নেককার সন্তান পরকালে বাবা-মার মুক্তির উপায়

যাবতীয় প্রশংসা কেবলই আল্লাহ তা‘আলার যিনি সমগ্র জগতের মালিক ও রব। আর সালাত ও সালাম নাযিল হোক আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর, যিনি সমস্ত নবীগণের সরদার ও সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী। আরও নাযিল হোক তার পরিবার-পরিজন ও সমগ্র সাথী-সঙ্গীদের ওপর।

ইসলাম মা-বাবাকে সন্তানের সুশিক্ষা নিশ্চিত করার নির্দেশ দিয়েছে। যেন পৃথিবীতে তাদের জীবন স্বস্তিকর হয় এবং পরকালেও তাদের প্রতি কল্যাণের ধারা অব্যাহত থাকে। ইসলামের দৃষ্টিতে সুসন্তান পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম সম্পদ। কেননা মৃত্যুর পর মানুষ সীমিত যে কয়েকটি মাধ্যম দ্বারা উপকৃত হয়, সুসন্তান তার একটি। হাদিসের ভাষ্য মতে, মৃত্যুর পর সন্তানের ভালো কাজ মা-বাবাকে উপকৃত করে। তাই সন্তানের দায়িত্ব পরকালে মা-বাবার আত্মার মুক্তি ও মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য বেশি বেশি নেক আমল করা। শরিয়তের দৃষ্টিতে যেসব কাজের মাধ্যমে সন্তান তার মৃত মা-বাবাকে লাভবান করতে পারে তার কয়েকটি হলো :

১. দোয়া ও ক্ষমা প্রার্থনা : মৃত মা-বাবার জন্য সন্তান সর্বদা দোয়া করবে। মা-বাবার জন্য সন্তানের দোয়া এবং সন্তানের জন্য মা-বাবার দোয়া আল্লাহ কবুল করেন। পবিত্র কোরআনেও মৃত ব্যক্তির জন্য দোয়াকারীর প্রশংসা করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘যারা তাদের পরে এসেছে, তারা বলে, হে আমাদের প্রভু! আপনি আমাদের ক্ষমা করুন এবং আমাদের পূর্ববর্তী যেসব ভাই ঈমানের সঙ্গে গত হয়েছেন তাদেরও ক্ষমা করুন।’ (সুরা : হাশর, আয়াত : ১০) তবে সবচেয়ে উত্তম হচ্ছে সাদাকায়ে জারিয়া বা প্রবাহমান ও চলমান সাদাকা প্রদান করা। যেমন পানির কুপ খনন করা, (নলকুপ বসানো, দ্বীনী মাদরাসা প্রতিষ্ঠা, কুরআন শিক্ষার জন্য মক্তব ও প্রতিষ্ঠান তৈরী করা, স্থায়ী জনকল্যাণমূলক কাজ করা। ইত্যাদি।

২. দান ও সদকা : বিশুদ্ধ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত, জীবিত ব্যক্তির দান-সদকা মৃত ব্যক্তিকে উপকৃত করে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি নবী (সা.)-কে বলেন, ‘আমার বাবা মারা গেছেন। তিনি সম্পদ রেখে গেছেন, তবে কোনো অসিয়ত করে যাননি। আমি যদি তার জন্য সদকা করি, তবে কি তাঁর পাপ মার্জনা হবে? তিনি বলেন, হ্যাঁ।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৪০০১)

৩. রোজা রাখা : আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে এলেন। তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমার মা মারা গেছেন। তাঁর এক মাসের রোজা কাজা রয়েছে। আমি কি তাঁর পক্ষ থেকে তা আদায় করব? রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যদি তোমার মায়ের কোনো ঋণ থাকত, তবে তুমি কি তা আদায় করতে? লোকটি বললেন, হ্যাঁ।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৮৫২)মা-বাবার কাজা রোজা আদায় করা ছাড়াও সন্তান মা-বাবার জন্য নফল রোজাও রাখতে পারে।

