রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকল: সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ প্রস্তাব

রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলো সংস্কারে বিনিয়োগ নিয়ে আসছে বিদেশী তিন কোম্পানির কনসোর্টিয়াম ‘সুগার ইন্টারন্যাশনাল’। সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই), জাপান ও থাইল্যান্ডের তিনটি কোম্পানি নিয়ে কনসোর্টিয়ামটি গড়ে তোলা হয়েছে। সরকারি মালিকানাধীন চিনিকলগুলো সংস্কারে ৬৪ কোটি ৫০ লাখ ডলার (সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি) বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছে এ কনসোর্টিয়াম। এর মধ্য দিয়ে চিনিকলগুলো হয়ে উঠবে যৌথ ব্যবস্থাপনাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান। যৌথ ব্যবস্থাপনায় রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলো মুনাফার ধারায় ফিরবে বলে প্রত্যাশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

প্রক্রিয়াটি এরই মধ্যে কিছুদূর এগিয়েছেও। প্রকল্পের অর্থায়নকারীও জোগাড় করেছে কনসোর্টিয়াম। সুগার ইন্টারন্যাশনালের বিনিয়োগকৃত অর্থের প্রধান উৎস জাপান ব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন (জেবিআইসি) ও থাইল্যান্ডের এক্সিম ব্যাংক। বিনিয়োগের অর্থের ৭০ শতাংশ কনসোর্টিয়ামকে ঋণ হিসেবে জোগান দেবে ব্যাংক দুটি। বাকি ৩০ শতাংশ বিনিয়োগ হচ্ছে কনসোর্টিয়ামের মূলধন হিসেবে।

কয়েক দশক ধরেই লোকসানে চলছে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন (বিএসএফআইসি)। এর মধ্যে শুধু গত পাঁচ বছরেই প্রায় ৪ হাজার ৩৫১ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে সংস্থাটি। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, সংস্থাটির ২০২০-২১ অর্থবছরে লোকসান হয়েছে ৯৭২ কোটি টাকা। তার আগের অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ৯৭০ কোটি টাকা। বর্তমানে সব মিলিয়ে সংস্থাটির ওপর ব্যাংকঋণের দায় বর্তেছে ৮ হাজার কোটি টাকারও বেশি।

দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলোর বয়স অনেক বেশি। প্রায় পাঁচ থেকে নয় দশকের পুরনো এসব চিনিকলের যন্ত্রপাতি এখন পুরোপুরি জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। মেরামত, প্রতিস্থাপন ও সংস্কার ছাড়া চিনিকলগুলোকে লাভজনক করা সম্ভব নয় বলে মনে করছেন দেশের চিনি ও খাদ্য শিল্প খাতসংশ্লিষ্টরা। এছাড়া চিনিকলগুলোর উৎপাদিত পণ্যের বহুমুখীকরণও অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে। এখন পর্যন্ত বারবার এ-সংক্রান্ত উদ্যোগ নেয়া হলেও তা অর্থাভাবে মুখ থুবড়ে পড়েছে। এ অর্থায়ন নিশ্চিত করতেই চিনিকলগুলোকে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের যৌথ ব্যবস্থাপনায় পরিচালনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে সরকারের কাঠে বিনিয়োগ প্রস্তাব নিয়ে এগিয়ে এসেছে সুগার ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম।

বিনিয়োগ প্রস্তাবটি নিয়ে করণীয় ঠিক করতে এরই মধ্যে শিল্প মন্ত্রণালয়কে দায়িত্ব দিয়েছে সরকার। মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এসএম আলমকে সভাপতি করে একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছে।

সম্প্রতি অনুষ্ঠিত কমিটির প্রথম বৈঠকে সুগার ইন্টারন্যাশনালের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়। এ সময় শিল্প মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা শাখা থেকে জানানো হয়, জরাজীর্ণ চিনিকলগুলো প্রতিস্থাপন, মেরামত, বহুমুখী পণ্য উৎপাদন, রিফাইনারি প্রতিষ্ঠাসহ নানামুখী পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রায় সাড়ে ৬৪ কোটি ডলার (সর্বশেষ বিনিময় হার অনুযায়ী ৫ হাজার ৬৭৬ কোটি টাকার সমপরিমাণ) প্রয়োজন হবে। ইউএই, জাপান ও থাইল্যান্ডের তিন কোম্পানি নিয়ে গঠিত সুগার ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম এ অর্থ বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছে। মোট ব্যয়ের ৭০ শতাংশ কনসোর্টিয়ামকে ঋণ হিসেবে জোগান দেবে জেবিআইসি ও থাইল্যান্ডের এক্সিম ব্যাংক। বাকি ৩০ শতাংশ কনসোর্টিয়াম মূলধন হিসেবে বিনিয়োগ করবে।

