কালী সাহার মিষ্টি: ৬০ বছরেও যার স্বাদের কোনো পরিবর্তন হয়নি

রসে টইটম্বুর রসগোল্লা দেখে কতক্ষণ আর লোভ সামলানো যায়? বসে গেলাম যথারীতি। দেখতে যেমন, স্বাদেও তেমন! এবার লালমোহনের পালা। মুখে পুরতেই, আহ, কী এক ভীষণ সুখ! এতো মোলায়েম যে মুখে পড়ামাত্রই মিলিয়ে গেল চোখের পলক না ফেলতেই। এতো কিছু খাবো, আর রাজভোগ খাবো না, রাজা-বাদশাদের মতো বিশাল যার পরিধি, তাকে কি আর হেয় করা যায়? স্বাদ? এককথায় অনন্য। সবশেষে পাতে দই না হলে তো চলেই না, সবমিলে যেন এক ছটাক স্বর্গ।
দই-মিষ্টির জন্য বহুকাল ধরেই বিখ্যাত সাভার। বিয়ে বা বড় পরিসরের কোনো আয়োজনে ভালো দই-মিষ্টির সন্ধানে দূরদূরান্ত থেকে সাভারে আসতে দেখা যেতো বনেদি পরিবারগুলোকে।

বংশী নদীর তীরঘেঁষা এই জনপদে বর্তমানে হরেক মানুষের ভিড় দেখা গেলেও স্থানীয় যে প্রাচীন পরিবারগুলো রয়েছে, ব্যবসায়ী হিসেবেও তাদের সুনাম আজকের নয়। স্বাধীনতার বহু আগে থেকেই হাটবারগুলোয় পাইকারি পণ্যের জন্য প্রায় দুইশ বছরের পুরোনো সাভারের ঐতিহ্যবাহী নামা বাজারে বিভিন্ন জেলা থেকে আসতেন ব্যবসায়ীরা। সদাইয়ের ফাঁকে বাজারে বসে দই-চিড়া খাওয়ার প্রচলন ছিল তখন। সেইসময় থেকেই ঢাকা ও এর আশেপাশের এলাকায় নাম-ডাক ছড়িয়ে পড়ে কালী সাহার মিষ্টির। বর্তমানে রাস্তার ওপরে বাজার বসায় মূল সড়ক থেকে কিছুটা ভেতরে চলে যাওয়ায় প্রাচীন এ বাজারটির গুরুত্ব খানিকটা কমে গেলেও বহাল তবিয়তে চলছে কালী সাহার বিখ্যাত মিষ্টির দোকানটি।

প্রতিদিন ঠিক সকাল ৬টায় দোকানটি খোলা হয়। দই-চিড়া-রসগোল্লা দিয়ে সকালের নাশতা পর্ব শুরু, রাত ১০টা পর্যন্ত চলে মিষ্টিমুখের সুযোগ।

দোকানটিতে ঢুকতেই চোখে পড়লো, ম্যানেজারের আসনে বসে আছেন ২৪/২৫ বছরের এক তরুণ। পিয়াস সাহা নামে ওই তরুণ জানালেন, তিনি কালী সাহার নাতি। ২০০১ সালে ৮০ বছর বয়সে মারা যান তার দাদা। এরপর থেকেই দোকানটি দেখভাল করেন কালী সাহার ছেলে প্রলয় সাহা। বর্তমানে পিয়াস ও তার বড় ভাই দোকানে বসছেন বংশ-পরম্পরায়।

কালী সাহার নাতি পিয়াস সাহার মুখ থেকেই শুনলাম, স্বাধীনতার আনুমানিক ১০ বা ২০ বছর আগে তার দাদার হাত ধরে চালু হয় এ দোকানটি। দই-চিড়ার জন্য বিখ্যাত দোকানটির সুনাম খুব দ্রুতই ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে চতুর্দিকে। সেই সময় থেকে শুরু করে ৬০ বছর পেরিয়ে গেলেও একইরকম জনপ্রিয় দোকানটি।