৪. কোরআন তিলাওয়াত করা : সন্তান মৃত মা-বাবার উদ্দেশে কোরআন তিলাওয়াত করতে পারে। এতে তাঁরা সওয়াব পাবেন। তবে অন্যের মাধ্যমে কোরআন পাঠ করানো এবং তার বিনিময় দেওয়া উচিত নয়; বরং নিজেই কোরআন তিলাওয়াত করবে এবং মা-বাবার আত্মার মুক্তির জন্য দোয়া করবে। আল্লামা ইবনে কুদামা (রহ.) মুগনিতে এ ব্যাপারে মুসলমানের ঐক্য দাবি করেছেন।

৫. নামাজ আদায় করা : সন্তান মৃত মা-বাবার জন্য নফল নামাজও আদায় করতে পারে। হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, ‘এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসুল! জীবদ্দশায় আমি আমার মা-বাবার আনুগত্য করি। তাঁদের মৃত্যুর পর আমি তাঁদের আনুগত্য কিভাবে করব? তিনি বলেন, মৃত্যুর পর তাদের আনুগত্য হলো, তুমি নামাজ পড়ার সময় তাদের জন্য নামাজ পড়বে এবং তুমি রোজা রাখার সময় তাদের জন্য রোজা রাখবে।’ (আওজাজুল মাসালিক ইলা মুয়াত্তায়ে মালিক, পৃষ্ঠা ২৬৭)

৬. কবর জিয়ারত করা : রাসুলুল্লাহ (সা.) নিয়মিত মদিনার ‘বাকি’ কবরস্থান জিয়ারত করতেন। মৃত আপনজন, আত্মীয়-স্বজন ও সাহাবিদের জন্য দোয়া করতেন। চলার পথে কোনো কবর বা কবরস্থান পড়লেও মৃত ব্যক্তিদের জন্য দোয়া করতেন। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘নবী (সা.) মদিনার একটি কবরস্থান অতিক্রম করার সময় তার দিকে ফিরে বলেন, ‘হে কবরবাসী! তোমাদের ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। আল্লাহ আমাদের ও তোমাদের মাফ করে দিন। তোমরা আমাদের অগ্রগামী, আমরা তোমাদের পদাঙ্ক অনুসারী।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ১০৫৩)

৭. মা-বাবার আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক রাখা : সন্তান তার মা-বাবার আত্নীয়দের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখবে। আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

‘যে ব্যক্তি তার পিতার সাথে কবরে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে ভালবাসে, সে যেন পিতার মৃত্যুর পর তার ভাইদের সাথে সু-সম্পর্ক রাখে’ [সহীহ ইবন হিববান:৪৩২]

৮. ঋণ পরিশোধ করা :মা-বাবার কোন ঋণ থাকলে তা দ্রুত পরিশোধ করা সন্তানদের উপর বিশেষভাবে কর্তব্য।রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঋণের পরিশোধ করার বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। আবু হুরায়রারাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

অর্থ: ‘‘মুমিন ব্যক্তির আত্মা তার ঋণের সাথে সম্পৃক্ত থেকে যায়; যতক্ষণ তা তা তার পক্ষ থেকে পরিশোধ করা হয়”। [সুনান ইবন মাজাহ:২৪১৩], ঋণ পরিশোধ না করার কারণে জান্নাতের যাওয়ার পথ বন্ধ হয়ে যায়; এমনকি যদি আল্লাহর রাস্তায় শহীদও হয়।

৯. মা-বাবার ভাল কাজসমূহ জারি রাখা :মা-বাবা যেসব ভাল কাজ অর্থাৎ মসজিদ তৈরী করা, মাদরাসা তৈরী করা, দীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরীসহ যে কাজগুলো করে গিয়েছেন সন্তান হিসাবে তা যাতে অব্যাহত থাকে তার ব্যবস্থা করা। কেননা এসব ভাল কাজের সওয়াব তাদের আমলনামায় যুক্ত হতে থাকে। হাদীসে এসেছে,

‘‘ভাল কাজের পথপ্রদর্শনকারী এ কাজ সম্পাদনকারীর অনুরূপ সাওয়াব পাবে’’। [সুনান আততিরমীযি : ২৬৭০]

‘যে ব্যক্তির ইসলামের ভাল কাজ শুরু করল, সে এ কাজ সম্পাদনকারীর অনুরূপ সাওয়াব পাবে। অথচ তাদেও সওয়াব থেকে কোন কমতি হবে না’’ [সহীহ মুসলিম:২৩৯৮]।