সভায় কনসোর্টিয়াম এবং এটিকে অর্থায়নকারী ব্যাংকগুলোর প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন। এ সময় বিডার পক্ষ থেকে অর্থায়নকারী ব্যাংকগুলোর গ্যারান্টি সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়। এর জবাবে কনসোর্টিয়ামের পক্ষ থেকে বলা হয়, জেবিআইসি ও থাই এক্সিম ব্যাংকের পলিসি অনুযায়ী ঋণের জন্য সরকারের সভরিন গ্যারান্টি প্রয়োজন। তবে এক্ষেত্রে প্রকল্পে সুগার ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়ামের বিনিয়োগের পুরোটাই (৭০ শতাংশ ঋণ ও ৩০ শতাংশ মূলধন) সরকারকে জামানত হিসেবে দেয়া হবে।

এ সময় সভাপতি অতিরিক্ত সচিব এসএম আলম বলেন, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো ঋণের বিপরীতে ব্যাংক গ্যারান্টি দিলে কনসোর্টিয়াম প্রকল্পে বিনিয়োগকৃত অর্থের পুরোটাই জামানত হিসেবে জমা দিতে পারবে।

আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের পক্ষ থেকেও এ সময় বলা হয়, বিনিয়োগ চুক্তিটি জিটুজি না হওয়ায় এতে সভরিন গ্যারান্টি দেয়ার সুযোগ নেই। সুগার ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়ামের প্রতিনিধিরা এ প্রস্তাবে সম্মতি জানান। এ অবস্থায় প্রকল্পটি বাস্তবায়নে খুব একটা বাধা নেই বলে মনে করছে শিল্প মন্ত্রণালয়।

প্রকল্পে লোকসান হলে ঋণ পরিশোধের পন্থা নিয়ে সভায় বলা হয়, যেহেতু সম্পূর্ণ বিনিয়োগ ব্যাংকের কাছে জামানত হিসেবে থাকবে, সেহেতু লোকসান হলে ব্যাংক তা হস্তগত করতে পারবে।

জানা গিয়েছে, বিনিয়োগ চূড়ান্ত হলে বিএসএফআইসির সঙ্গে সুগার ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়ামের একটি চুক্তি হবে। চুক্তিতে কনসোর্টিয়াম ও বিএসএফআইসির মধ্যে শেয়ার বণ্টনের কথাও উল্লেখ থাকবে। উভয় পক্ষের মধ্যে মুনাফা বা লোকসান ভাগাভাগিও সে অনুযায়ী হবে। এছাড়া জেবিআইসি ও থাই এক্সিম ব্যাংকের ঋণের দায়ভারও থাকবে সুগার ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়ামের ওপর।

এ ধরনের বিদেশী বিনিয়োগকে স্বাগত জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। এ প্রসঙ্গে পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) চেয়ারম্যান অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বণিক বার্তাকে বলেন, বিশ্বজুড়েই এমন হয়। আমরাও বিদেশী বিনিয়োগ চাচ্ছি। তাই এ ধরনের বিনিয়োগকে আমরা স্বাগত জানাই। দেশের চিনিকলগুলোকে সংস্কারের মাধ্যমে লাভজনক করা সম্ভব মনে করেই সুগার ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম এ বিনিয়োগ নিয়ে এগিয়ে এসেছে। আমি মনে করি, দেশের জন্য এটি খুবই ভালো একটি খবর।

