেরা দাবি করছেন, তারা সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী স্বাস্থ্যবিধি মেনেই বাসা চালাচ্ছেন।
সরজমিন ঢাকার গাবতলী, সায়েদাবাদ, মহাখালী বাসস্ট্যান্ড ঘুরে দেখা গেছে, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দূরপাল্লার যাত্রী নিয়ে বাস ঢাকায় এসেছে। এসব বাসে যাত্রীদের সংখ্যা নেহাত কম ছিল না। আবার বিভিন্ন গন্তব্যের উদ্দেশ্য ছেড়ে যাওয়া বাসগুলোতে যাত্রীদের চাপ ছিল। যাত্রীদের মধ্যে সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি মানার প্রবণতা কম ছিল। অনেক যাত্রীর মুখে মাস্ক ও হাতে গ্লাভস ছিল না। কিছু কিছু বাসে দেখা গেছে, স্টাফরা যাত্রীদের স্বাস্থ্যবিধি মানার জন্য উৎসাহিত করছেন। তারা বাসে উঠার আগে যাত্রীদের জীবাণুনাশক স্প্রে করেন। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ব্যতিক্রম।
সরকারি নির্দেশনায় প্রতি ট্রিপের শুরুতে এবং শেষে বাধ্যতামূলকভাবে গাড়িতে জীবাণুনাশক স্প্রে করার কথা থাকলেও কোথাও তা বাস্তবায়ন করতে দেখা যায়নি। টার্মিনালে বাস আসার সঙ্গে সঙ্গেই ফের নতুন করে যাত্রী তোলে আবার ট্রিপ দিয়েছেন বাস চালকরা। যাত্রীরা নামার পরও সীটও পরিস্কার করেননি। একসীট পরপর যাত্রী বসানো হলেও ওঠা-নামার সময় শারীরিক দূরত্ব নিশ্চিত হয়নি। এমনকি বাসস্ট্যান্ড ছাড়া যেখানে সেখানে যাত্রী উঠাতে নামাতে দেখা গেছে। ভাড়া নিয়ে যাত্রীদের সঙ্গে বাকবিতন্ডা জড়াতে দেখা গেছে অনেক বাস স্টাফদের।
গতকাল ঢাকার বিভিন্ন সড়ক ঘুরে প্রায় সব কোম্পানির সিটি বাস চলতে দেখা গেছে। এরমধ্যে লাব্বায়েক পরিবহন, স্বাধীন, নূর এ মক্কা, তুরাগ, বলাকা, গাজীপুর পরিবহন, আল মক্কা, প্রভাতি-বনশ্রী পরিবহন, গুলিস্তান পরিবহন, এম এম লাভলী, ভূইয়া পরিবহন, ট্র্যান্সসিলভা, আলিফ, অগ্রদূত, দিশারী, বৈশাখি, নিউভিশন, হিমাচল, তালুকদার, সাভার পরিবহণের বাস চলাচল করেছে। সিটি বাসে যাত্রীদের চাপ কম ছিল। বাসের মোট আসনের অর্ধেক যাত্রী নিয়ে চলাচল করেছে। মৌচাক এলাকায় এম এম লাভলী বাসের যাত্রী হায়াতুল করিম বলেন, ফার্মগেট থেকে উঠেছি। ভাড়া আগের চেয়ে দ্বিগুণ। বাসের ভেতরে স্বাস্থ্যবিধির তেমন কিছু দেখা গেল না। ফার্মগেটে কয়েকজন যাত্রী নামার পরে আমরা তিনজন উঠলাম। আগের যাত্রীরা যেসব সিট থেকে নেমেছেন ওইসব সিটে বসতে হয়েছে। বাসের কোনো স্টাফকে জীবাণুনাশক ছিটাতে দেখেননি তিনি।
মোহাম্মদপুরে ভূইয়া পরিবহনের যাত্রী আল আমিন মনে করেন যাত্রীদের সচেতন হতে হবে। মাস্ক, হ্যান্ডস গ্লাভস ব্যবহার করতে হবে। সম্ভব হলে নিজের কাছে জীবাণুনাশক রাখতে হবে।
গুলিস্তান পরিবহণের যাত্রী হিমেল রায়হান বলেন, বাসগুলো সিগন্যাল পেলেই যত্রতত্র থেমে যায়। বাসের উঠার সময় চালকের সহকারিরা কোনো জীবাণুনাশক ছিটায় না। এছাড়া এখন ডাবল ভাড়াও গুনতে হচ্ছে।
গাবতলীতে সাভার থেকে আসা যাত্রী মো. কামাল হোসেন জানান, বাসে একসীট পরপর যাত্রী বসানো হয়। তবে বাসের সীট গুলো পরিস্কার করা হচ্ছে না। একজন যাত্রী নামানোর পর সেই সীটে নতুন করে আরেকজনকে বসানো হয়। অনেক দিন পর বাস রাস্তায় নেমেছে। আগের ময়লা সীটের বাসগুলো এখনো দেখা যাচ্ছে। এর ফলে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়তে পারে। এই বিষয়ে সরকারকে আরো কঠোর হতে হবে।
প্রভাতি বনশ্রি বাসের চালক আজগর আলী বলেন, আমরা সরকারি নির্দেশনা মেনেই বাস চালাচ্ছি। এক সীট পর পর যাত্রী নিচ্ছি। প্রথম ট্রিপের আগের বাস পরিষ্কার করেছি। যাত্রীরা উঠার আগে জীবাণুনাশক ছিটিয়েছি। ট্রিপ শেষে আবার বাস পরিষ্কার করবো। ৬০ শতাংশের বেশি ভাড়া আদায় করার অভিযোগ করলে তিনি বলেন, আমরা সরকারি নির্ধারিত ভাড়া নিচ্ছি। ভাড়া
বাস চালক হেমায়তে উদ্দিন জানান, ট্রিপ শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে যাত্রীরা তড়িঘড়ি করে উঠে যাচ্ছে। এতে আমরা বাস পরিস্কার করার সুযোগ পাচ্ছি না। অনেক দিন পর বাস নিয়ে রাস্তায় নেমেছি। এখন অর্ধেক যাত্রী নিয়ে বাস চালাতে হয়। তারপরও আমরা সবাইকে সর্তক করছি। হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিস্কার করতে বলছি। মাস্ক না পড়লে বাসে উঠতে দেই না। সব নিয়ম কি আর মেনে চলা সম্ভব?
