রোজা অবস্থায় চিকিৎসা

 

আমাদের অনেকেই বুঝে উঠতে পারেন না চিকিৎসার প্রয়োজনে কখন ও কি অবস্থায় রোজা রাখা যাবে কিংবা কোন অবস্থায় রোজা ভঙ্গ হবে। চিকিৎসা নিতে আসা অনেক রোগীর মুখে একটি সাধারণ জিজ্ঞাসা হল- ডাক্তার সাহেব আমি রোজা আছি, আমি কি রক্ত নিতে পারব বা আমার শ্বাস কষ্টের সমস্যা – এ অবস্থায় কি ইনহেলার নিলে রোজা ভঙ্গ হবে?

রোগীর কাছ থেকে এ জাতীয় প্রশ্ন খুবই স্বাভাবিক, অনেক ক্ষেত্রে চিকিৎসক নিজেও দ্বিধায় ভোগেন এ সব প্রশ্নের উত্তর দেয়ার ক্ষেত্রে। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের যুগে এমন অনেক ব্যবস্থা আবিষ্কৃত হয়েছে যে সব ক্ষেত্রে ওষুধ বা চিকিৎসা সেবার জন্য মুখে খাবার দরকার নেই, ফলে রোজাদারের রোজা ভঙ্গ হওয়ার প্রশ্ন আসেনা। এ সব দ্বিধার অবসানের লক্ষ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ইসলামী চিন্তাবিদ ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা তাদের সুচিন্তিত মতামত দিয়েছেন। রোজাদারের রোজারত অবস্থায় কিছু চিকিৎসা গ্রহণ ও পরীক্ষা নিরীক্ষার ব্যাপারে তাদের সুচিন্তিত অভিমত রোজাদার রোগীর ক্ষেত্রে চিকিৎসা সেবা নেয়া সহজ হয়েছে।

১৯৯৭ সালের জুনে মরক্কোতে ‘ইসলামের সমসাময়িক চিকিৎসা সমস্যা’ (An Islamic View of Certain Contemporary Medical Issues) শিরোনামে একটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। এই সেমিনারের মূল আলোচ্য বিষয় ছিল- কী কী মেডিকেলজনিত কারণে রোজার ক্ষতি হবে না। পরবর্তী সময়ে নবম ফিকহ-মেডিকেল সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে যৌথভাবে বৈজ্ঞানিক, সাংস্কৃতিক এবং স্বাস্থ্য বিষয়ে আলোচনা হয়। এ আলোচনা যৌথভাবে জেদ্দার ইসলামিক ফিকহ একাডেমি, মিসরের আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়, আলেকজান্দ্রিয়ায় অবস্থিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক কার্যালয় এবং ইসলামী শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের (আইএসইএসিও) উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয়। এই সেমিনারেরও মূল আলোচ্য বিষয় ছিল কীভাবে ওষুধ সেবনে বা পরীক্ষা করলে রোজা নষ্ট হবে না। তারা কতিপয় সিদ্ধান্তে উপনীত হন। তাদের সিদ্ধান্তগুলো ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালে প্রকাশ করা হয়। এছাড়া কতিপয় মনীষী তাদের গ্রন্থাবলীতে এ বিষয়ে আলোকপাত করেছেন। তাদের মতামতের আলোকে রোজা অবস্থায় কতিপয় চিকিৎসার কথা ও রোগ নির্ণয়ক কতিপয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার কথা নিম্নে তুলে ধরা হলো।