‘একসময় দই-মিষ্টির জন্য অত্যন্ত প্রসিদ্ধ ছিল সাভার। এ এলাকায় কয়েকশ মিষ্টির দোকান থাকলেও বেশিরভাগ বড় বড় দোকানই অতি মুনাফার লোভে তাদের মিষ্টির সেই স্বাদ, মান ধরে রাখতে পারেনি। তাই মিষ্টির প্রয়োজন হলেই চলে আসি, নামা বাজারে কালী সাহার দোকানে,’ জানালেন প্রায় ৪০ বছর ধরে কালী সাহার দোকান থেকে মিষ্টি কেনা রবিউল ইসলাম নামে এক খদ্দের। তারমতে, ৬০-৭০ বছর ধরে চলা এ দোকান এখনো মিষ্টির গুণগত মান বজায় রাখছে।

কালী সাহার আমলের তুলনায় দোকানটির আকৃতিতে এখনও খুব একটা পরিবর্তন আসেনি। একদল মিষ্টিখোর এসে বসছে, পছন্দ অনুযায়ী মিষ্টি খাচ্ছে, খাওয়া শেষ না হতেই হাজির আরও একদল। সবার মুখেই তৃপ্তির হাসি, এ যেন দোকানটির চিরাচরিত দৃশ্য।

তবে কালী সাহার হাত ধরে যখন চালু হয় মিষ্টির দোকানটি, সেসময় কিন্তু মিষ্টির এতো বাহারি ধরন ছিল না। কেবল দই, রসগোল্লা, গোলাপজাম, চমচম ছাড়া আর কিছু পাওয়া যেতো না। বর্তমানে দোকানটিতে পাওয়া যায় ১৬ থেকে ১৭ রকমের মিষ্টি।

থরে থরে সাজানো রসগোল্লা, কালোজাম, লালমোহন, চমচম, রসমালাই, রাজভোগ, জাফরান, সাদা চমচম, মালাইচপ, প্যারা সন্দেশ, গুড়ের রসগোল্লা, সন্দেশ, ইরানী ভোগ, ছানা সন্দেশ এবং ইলিশ পেটি দেখে জিভে জল আসতে বাধ্য।

রসে টইটম্বুর রসগোল্লা দেখে কতক্ষণ আর লোভ সামলানো যায়? বসে গেলাম যথারীতি। দেখতে যেমন, স্বাদেও তেমন! এবার লালমোহনের পালা। মুখে পুরতেই, আহ, কী এক ভীষণ সুখ! এতো মোলায়েম যে মুখে পড়ামাত্রই মিলিয়ে গেল চোখের পলক না ফেলতেই। এতো কিছু খাবো, আর রাজভোগ খাবো না, রাজা-বাদশাদের মতো বিশাল যার পরিধি, তাকে কি আর হেয় করা যায়? স্বাদ? এককথায় অনন্য। সবশেষে পাতে দই না হলে তো চলেই না, সবমিলে যেন এক ছটাক স্বর্গ।

রসগোল্লা, কালোজাম কিংবা লালমোহন, চমচম সবচেয়ে বেশি চললেও দোকানটিতে অন্যান্য মিষ্টির চাহিদা কিন্তু কম নয়। কেজিপ্রতি ১৮০ টাকা থেকে শুরু করে ৭০০ টাকার ভেতর পাওয়া যায় মিষ্টিগুলো। তবে মিষ্টির ধরনভেদে দামের হেরফের লক্ষ্য করা যায়। যেমন, একই রসগোলা ১০ টাকারও রয়েছে আবার ২০ টাকারও রয়েছে। তবে রাজভোগ, প্যারা সন্দেশ এগুলোর দাম কিছুটা বেশি। পিস প্রতি ৪০ টাকারও রয়েছে। সাধারণ কালোজাম, রসগোল্লা পিস প্রতি ১০ থেকে ১২ টাকায় বিক্রি করেন তারা। শীতে পিঠাপুলি বানানোর সময় প্রয়োজন অনুযায়ী দুধের ছানা, ক্ষীর, এমনকি মাওয়াও বিক্রি করেন তারা। মূলত তৃতীয় প্রজন্মের হাত ধরে ইরানি ভোগ, ইলিশ পেটির মতো নতুন অনেক ধরন যোগ হয়েছে তালিকায়, এমনটি দাবি পিয়াস সাহার।

