বৈশাখ রুদ্র আবেগে এনেছে নতুন ঋতু গ্রীষ্মের জাগরণ

বৈশাখ রুদ্র আবেগে এনেছে নতুন ঋতু গ্রীষ্মের জাগরণ। পঞ্জিকার পালাবদলে বৃহস্পতিবার (১৪ এপ্রিল) পহেলা বৈশাখ এনেছে নতুন বছর, ১৪২৯ বঙ্গাব্দ।

মুঘল সম্রাট আকবরের আমলে যা ছিল খাজনা উপলক্ষ, তা এখন উদ্যাপনের উৎসব।
এ নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে, উদ্যাপন করতে সমগ্র বাঙালি জাতি আজ এক কাতারে। ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে বাঙালির একমাত্র অসাম্প্রদায়িক উৎসবের দিন এটি। বৈশাখ আসলে ঘরে ফেরার ডাক। বাঙালির আদি ও অকৃত্রিম নিজস্বতায় অবগাহনের প্রেরণা। নিজের আত্মপরিচিতি ও আত্মআবিষ্কারের প্রতীতি ও প্রত্যয়ের নাম বৈশাখ।

বিশিষ্টজনদের মতে, আমাদের এখানে ধর্ম নিরপেক্ষ আর কোনো জাতীয় উৎসব নেই। অসাম্প্রদায়িকতার দিক থেকে বিবেচনা করলে পহেলা বৈশাখ বেশি গুরুত্বপূর্ণ। প্রকৃতিগতভাবেও বৈশাখ গুরুত্বপূর্ণ। একদিকে ফসলি মাস, অন্যদিকে কালবৈশাখী। সব মিলিয়ে বৈশাখ উদ্দীপনামূলক এক মাস, যা আমাদের জীবনে নতুন মাত্রা যোগ করে।

আবহমানকাল বাংলার গ্রামীণ জনপদে উদ্যাপিত হওয়া নববর্ষের আয়োজন এখন ছুঁয়েছে নগর জীবনে এবং নতুন মাত্রায়। সর্বত্র উদযাপিত হচ্ছে বাংলার উৎসব, উচ্চারিত হচ্ছে বাঙালিয়ানার জয়গান। কণ্ঠে কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে, ‘সবার ওপরে মানুষ সত্য। ‘

প্রকৃতপক্ষে পহেলা বৈশাখ শুধু আমাদের একার উৎসব নয়। গোটা অঞ্চলেই বৈশাখ উদ্যাপিত হয়। সেই সঙ্গে পুরো অঞ্চলেই প্রকৃতির বদল হয়। আমরা নিজস্ব সংস্কৃতির কথা বলি, সেটার সঙ্গে প্রকৃতির সংলগ্নতা রয়েছে। এটাই আমাদের সংস্কৃতির অন্যতম উপাদান।

বর্তমানে পহেলা বৈশাখের আয়োজনে মুখ্য হয়ে উঠেছে সাংস্কৃতিক কার্যক্রম, যা প্রবর্তনের কৃতিত্ব প্রায় পুরোটুকুই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। তিনি শান্তিনিকেতনে প্রথম ঋতুভিত্তিক উৎসবের আয়োজন করেন। সেই ধারাবাহিকতায় বাংলার প্রান্ত থেকে শহরে ছড়িয়ে পড়ে বর্ষবরণের আয়োজন। ১৯৬১ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে রবীন্দ্রচর্চা নিষিদ্ধ করার চেষ্টা হয়েছিল, সেই চেষ্টা প্রতিরোধেরও অংশ হয়ে গিয়েছিল বর্ষবরণের আয়োজন। এ বিষয়ে শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম জানান, বৈশাখ প্রকৃতিতে সব রঙ নিয়ে আসে। বৈশাখ মানেই রঙের মেলা। যদিও এ সময় প্রকৃতি খুব কঠোর থাকে, যার মাধ্যমে বৈশাখ আমাদের মধ্যে সুদৃঢ় এক শক্তি তৈরি করে দেয়। বৈশাখে প্রকৃতির বৈপরীত্য থাকে। একটি কোমল, আরেকটি রূঢ় রূপ। এটা ঠিক বাঙালিদের চরিত্রের মতো। সব মিলিয়ে আমার কাছে বৈশাখ মানে আত্মআবিষ্কারের মাস। যেখানে আমাদের মেধা-মনীষার সৃজনশীল সব উপাদানই রয়েছে।

‘এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ

তাপস নিঃশ্বাস বায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে

বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক – – –

যাক পুরাতন স্মৃতি যাক ভুলে যাওয়া গীতি

অশ্রু বাষ্প সুদূরে মিলাক।’

রবীন্দ্রনাথের রুদ্র বৈশাখ কখনো ভিন্ন মাত্রায় প্রতিফলিত –

‘হৈ ভৈরব, হে রুদ্র বৈশাখ,

ধুলায় ধূসর রুক্ষ উড্ডীন পিঙ্গল জটাজাল,

তপঃক্লিষ্ট তপ্ত তনু, মুখে তুলি বিষাণ ভয়াল

কারে দাও ডাক-

হে ভৈরব, হে রুদ্র বৈশাখ?’

বাংলাদেশের জাতীয় কবি কবি কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬ খ্রি.)-এর জন্ম বৈশাখ মাসে না হলেও তিনি স্বভাবে, আচরণে কাব্যভাবে বৈশাখের মতো রুদ্র, প্রকৃতির মতো অশান্ত, সতত বিদ্রোহী এবং ‘চির উন্নত শির’-

‘ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কালবৈশাখীর ঝড়

তোরা সব জয়ধ্বনি কর

তোরা সব জয়ধ্বনি কর

ধ্বংস দেখে ভয় কেন তোর

প্রলয় নূতন সৃজন বেদন

আসছে নবীন জীবন ধারা অসুন্দরে করতে ছেদন

তাই যে এমন কেশে-বেশে

মধুর হেসে

ভেঙে আবার গড়তে জানে সে চির সুন্দর।’

চিরায়ত বৈশাখের রূপ, রস, আবহ তথা যাবতীয় অনুষঙ্গ শাশ্বত বাংলার ও বাঙালির সাংস্কৃতিক জীবনে, ব্যক্তিগত চর্যায়, সামাজিক গতিশালতায় এবং ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারে এক অবিভাজ্য অংশ। বৈশাখ আর বাঙালি যেন একাকার সত্তা। নগর ও গ্রামীন জীবনে বৈশাখ তথা বাংলা নববর্ষের দ্যোতনা বাঙালি জীবনে ঋদ্ধিমান আলোকমালায় দীপ্ত ও উৎসবমুখর।

কায়মনে বাঙালি প্রার্থনা করবে- ‘মুছে যাক গ্লানি ঘুচে যাক জরা/ অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা…। ‘