মানুষের জীবনটা যেন এক পরিযায়ী পাখি প্রিয় সিরাজ ভাই আপনার জন্য আমার শোকাঞ্জলি !

রশীদ এনাম:: শেখ সাদি বলেছিলেন, “এমনভাবে জীবন যাপন করো যেন কখনো মরতে হবে নাহ, আবার এমনভাবে মরে যাও যেন কখননো বেঁচেই ছিলে না”। এই উক্তিটি আমার খুব প্রিয়। সত্যি মানুষের জীবনটা এমন হওয়া উচিত, যেন কখনো মরতে না হয়। মানুষ তাঁর সৎ কর্মের মধ্যে বেঁচে থাকেন। মরেগেলেও যেন মানুষের হৃদয়ে বেঁচে থাকেন। সবাই যেন বলে আহা, তিনি একজন মহৎ ও পরোপকারী মানুষ ছিলেন। মৃত্যু মাত্রই আমরা জন্মি সমুদ্রের পনে উড়ে যাওয়া পরিযায়ী পাখির মতো, এই এলো বুঝি এই চলে গেল। মাঝখানে ডানা মেলে উড়ে যাওয়া ক্ষনিক সময়টুকু। আহা মানুষের জীবনটা কত ক্ষণিকসময়ের।
গত ১০ এপ্রিল আমার খুবকাছের প্রতিবেশী পটিয়া পৌরসভার প্রাক্তন মেয়র অধ্যাপক হারুনুর রশীদের বড় ভাই, বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী সফল উদ্যেক্তা, সিরাজুল মোস্তফা ভাই সবাইকে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে চলেগেলেন। প্রিয় মানুষটি জন্য আমার একচিলতে শোকগাথা রচনা করার বৃথা চেষ্ঠা।
আমার অনুভূতিতে তিনি ছিলেন, একজন সদালাপি হাস্যোজ্জল প্রাণবন্ত মানুষ। সিরাজ ভাই শিশুদের মতো খুব সহযে মানুষের সাথে মিশতেন। শিশুদের খুব ভালোবাসতেন। অসহায় নিষ্পেষিত মানুষের প্রতি ভালোবাসার হাত প্রসারিত করে দিতেন। নিজের লবণ এবং পলি ব্যাগ কারখানার শ্রমিকদের সাথে ভালো ব্যবহার করতেন। নিজের প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের কাছে ছিলেন জনপ্রিয় একজন বস। সকলে সিরাজ ভাইকে পছন্দ করতেন। তাঁর প্রিয়জন, ছোট ভাই,সন্তানদের কাছে ছিলেন একজন প্রকৃত বন্ধু। কখনো কারও সাথে কটু বাক্য বলতেন না। স্পষ্টবাদী মানুষটি চোখের সামনে অন্যায় দেখলে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতেন। সাড়ে তিন হাত মাটির কুটুরিতে চলেগেলে বুঝা যায়, মানুষের ভালোবাসা, ভালো কর্মটি যেন জলজোছনার মতো জলছবি হয়ে ভেসে বেড়ায় মানুষের হৃদয়ে।
গত ২০১৮ সালের কথা পটিয়া পৌরসভার ৪নং ওয়ার্ড এ পশ্চিম পটিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে “শহীদ ছবুর শিশুতোষ পাঠাগার” করার পরিকল্পনার কথা সিরাজ ভাইকে মুঠোফোনে জানালাম। তিনি ছিলেন ইশকুল পরিচালনা কমিটির সভাপতি। পাঠাগারের কথা শুনে খুশি হলেন।