তার ভাষ্যমতে, প্রতিদিনই ৮ থেকে ১২ মণ মিষ্টি বিক্রি হয়। খদ্দেরের চাহিদার ওপর অনেকটাই নির্ভর করে বিক্রি, তবে ঈদ, পূজাপার্বণ, পরীক্ষার ফল প্রকাশ, কিংবা পহেলা বৈশাখ বা ১৬ ডিসেম্বর ও ২৬ মার্চের মতো দিনগুলোয় বেড়ে যায় বিক্রিবাট্টা। দাম অনুযায়ী মিষ্টির মান একইরকম থাকায় বছরের পর বছর তাদের বিক্রি এখনও একই রকম আছে বলে জানালেন পিয়াস। মিষ্টি বানানোর জন্য প্রতিদিন প্রায় ১২-১৩ মণ দুধ প্রয়োজন হয় তাদের। কালী সাহার আমলে যারা তাদের দুধের যোগান দিতেন, বংশ পরম্পরায় তাদের পরবর্তী প্রজন্মই এখনও দুধের যোগান দিচ্ছে বলেও জানালেন তিনি।

পিয়াস সাহার কথা যে ভুল নয় তার প্রমাণ অবশ্য চোখে পড়বে দোকানে প্রবেশের সময়ই। একটু সামনের দিকে তাকালেই চোখে পড়বে বড় বড় উনুনে বিশাল বিশাল হাঁড়ি। পরপর রাখা দুটি বিরাট হাঁড়িতে জ্বাল হচ্ছে দইয়ের জন্য দুধ। পাশাপাশি রাখা বিরাট বিরাট কড়াইগুলোর একটায় তৈরি হচ্ছে চিনির শিরা, একটায় মিষ্টি ভাজার জন্য তেল। একেকটা হাঁড়িতে কমপক্ষে এক মণ মিষ্টি তৈরি হয়।

মিষ্টি তৈরির জন্য প্রথমে দুধ কেটে ছানা তৈরি করা হয়। ছানাগুলো থেকে পানি বের করে দিতে সাদা পাতলা কাপড়ে সেগুলো বেধে রাখা হয়। নিচে রাখা পেয়ালায় সারাদিন ধরে পানি জমতে থাকে। ৭/৮ ঘণ্টা পর ছানা থেকে পানি সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে গেলে সেই ছানা ভালোমতে মথে নিয়ে একে একে তৈরি হয় রসগোল্লাসহ অন্যান্য মিষ্টি।

দোকানের পেছনের অংশে রাখা বেশ কয়েকটি থালি দেখালেন তিনি। একেকটা থালিতে প্রায় ৭-৮ লিটার দুধ থেকে তৈরি মাওয়া রাখা। মিষ্টির স্বাদ বাড়ানো মাওয়ার জন্য আজকাল মুড়ি বা বিস্কুটের গুঁড়া ব্যবহৃত হলেও তাদের দোকানে এখনও ঘন দুধের মাওয়াই ব্যবহার করা হয়, যার কারণে অন্যান্য মিষ্টির দোকানের চেয়ে তাদের মিষ্টির স্বাদ আলাদা।