শিল্প মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা মনে করছেন, চিনিকলগুলোর বর্তমান অবস্থায় এগুলো দিয়ে বিএসএফআইসিকে লাভজনক অবস্থানে ফেরানো সম্ভব নয়। দেশের ১৫টি চিনিকলের মধ্যে তিনটি ত্রিশের দশক, তিনটি পঞ্চাশের দশক, সাতটি ষাটের দশক ও দুটি স্বাধীনতার পর স্থাপিত হয়েছে। অধিকাংশ চিনিকলের যন্ত্রাংশ অত্যন্ত পুরনো ও জরাজীর্ণ। এসব চিনিকলকে মেরামত ও বহুমুখী পণ্য উৎপাদনের মাধ্যমেই সংস্থাটিকে লাভজনক অবস্থায় ফেরানো সম্ভব।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব জাকিয়া সুলতানা বণিক বার্তাকে বলেন, ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে জেবিআইসি ও থাইল্যান্ডের এক্সিম ব্যাংক সরকারের সভরিন গ্যারান্টি চেয়েছিল। কিন্তু এক্ষেত্রে সভরিন গ্যারান্টি দেয়ার সুযোগ নেই। তাই রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো থেকে গ্যারান্টি দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ বিষয়ে মতামত জানানোর জন্য ব্যাংক দুটিকে চিঠি লেখা হয়েছে। এছাড়া চিনিকলগুলোর উন্নয়নে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সুগার ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম, জেবিআইসি ও থাইল্যান্ডের এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করা হচ্ছে। আশা করছি, শিগগিরই আমরা এ বিনিয়োগ পাব। এ উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে পারলে চিনিকলগুলো লাভজনক অবস্থায় ফিরে আসবে।

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সুগার মিলস করপোরেশন গঠিত হয়। পরবর্তী সময়ে এর সঙ্গে বাংলাদেশ ফুড অ্যান্ড অ্যালাইড ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনকে একীভূত করে গঠন করা হয় বিএসএফআইসি। বর্তমানে করপোরেশনের ১৫টি চিনিকল, একটি ইঞ্জিনিয়ারিং, একটি ডিস্টিলারি ও একটি জৈব সার কারখানা আছে। সংস্থাটির ১৫টি চিনিকলের মধ্যে ছয়টি বন্ধ রয়েছে ২০২০ সাল থেকে।

এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে শুধু চুয়াডাঙ্গার দর্শনায় কেরু অ্যান্ড কোম্পানি চিনির পাশাপাশি আখের উপজাত দিয়ে জৈব সার, অ্যালকোহল, স্পিরিট, ভিনেগার, হ্যান্ড স্যানিটাইজার উৎপাদন করে মুনাফা করছে। বাকি সব প্রতিষ্ঠানই লোকসানি। কেরু অ্যান্ড কোম্পানি চিনি উৎপাদন করে লোকসান করলেও উপজাত পণ্যের বদৌলতে কয়েক বছর ধরেই বার্ষিক ১০-১৫ কোটি টাকা মুনাফা করছে।

কনসোর্টিয়ামের প্রস্তাবটিকে স্বাগত জানিয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এসব প্রতিষ্ঠান বছরের পর বছর লোকসান করে সরকারের রক্তক্ষরণ বাড়াচ্ছে। বেশ কয়েকবার এ প্রতিষ্ঠাগুলোকে পুনর্গঠন করারও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, কিন্তু পরিচালনায় অদক্ষতার কারণে এগুলোকে লাভজনক করা যায়নি। এ পরিপ্রেক্ষিতে চিনিকলগুলোকে সংস্কারের জন্য যদি দেশের বাইরের কেউ আগ্রহী হয় তাহলে সেসব প্রস্তাব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে অবশ্যই ইতিবাচকভাবে বিবেচনা করা উচিত।

এর আগে রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলোকে যৌথ ব্যবস্থাপনায় পরিচালনার সম্ভাব্যতা নিয়ে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এতে সভাপতিত্ব করেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম। সভায় বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা), শিল্প মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ও বিএসএফআইসির প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। সেখানেই বিনিয়োগ প্রস্তাবটি বাস্তবায়নের জন্য শিল্প মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এসএম আলমকে প্রধান করে উল্লিখিত কমিটি গঠন করা হয়।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের চেয়ারম্যান মো. আরিফুর রহমান অপু বণিক বার্তাকে বলেন, মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে শিল্প মন্ত্রণালয়কে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবকে প্রধান করে একটি কমিটি করা হয়েছে। এ প্রক্রিয়ার পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে কমিটিই ভালো বলতে পারবে।