রোজা অবস্থায় চোখ, নাক ও কানের ড্রপ, স্প্রে, ইনহেলার ব্যবহার করা যাবে।
হার্টের এনজাইনার সমস্যার জন্য বুকে ব্যথা উঠলে ব্যবহৃত নাইট্রোগ্লিসারিন ট্যাবলেট বা স্প্রে জিহ্বার নিচে ব্যবহার করলে রোজা নষ্ট হবে না।
শিরাপথে খাদ্য উপাদান ছাড়া কোনো ওষুধ ত্বক, মাংসপেশি, হাড়ের জোড়ায় ইনজেকশন হিসেবে প্রয়োগ করলে রোজার কোনো ক্ষতি হবে না। রোজাদারের জন্য চিকিৎসার ক্ষেত্রে সেই ইনজেকশন ব্যবহার করা বৈধ, যা পানাহারের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হয় না; যেমন পেনিসিলিন বা ইনসুলিন ইনজেকশন অথবা অ্যান্টিবায়োটিক বা টনিক কিংবা ভিটামিন ইনজেকশন অথবা ভ্যাকসিন ইনজেকশন প্রভৃতি হাতে, কোমরে বা অন্য জায়গায় অথবা দেহের পেশি বা শিরায় ব্যবহার করলে রোজার ক্ষতি হবে না।
রোজা অবস্থায় আতর বা অন্য প্রকার সুগন্ধি ব্যবহার করা এবং সর্বপ্রকার সুঘ্রাণ নাকে নেয়া বৈধ। তবে ধোঁয়া জাতীয় সুগন্ধি; যেমন আগরবাতি, চন্দন-ধোঁয়া প্রভৃতি ইচ্ছাকৃতভাবে নাকে নেয়া বৈধ হবে না। কারণ এ শ্রেণীর সুগন্ধির ঘনত্ব আছে, যা পাকস্থলীতে গিয়ে পৌঁছে।
লিভার বায়োপসি অথবা অন্য কোনো অঙ্গের বায়োপসি করলে রোজা নষ্ট হবে না।
জরুরি কোনো অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হলে রোজা অবস্থায় করা যাবে।
শরীরের কোনো কাটা বা ফাটা স্থান থেকে রক্ত বের হলে অথবা নাক থেকে রক্ত পড়লে রোজা নষ্ট হবে না।
রোজা রাখা অবস্থায় স্যালাইন বা গ্লুকোজ জাতীয় কোনো তরল শিরাপথে গ্রহণ করা যাবে না।
চিকিৎসার প্রয়োজনে রোজা রেখে অক্সিজেন কিংবা চেতনানাশক গ্যাস গ্রহণে রোজা নষ্ট হবে না।
চিকিৎসার প্রয়োজনে ক্রিম, অয়েন্টমেন্ট, ব্যান্ডেজ, প্লাস্টার ইত্যাদি ব্যবহার করলে এবং এসব উপাদান ত্বকের গভীরে প্রবেশ করলেও রোজার কোনো সমস্যা হবে না।
রোজা রেখে দাঁত তোলা যাবে, দাঁতের ফিলিং করা যাবে এবং ড্রিল ব্যবহার করা যাবে।
দাঁত পরিষ্কারের সময় অসাবধানবশত কোনো কিছু গিলে ফেললে রোজা নষ্ট হবে না।
রোজা রেখে রক্ত পরীক্ষার জন্য রক্ত দিলে এবং কাউকে রক্তদানেও কোনো বাধা নেই। একই সঙ্গে রক্ত গ্রহণ করতেও বাধা নেই রোজা রেখে।
কিডনী অকেজো হলে রোজা অবস্থায় দেহের রক্ত পরিষ্কার বা ডায়ালাইসিস করলে রোজা ভাঙবে না।
হার্ট কিংবা অন্য কোনো অঙ্গের এনজিওগ্রাফি করার জন্য কোনো রোগ নির্ণয়ক দ্রবণ শরীরে প্রবেশ করানো হলেও রোজার কোনো ক্ষতি হবে না।
মুখ পরিষ্কারের জন্য মাউথওয়াশ বা গড়গড়া বা মুখে স্প্রে জাতীয় ওষুধ ব্যহবহার করা যাবে, তবে যেন পাকস্থলীতে কোনো কিছু না যায়।
মহিলা রোগীর তলপেটে পরীক্ষার জন্য যোনিদ্বার দিয়ে চিকিৎসক বা নার্স হাতের আঙুল অথবা কোনো যন্ত্র প্রবেশ করালে রোজা ভাঙবে না। এমনকি চিকিৎসার জন্য যোনিপথে পেসারি বা কোনো ওষুধ ব্যবহার করা যাবে।
কোনো অঙ্গের অভ্যন্তরীণ চিত্রধারণের জন্য সেই অঙ্গের প্রবেশপথে কোনো ক্যাথেটার বা নালির মাধ্যমে প্রয়োজনীয় তরল রঞ্জক প্রবেশ করালে রোজা নষ্ট হবে না। মূত্রথলি পরীক্ষা বা এক্স-রে করার জন্য রোগীর প্রস্রাবের দ্বার দিয়ে ক্যাথেটার অথবা অন্য কোনো যন্ত্র প্রবেশ করালে অথবা রেডিও-ওপেক ডাই প্রবেশ করালে রোজা ভাঙবে না।
রোগ নির্ণয়ের জন্য এন্ডোস্কোপি বা গ্যাস্ট্রোস্কোপি করলে রোজা নষ্ট হয় না। তবে পরীক্ষার সময় ভেতরে তরল কিংবা অন্য কোনো কিছু প্রবেশ করানো যাবে না- যার খাদ্যগুণ রয়েছে।
জরায়ু পরীক্ষার জন্য শরীরে হিস্টারোস্কপি করা যাবে, এমনকি জরায়ুতে কোনো যন্ত্রপাতি বা অন্য কিছু পরীক্ষার জন্য প্রবেশ করালে রোজার কোনো সমস্যা হবে না।
রোগীর পায়ুপথে ইনজেকশন অথবা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য আঙুল বা অন্য কোনো যন্ত্র প্রবেশ করালে রোজা নষ্ট হবে না। রোজা অবস্থায় জ্বরে আক্রান্ত হলে পায়খানার দ্বারে ওষুধ (সাপোজিটারী) ব্যবহার করা যায়। অনুরূপভাবে জ্বর মাপার জন্য বা অন্য কোনো পরীক্ষার জন্য মল-দ্বারে কোনো যন্ত্র ব্যবহার করলে রোজা নষ্ট হবে না। কারণ এ কাজকে খাওয়া বা পান করা কিছুই বলা যাবে না এবং পায়খানার পথ পানাহারের পথ হিসেবে গণ্য নয়।