স্বাদ নিয়ে কথা হচ্ছিল নাইমুল ইসলাম নামে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া এক শিক্ষার্থীর সঙ্গে। মিষ্টি ভালোবাসেন বলে কোনো কাজে সাভারে গেলেই হানা দেন কালী সাহার মিষ্টির দোকানে। তার মতে, অন্যান্য সব জায়গার মিষ্টির তুলনায় অনেকটাই আলাদা কালী সাহার মিষ্টি। জ্বাল হওয়া ঘন দুধের সুন্দর একটা ঘ্রাণ পাওয়া যায় এ মিষ্টিতে। সাভারের অদূরেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ায় এবং মিষ্টির দাম তুলনামূলকভাবে অনেক কম হওয়ায় সেখান থেকে প্রায়ই শিক্ষার্থীরা যান দলবেধে মিষ্টি খেতে। প্রায়ই নামা বাজারে অন্য কোনো কাজ থাকলেও মিষ্টির দোকানটিতে ঢুঁ মারতে দেখা যায় তাদের।

আমিনুর রহমান নামে বিশ্ববিদ্যালয়টির সাবেক এক শিক্ষার্থী জানান, ‘বন্ধুর সঙ্গে এসেছিলাম কালী সাহার দোকানটিতে। দুজন মিলে রাজভোগ আর লালমোহন খেয়েছি। দাম এসেছে মাত্র ১২০ টাকা। মিষ্টির স্বাদও বেশ ভালো।’

জানা যায়, প্রথম জীবনে মহা প্রসাদ নামে পাশে থাকা আরেকটি মিষ্টির দোকানে কারিগরের কাজ নিয়েছিলেন কালী সাহা। পরবর্তীতে নিজেই দোকান দেন তিনি। তার দুই ছেলে ছিল। বড় ছেলে ২৪ বছর বয়সে মারা যান অবিবাহিত অবস্থায়। এরপর থেকে ছোট ছেলে প্রলয় সাহা বাবার সঙ্গে দোকানে বসতে শুরু করেন। প্রথমদিকে কালী সাহা নিজেই সব মিষ্টি তৈরি করতেন। তবে এখন দোকানটিতে কারিগরসহ রয়েছেন ১৫/১৬ জন কর্মচারী। আগে হাটের দিনে দই-চিড়া-মিষ্টি খেতে ভিড় জমতো, এখন হাট ছোট হয়ে গেছে, সেইভাবে আর জমে না। আর দই-চিড়ার খাওয়ার প্রচলন তো বাঙালি ভুলতেই বসেছে অনেকটা।

দই-চিড়ার চাহিদা কমে গেলেও দিনে মিষ্টি যাই বানানো হোক তার প্রায় সব শেষ হয়ে যায় দিনেই। বিশেষ করে গরম গরম রসগোল্লার আবেদন এখনও রয়েছে। আর শীতকালে প্রচুর পরিমাণ বিয়ে ও অন্যান্য অনুষ্ঠান হওয়ায় মিষ্টির চাহিদা থাকে অনেক বেশি।

শুধু দেশে নয়, দেশের বাইরেও এ মিষ্টির চাহিদা প্রচুর। একবার যারা স্বাদ নিয়েছেন, তারা বাইরে গেলেও বারবার এর স্বাদ নিতে চান বলে জানালেন পিয়াস সাহা। চিনি, ময়দার দাম অনেক বেড়ে যাওয়ায় মিষ্টির মান অক্ষুণ্ণ রাখতে অনেকটাই কষ্ট করতে হচ্ছে। এরপর দৈনিক ৩৫০ টাকা থেকে শুরু করে ৬০০ টাকা পর্যন্ত দোকানের কর্মচারী ও কারিগরদের তাদের মজুরি তো রয়েছেই। তবে জিনিসপত্রের দাম যতই বাড়ুক, মিষ্টির দাম বা মানের বিষয়ে কোনো আপস করতে চান না ঐতিহ্যবাহী দোকানটির এ তরুণ প্রতিনিধি।