হালদা নদীতে ড্রেজার দিয়ে বালি উত্তোলন হুমকিতে মা মাছ ও ডলফিন

শফিউল আলম, রাউজানঃ প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদীর মোহনায় কর্ণফুলী নদী থেকে ড্রেজার দিয়ে শত শত টন বালু তুলছে একাধিক চক্র। চরের কিনারায় দুই নদীর মিলনস্থলে ড্রেজার বসিয়ে বালু তুলছে ব্যবসায়ীরা। ফলে বেড়েছে নদী ভাঙন এবং মরছে ডলফিন ও মা মাছ। নদীর ভাঙনে শত শত একর জমি নদীতে বিলিন হচ্ছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, প্রতিদিন অর্ধশতাধিক বড় বড় নৌযানে করে এই বালু নেওয়া হয় চট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন এলাকা ও কালুরঘাটের উভয় তীরসহ বোয়ালখালী, রাউজানের বিভিন্ন স্পটে। পরে সেখান থেকে চট্টগ্রামের বিভিন্নস্থানে বালু সরবরাহ করা হয়।

সরেজমিনে দেখা গেছে, নদী থেকে বালু তোলার কারণে হালদা ও কর্ণফুলীর দুই তীরে নতুন করে ভাঙন দেখা দিয়েছে। ফলে ভাঙন প্রতিরোধী পাথরের ব্লক নদীর গভীরে নেমে যাচ্ছে। কিছু কিছু স্থানে নদীর তলদেশের পাথরের ব্লক ধসে গিয়ে আবারও ভাঙন শুরু হয়েছে।

হালদা ও কর্ণফুলী নদী পাড়ের সাধারণ মানুষ জানিয়েছেন, নদীতে প্রতিনিয়ত যান্ত্রিক নৌযান চলে। ফলে নৌযানের পাখার আঘাতে মরছে ডলফিন ও মা মাছ। এদিকে, কর্ণফুলী নদী থেকে ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলনের ফলে রাউজানের কচুখাইন,পাচঁখাইন, উভলং, লাম্বুরহাট, খেলারঘাট সহ বিভিন্ন গ্রাম ভাঙনের হুমকিতে পড়ছে। নদীর এপাড় ভেঙে ওপাড়ে বিশাল চর জেগে উঠলেও ভুক্তভোগী পরিবারগুলো ওসব চরে দখল পাচ্ছে না। ওই চরের দখলদারিত্ব বজায় রাখছে প্রভাবশালীরা।কচুখাইন গ্রামের বাসিন্দা মোঃ হাসেম বলেন, ‘হালদার চর এলাকা থেকে বালু উঠানোর প্রতিযোগিতায় রয়েছে রাউজান, রোয়ালখালী ও মোহরা, কালুঘাটের বেশ কয়েকটি সিন্ডিকেট। সিন্ডিকেটের দাবি, তারা বালু মহাল ইজারা নিয়ে বালু তুলছেন। এক সময়ে হালদা নদীর বিভিন্ন স্পট থেকে বালু উত্তোলন করা হতো । হালদা নদীর মা মাছ ও জীববৈচিত্র রক্ষায় চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন হালদা নদীর বালু মহল ইজারা বন্দ্ব করে দেয় । হালদা নদীর বালু মহল ইজারা বন্দ্ব করে দিলে ও থামেনি হালদা থেকে বালু উত্তোলন। হালদা নদীর মোহনা কর্ণফুলী নদী থেকে ড্রেজার দিয়ে উত্তোলন করছে বালু। এছাড়া ও রাউজানের কচুখাইন, মোকামী পাড়া, দেওয়ানজী ঘাট, পশ্চিম আবুর খীল, নাপিতের ঘাট, মগদাই সুইস গেইট, কাগতিয়া, কাসেম নগর, পশ্চিম বিনাজুরী, বদুর ঘোনা, কোতোয়ালী ঘোনা, কাজী পাড়া, ইন্দিরা ঘাট, হাটহাজারীর মাদ্রাসা, উত্তর মার্দ্রাসা, মেখল, গড়দুয়ারা, লাঙ্গলমোড়া এলাকায় বর্তমানে হালদা নদী থেকে সনাতন পদ্বতিত্বে নদীতে ডুব দিয়ে বালু উত্তোলন করে বালু যান্ত্রিক নৌযানে ভর্তি করে হালদা নদী দিয়ে প্রতিনিয়ত পরিবহন করছে । রাউজানের দেওয়ানজী ঘাট ও মোকামী পাড়ার বিপরিতে হালদা নদীতে জেগে উঠা হালদার চর থেকে প্রতিদিন শত শত যান্ত্রিক নৌযান বালু উত্তোলন করছে । হালদা নদীর মোহনা কর্ণফুলী নদীতে ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন ও হালদা নদী থেকে বালু উত্তোলন ও যান্ত্রিক নৌযান চলাচলের ফলে হালদা নদীর মা মাছ সহ জীববৈচিত্র হুমকির মুখে পড়েছে ।