১০. মা-বাবার পক্ষ থেকে মাফ চাওয়া : মা-বাবা বেচে থাকতে কারো সাথে খারাপ আচরণ করে থাকলে বা কারো উপর যুলুম করে থাকলে বা কাওকে কষ্ট দিয়ে থাকলে মা-বাবার পক্ষ থেকে তার কাছ থেকে মাফ মাফ চেয়ে নিবে অথবা ক্ষতি পূরণ দিয়ে দিবে।

কেননা হাদীসে এসেছে,আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তোমরা কি জান নিঃস্ব ব্যক্তি কে? সাহাবীগণ বললেন, আমাদের মধ্যে যার সম্পদ নাই সে হলো গরীব লোক। তখন তিনি বললেন, আমার উম্মতের মধ্যে সে হলো গরীব যে, কিয়ামতের দিন নামায, রোযা ও যাকাত নিয়ে আসবে অথচ সে অমুককে গালি দিয়েছে, অমুককে অপবাদ দিয়েছে, অন্যায়ভাবে লোকের মাল খেয়েছে, সে লোকের রক্ত প্রবাহিত করেছেএবং কাউকে প্রহার করেছে। কাজেই এসব নির্যাতিত ব্যক্তিদেরকে সেদিন তার নেক আমল নামা দিয়ে দেয়া হবে। এবং তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। [সুনান আততিরমিযি :২৪২৮]সুতরাং এ ধরনের নিঃস্ব ব্যক্তিকে মুক্ত করার জন্য তার হকদারদের কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নেয়া সন্তানের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে।

এ ছাড়া হাদিস শরিফে মৃত ব্যক্তির জন্য হজ করার কথাও রয়েছে। ইসলামী স্কলাররা বলেন, সব ধরনের ভালো কাজের সওয়াবই মৃত মা-বাবা লাভ করেন। আল্লামা ইবনে কাইয়্যিম (রহ.) বলেন, ‘মৃত ব্যক্তির জন্য সবচেয়ে উপকারী হলো,দাসমুক্তি। তাঁর জন্য রোজা রাখার চেয়ে তাঁর জন্য দান করা উত্তম। যে দানের মাধ্যমে গ্রহীতার প্রয়োজন পূর্ণ হয় এবং যার উপকারের ধারা অব্যাহত থাকে তা উত্তম। যেমন রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘সর্বোত্তম সদকা (দান) তৃষ্ণার্তকে পানি পান করানো।’(সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ৩৬৬৫)।সুতরাং সন্তান মৃত মা-বাবার জন্য দান করবে এবং অভাবগ্রস্ত মানুষদের বেশি বেশি দান করবে।

পবিত্র কোরআনে পৃথিবীর সব মা-বাবাকে মহান আল্লাহ একটি দোয়া শিখিয়েছেন। দোয়াটি হলো রাব্বানা হাবলানা মিন আজওয়াজিনা ওয়া জুররিইয়াতিনা কুররাতা আইয়ুনি ওয়াজাআলনা লিলমুত্তাক্বিনা ইমামা।অর্থ :‘হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদের স্ত্রীদের পক্ষ থেকে এবং আমাদের সন্তানের পক্ষ থেকে আমাদের জন্য চোখের শীতলতা দান করো এবং আমাদের মুত্তাকিদের জন্য আদর্শস্বরূপ করো।’সুরা ফুরকান: ৭৪

তাইপ্রত্যেক বাবা-মার উচিত তাদের সন্তানদের ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিত করা এবং ইসলামের সঠিক দিক-নির্দেশনা প্রদান করা। আল্লাহতায়ালা সকল মুসলমানদের নেককার সন্তান দান করুক এবং বাবা-মাকে সন্তানের প্রতি দ্বায়িত্ব পালন করার তৌফিক দান করুক। পরিশেষে, মুসলমানের সন্তান-সন্তাতি যেন পরকালে তাদের বাবা-মার মুক্তিরউপায় হয় এই কামনা করছি।আমীন!

লেখক :

এস এম ফখরুল ইসলাম নোমানী (মোরশেদ)

হেড অব ফাইন্যান্স এন্ড একাউন্টস

এপিক হেলথ কেয়ার লিমিটেড