পদ্মা পাড়ে সাজ সাজ রব

সারা দিন প্রখর রোদ আর তীব্র গরম। এক সময় আষাঢ়ের সূর্যও ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে আসে। শেষ বিকেলে সূর্য টুপ করে ডুব দেয় উন্মত্ত পদ্মার বুকে। পর মুহূর্তেই পদ্মার বুকে সগৌরবে দাঁড়িয়ে থাকা পদ্মা সেতুতে একযোগে ৪১৫টি ল্যাম্পপোস্ট জ্বলে ওঠে। এ যেন দীর্ঘ প্রতীক্ষা আর নানান ষড়যন্ত্রকে বুড়ো আঙুল দেখানো। অন্ধকার পদ্মার বুকে বিদ্যুতের আলোয় পদ্ম সেতু যেন ধরা দিয়েছে এক রহস্য দানব হয়ে।
পদ্মা সেতুতে পরীক্ষামূলকভাবে প্রথম আলো প্রজ্বলিত হয় গত ৪ জুন। প্রথম ধাপে পদ্মা সেতুর ১৪ নম্বর পিলার থেকে ১৯ নম্বর পিলার পর্যন্ত মাওয়া প্রান্তে কয়েকটি ল্যাম্পপোস্টে আলো প্রজ্বলিত করা হয়। এরপর ধীরে ধীরে সবকটি ল্যাম্পপোস্টে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয়। পদ্মা সেতুতে মোট ৪১৫টি ল্যাম্পপোস্ট বসানো হয়েছে। এর মধ্যে মূল সেতুতে রয়েছে ৩২৮টি, জাজিরা প্রান্তের উড়ালপথে (ভায়াডাক্ট) ৪৬টি এবং মাওয়া প্রান্তের ভায়াডাক্টে বসানো হয়েছে ৪১টি ল্যাম্পপোস্ট।

এখন আর দিন নয়, অপেক্ষা কয়েক ঘণ্টার। তারপরই উদ্বোধন হতে যাচ্ছে পৃথিবীর দীর্ঘতম সেতুর অন্যতম পদ্মা সেতু। আগামীকাল শনিবার (২৫ জুন) সকাল ১০টায় দেশনেত্রী শেখ হাসিনা এ সেতুর উদ্বোধন করবেন।

আর তাই বহুল কাঙ্ক্ষিত পদ্মা সেতুর উদ্বোধনকে ঘিরে পদ্মা পাড়ে সাজ সাজ রব পড়েছে। আগামীকালের দিনটাকে উৎসবে পরিণত করবে বলে জানিয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। সকাল ১০টায় মুন্সিগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে রাষ্ট্রীয়ভাবে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হবে। তারপর শরিয়তপুরের জাজিরা প্রান্তে দলীয় জনসভা করবে দলটি। ধারণা করা হচ্ছে, আগামীকালের জনসভায় ১০ লাখের বেশি মানুষের সমাবেশ ঘটবে।


বহুল আকাঙ্ক্ষিত পদ্মা সেতু শনিবার উদ্বোধনের পর, যান চলাচলের জন্য রোববার (২৬ জুন) সকাল ৬টা থেকে উন্মুক্ত করা হবে। এটি দেশের পদ্মা নদীর ওপর নির্মাণাধীন একটি বহুমুখী সড়ক ও রেলসেতু। এর মাধ্যমে মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ের সঙ্গে শরীয়তপুর ও মাদারীপুর যুক্ত হবে। ফলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে উত্তর-পূর্বাংশের সংযোগ ঘটবে।

একসময় পদ্মা সেতু ছিল এক অকল্পনীয় স্বপ্ন। যা এবার বাস্তবে রূপ নিয়েছে, চোখের সামনে ভেসে উঠেছে বাস্তব এক চোখধাঁধানো অবকাঠামো। এটি নির্মাণের আগের হিসাব বলছে, মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ১ দশমিক ২৩ শতাংশ অবদান রাখবে এ সেতু। আর দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বাড়বে শিল্প-বিনিয়োগ। নগরায়ণ যেমন গতি পাবে, তেমনি কৃষিতে আসবে বিপ্লব।

পর্যটনের পাশাপাশি বাড়বে কর্মসংস্থান। অর্থাৎ, পদ্মা সেতুর প্রত্যক্ষ সুবিধাভোগী হবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের তিন কোটির বেশি মানুষ। এ সেতুর মাধ্যমে সড়ক ও রেল যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পাশাপাশি গ্যাস, বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট ও টেলিযোগাযোগ পরিষেবার লাইন সংযোগ গড়ে তোলা হয়েছে।

যা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে শিল্পকারখানার বিকাশে বড় ভূমিকা রাখবে। অন্যদিকে সহজ ও উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থায় আরও গতিশীল হয়ে উঠবে মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দর। সেতুটি চালু হলে স্বল্প সময়ে এ দুই বন্দর থেকে পণ্য খালাস হয়ে ঢাকাসহ দেশের অন্য বড় শহরে সহজেই পৌঁছে যাবে।

পদ্মা নদী পার হয়েই রাজধানীতে আসতে হয় দক্ষিণাঞ্চলের বাসিন্দাদের। এতদিন সেতু না থাকায় ফেরি পারাপারে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা, ভোগান্তি মাড়িয়ে আসতে হয়েছে ঢাকায়। এ ছাড়া পণ্য পরিবহনে ভোগান্তির সীমা নেই এ অঞ্চলের মানুষের। এবার পদ্মা সেতু তৈরি হওয়ায় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের দুঃখ ঘুচবে; সেই সঙ্গে পাল্টে যাবে জীবনযাত্রার মান।

পদ্মা সেতু নির্মাণকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি। খরস্রোতা পদ্মা নদীর ওপর ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণ হয়েছে স্বপ্নের এ সেতু। ২০১৪ সালে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয়। দুই স্তরবিশিষ্ট স্টিল ও কংক্রিট নির্মিত ট্রাস ব্রিজটির ওপরের স্তরে থাকবে চার লেনের সড়কপথ এবং নিচের স্তরটিতে একটি একক রেলপথ। পদ্মা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা নদীর অববাহিকায় ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের ৪১টি স্প্যান বসানো হয়েছে। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য এবং ১৮.১০ মিটার প্রস্থ পরিকল্পনায় নির্মিত দেশটির সবচেয়ে বড় এ সেতু।