অপরদিকে হালদা নদীর সাথে সংযুক্ত খাল দিয়ে চট্টগ্রাম নগরী ও হাটহাজারী এলাকায় গড়ে উঠা কলকারখানার বিষাক্ত বজ্য হালদা নদীতে পড়ে হালদার পানি দুষন হয়ে আসছে । রাউজান , হাটহাজারী, ফটিকছড়ি,উপজেলার বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠা ইটের ভাটা, ডেইরী ফার্ম, পোল্টি ফার্মের বজ্য হালদা নদী ও হালদা নদীর সাথে সংযুক্ত খাল দিয়ে হালদা নদীতে পড়ছে । এসব কারনে হালদা হালদা নদীতে মা মাছ সহ ডলফিন মরছে একের পর এক । গত বুধবার (২০ ডিসেম্বর) সকাল সাড়ে ১১ টার দিকে আজিমারঘাটের একটু নিচের দিকে পানিতে ভেসে যাওয়ার সময় একটি গাঙ্গেয় প্রজাতির মৃত্য ডলফিন উদ্ধার করা হয়। ডলফিনটির দৈর্ঘ্য ৪৫ ইঞ্চি এবং ওজন ১৩.৩৯০ কেজি। এই বছরে হালদায় ৩টি ডলফিনের মৃত্যু হয়েছে। ২০১৭ সাল থেকে ২০২৪ পর্যন্ত হালদা নদী থেকে ৪২টি মৃত ডলফিন ও মা মাছ মারা গেছে । হালদা গবেষক ও চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজের জীববিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও সহকারী অধ্যাপক ড. মো.শফিকুল ইসলাম বলেন, হালদা নদীর শাখা খালগুলোর দূষণের ফলে ডলফিন মারা যেতে পারে। হালদা জলজ বাস্তুতন্ত্রকে মাছ, ডলফিন ও অন্যান্য প্রাণীর নিরাপদ আবাসস্থল নিশ্চিত করতে দূষনসহ সবধরনের ধংসাত্মক কর্মকান্ড বন্ধ করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।রাউজান উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন জানান, গত ১৮ ডিসেম্বর বুধবার সাড়ে ১১ টার দিকে আজিমের ঘাট এলাকা থেকে একটি ডলফিন অর্ধ গলিত ভাসমান অবস্থায় পাওয়া যায়। পরে স্থানীয় লোকজনের সহযোগিতায় উদ্ধার করে পাড়ে তুলে প্রাথমিক সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করে এটিকে মাটি চাপা দেয়া হয়।তবে শরীরে কোন আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায় নাই। ধারণা করা হচ্ছে যে, যেহেতু জোয়ার শুরুর প্রায় আড়াই থেকে তিন ঘন্টা পর ডলফিনটিকে ভেসে আসতে দেখা যায় সেক্ষেত্রে হালদা নদীর নিম্ন অববাহিকা বা কর্ণফুলী নদীতে এটি মারা গিয়ে থাকতে পারে। কর্ণফুলী নদীতে সাম্প্রতিক দূষণ ও জাহাজ বা অন্যান্য নৌযান হতে তেল ছড়িয়ে পড়ার কারণেও ডলফিন মারা যেতে পারে। তিনি আরও জানান, হালদা নদীর প্রাকৃতিক মৎস্য সম্পদ রক্ষার জন্য রাউজান-হাটহাজারী উপজেলায় পর্যাপ্ত জনবল সংকট রয়েছে। মৎস্য সম্পদ রক্ষার জন্য দু’ উপজেলায় পর্যাপ্ত জনবল নিয়োগসহ নিজস্ব নৌযানের ব্যবস্থা করা এখন সময়ের দাবি। সরকার এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে এই আশাবাদ এলাকাবাসীর।