তারাহুড়া করে ইশকুল ভবনে একটা কক্ষ সজ্জিত করে দিলেন, বুক সেলফ কিনে দিলেন। ২০১৯ সালের ২৮মার্চ চট্টগ্রাম চারুকলা কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ সবিহ্ উল আলম স্যার পাঠাগারটি উদ্বোধন করলেন। পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করার পর সিরাজ ভাই আমাকে আরও আপন করে নিলেন। খুশি হয়ে বলেছিলেন, “শিশুতোষ পাঠাগারটি একটি বাতিঘরে মতো শিশুরা আলোকিত হবে শিশুরা এগিয়ে গেলে দেশও এগিয়ে যাবে”। তিনি নিজেও মাঝে মাঝে ইশকুলের পাঠাগারে বসে শিশুদের সাথে বই পড়তেন। ইশকুলের ছাদবাগানে গিয়ে নিভৃতচিত্তে হাটতেন প্রকৃতি উপভোগ করতেন। তিনি খুব ধার্মিক, প্রকৃতি প্রেমি এবং পরোপকারী ছিলেন।
পাহাড়ে ভ্রমণ করতে বেশ পছন্দ করতেন। একবার ইশকুল থেকে চড়ুইভাতি করতে বান্দরবনে নিয়েগেলেন। আহা কি আনন্দ, উচ্ছ্বাস যাত্রাপথে সিরাজ ভাই গানও গাইলেন অনেক মজাও করলেন। চড়ুইভাতি অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করলেন। সবারমাঝে নিজহাতে খাবার পরিবেশন করলেন। আমার দেখা সিরাজ ভাই একজন প্রকৃত ভালো মানুষ ছিলেন। ব্যক্তিগতজীবনে সিরাজ ভাই দুই সন্তান ও দুই কন্যার জনক।ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা করিয়ে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করেগেছেন। বড় ছেলে আসিফ তাঁর বাবার ব্যবসা পরিচালনা করেন। ছোট ছেলে রাকিব একজন প্রতিষ্টিত ডাক্তার বর্তমানে ঢাকার এ্যাপলো হাসপাতালে কর্মরত আছেন।
সিরাজ ভাইয়ের সাথে গত মাসেও মুঠোফোনে শেষ কথা হয়েছিল। অসুস্থ শরীর নিয়ে কথা বলতে পারছিলেন না। তবু বলে যাচ্ছেন, বই মেলা কেমন হলো ? বই কেমন চলছে। অসুস্থ সবার কাছে দোয়া চাইলেন। ফোন করলে, “আমার প্রিয় রশীদ এনাম ভাই কেমন আছেন বলে একটা চিৎকার দিতেন”। আহা আমার মুঠো ফোনে সিরাজ ভাইয়ের রিং টোন আর বাজবে না। কেউ কল করে জিজ্ঞেস করবে না। কবে বাড়ি আসব ? বাড়ি আসলে বাসায় আসবেন। ইশকুলের ভবন নিয়ে জরুরী কথা আছে। সিরাজ ভাই খুবই দায়িত্ব নিষ্ঠাবান কর্মঠ একজন মানুষ, যে কিনা নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে সময় না দিয়ে ইশকুল উন্নয়নের জন্য প্রচুর সময় দিয়েছেন। নিবেদিত প্রাণ হয়ে নিজের পকেটের টাকা ব্যায় করে ইশকুলের মাঠ ভরাট, ছাদ বাগান, সীমানা প্রাচির, তোরণ, ভবন, ওয়াশ রূম,পাঠাগার এটা ওটা কত কিছু না স্থাপন করলেন। সবকিছু যেন আজ স্মৃতিতে অম্লান। কথাসাহিত্যিক লেখক হুমায়ুন আহমেদ বলেছিলেন,
“আল্লাহ যদি কাউকে মারতে চান তাহলে তার কোন আয়োজন করার প্রয়োজন আছে ? তাহলে মরতে কিসের ভয়। একবারই তো মরতে হবে”। প্রিয় সিরাজ ভাই আপনি হাসিমুখে চীরতরে লুকোচুরি দিলেন। আপনাকে হারিয়ে আপনার ইশকুলের শিক্ষক ও ফুলের মতো ছোট শিশুরা সবাই কাঁদছে। আপনার জন্য আমি শোকাঞ্জলি রচনা করেছি। মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে ফরিয়াদ করি তিনি যেন আপনাকে জান্নাতের বাগানের ফুল ফুটিয়ে রাখেন- আমিন।

রশীদ এনাম, লেখক ও প্রাবন্ধিক।