গাবতলী বাস মালিক শ্রমিক সমিতির এক নেতা জানান, আমরা পর্যাপ্ত চেষ্টা করছি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে। এখানে সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া আছে। অনেকদিন পর বাস চলাচল করায় যাত্রীদের ভিড় আছে। তবে কয়েকটি কাউন্টারে শারীরিক দূরত্ব মানা হচ্ছে না। এটা আমাদের নজরে পড়েছে। আমরা তাদেরকে এই বিষযে সতর্ক করেছি। আশা করি কয়েক দিনের মধ্যে এইসব নিয়মে আমরা অভ্যস্থ হয়ে যাবো। সেখানে ডিউটিরত এক সার্জেন্ট বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনেই চলবে বাস। আমরা আগের চেয়ে কঠোর অবস্থানে আছি। কোন বাসে যেন বেশি যাত্রী না উঠাতে পারে সেই দিকে আমাদের দৃষ্টি আছে। সরকারের নিয়ম মেনে না চললে আমরা আইনের আওতায় আনবো।
করোনাভাইরাস সংকটের মধ্যেই অফিস খোলা ও গণপরিবহন সীমিত আকারে চলাচলের সরকারি সিদ্ধান্তের পর বাসের ভাড়া ৮০ শতাংশ বাড়ানোর সুপারিশ করেছিল সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। বিআরটিএ্থএর ওই সুপারিশকে গণবিরোধী উল্লেখ করে কড়া সমালোচনার মধ্যেই রোববার বিআরটিএ এই সুপারিশের মাত্র ২০ শতাংশ কমিয়ে গণপরিবহনের ভাড়া ৬০ শতাংশ বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। ওদিকে গণপরিবহনে ৬০ শতাংশ ভাড়া বাড়িয়ে জারি করা প্রজ্ঞাপণ চ্যালেঞ্জ করে হাইকোটের্ গতকাল রিট দায়ের করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হুমায়ুন কবির পল্লব। আর প্রজ্ঞাপনটি স্থগিত চেয়ে সরকারকে আইনি নোটিশ দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আরেক আইনজীবী মনিরুজ্জামান লিংকন।
গণপরিবহন চালানোর জন্য বেশ কিছু নির্দেশনা দেয় সরকার। গণপরিবহন চালাতে ৬০ ভাগ বর্ধিত ভাড়ার প্রজ্ঞাপনে যে সব শর্তাবলি উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো হলো- একজন যাত্রীকে বাস/মিনিবাসের পাশাপাশি দুটি আসনের একটি আসনে যাত্রী, অপরটি অবশ্যই ফাঁকা রাখতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি অনুসারে শারীরিক ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। কোনোভাবেই সংশ্লিষ্ট মোটরযানের রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট উল্লেখিত মোট আসন সংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি যাত্রী বহন করা যাবে না এবং দাঁড়িয়ে কোনো যাত্রী বহন করা যাবে না। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কর্তৃক প্রদত্ত নির্দেশনা যথাযথভাবে অনুসরণপূর্বক বাস-মিনিবাস পরিচালনা করতে হবে। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের যে ১২ দফা নির্দেশনা দিয়েছেন সেগুলো হলো- স্বাস্থ্যবিধি, সামাজিক দূরত্ব ও শারীরিক দূরত্ব কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে। বাস টার্মিনালে কোনোভাবেই ভিড় করা যাবে না। তিন ফুট দূরত্ব বজায় রেখে যাত্রীরা গাড়ির জন্য লাইনে দাঁড়াবেন এবং টিকিট কাটবেন। স্টেশনে পর্যাপ্ত হাত ধোয়ার ব্যবস্থা রাখতে হবে। বাসে কোনও যাত্রী দাঁড়িয়ে যেতে পারবে না। বাসের সব সিটে যাত্রী নেওয়া যাবে না। ২৫-৩০ শতাংশ সিট খালি রাখতে হবে। পরিবারের সদস্য হলে পাশের সিটে বসানো যাবে অন্যথায় নয়। যাত্রী, চালক, সহকারী, কাউন্টারের কর্মী সবার জন্য মাস্ক পরিধান বাধ্যতামূলক। ট্রিপের শুরুতে এবং শেষে বাধ্যতামূলকভাবে গাড়ির অভ্যন্তরভাগসহ পুরো গাড়িতে জীবাণুনাশক স্প্রে করতে হবে। যাত্রী ওঠা-নামার সময় শারীরিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে হবে। যাত্রীদের হাত ব্যাগ, মালামাল জীবাণুনাশক দিয়ে স্প্রে করতে হবে।